মেয়েদের সাফ জয়, যেন এক পশলা বৃষ্টি

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস অবস্থা দেশের মানুষের।  পত্রিকার পাতা খুললেই গুম, খুন, ধর্ষণের খবর। রাজনৈতিক অস্থিরতাও চরমে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাড়ছে শঙ্কা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের মন থেকে ‘শান্তি’ নামক শব্দটি যেন উধাও। শান্তি নেই। অস্থিরতার গোমট সরিয়ে দেশের মানুষকে মাঝে মধ্যে ‘একটু সুখ, একটু হাসি’ এনে দিত যারা, বাংলাদেশের সেই জাতীয় ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্সও বছর খানেক ধরে হতাশাজনক। এই অবস্থায় সাফ ফুটবলে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশের মেয়েদের চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা যেন এক পশলা স্বস্তির বৃষ্টি।

শঙ্কা-হতাশার আড়াল ফুড়ে দেশবাসীর মনে সুখানুভূতি আঁকিয়ে দিয়েছে। অশান্ত হৃদয়ে ফুটিয়েছে হাসির ঝিলিক। মেয়েদের এই অর্জন সত্যিকার অর্থেই বড় এক প্রাপ্তি। এমন অমিয় খুশি উপহার দেওয়ার জন্য সাবিনা খাতুনের দলের ধন্যবাদটা প্রাপ্যই।

সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ সর্বশেষ শিরোপা সাফল্যের মুখ দেখেছিল সেই ২০০৩ সালে। সেই সাফল্যটাও ছিল পুরুষ ফুটবলে। মেয়েরা কখনো সাফ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। একবার অবশ্য ফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের সেই ফাইনালে ভারতের কাছে শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন ছুঁতে না পারার আক্ষেপ নিয়েই ফিরতে হয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েদের।

৬ বছর পর দ্বিতীয় বার ফাইনালে উঠে আর স্বপ্নভঙ্গ নয়। হিমালয়ঘেরা নেপাল থেকে সাফল্যের চূড়া ছোঁয়ার সুখ নিয়েই ঘরে ফিরছেন সাবিনা, কৃষ্ণা, সিরাত জাহানরা। এবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই নেপালে পাড়ি জমিয়েছিলেন সাবিনারা। নিজেদের স্বপ্নের কথা তারা প্রকাশও করেছিলেন।

কিন্তু স্বপ্ন সত্যিই সত্যিই বাস্তব হয়ে ধরা দেবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কাও ছিল। শঙ্কা থাকাটা স্বাভাবিকও ছিল। কারণ, মেয়েদের সাফ ফুটবল সবচেয়ে বড় শক্তি ভারত। মেয়েদের সাফে আগের ৫ আসরেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা। কখনো শিরোপা না জিতলেও এবারের আয়োজক নেপালও সাফ অঞ্চলে অন্যতম পরাশক্তি।  

দক্ষিণ এশিয়ার এই টুর্নামেন্টে আগের ৫ আসরের মধ্যে ৪ বারই ফাইনালে খেলেছে তারা। বিপরীতে বাংলাদেশের মেয়েরা ফাইনাল খেলেছিল মাত্র একবার। তার চেয়েও বড় কথা, মুখোমুখি সাক্ষাতে নেপালের জাতীয় দলের মেয়েদের বিপক্ষে কখনোই জয় পায়নি বাংলাদেশের মেয়েরা। সাফে আগের তিন সাক্ষাতেই নেপালের কাছে হার মানতে হয়েছিল।

সাফ, এসএ গেমস ও অলিম্পিক বাছাই মিলিয়ে আগের ৮ সাক্ষাতের মধ্যে ৬ বারই জয়ী নেপাল। বাকি দুটি ম্যাচ হয় ড্র। বাংলাদেশের মেয়েরা জয়ের মুখ দেখেনি কখনোই। সেই নেপালই ছিল ফাইনালের প্রতিপক্ষ। ফাইনালটাও ছিল নেপালের ঘরের মাঠে। নেপাল এগিয়ে ছিল ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়েও। র‌্যাঙ্কিংয়ে নেপাল ১০২ নম্বরে, বাংলাদেশ ১৪৭।

কাজেই ফাইনালে ওঠার পরও আরও একবার তীর থেকে ফেরার শঙ্কা ছিলই। তবে শঙ্কার চেয়েও আশাটা বড় ছিল। ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। হিমালয় সমান সেই প্রত্যাশার পারদে রঙ লাগে গ্রুপপর্বে মহাশক্তিশালী ভারতকে প্রথম বারের মতো হারানোর পর। ভারতকে হারাতে পারলে নেপালকে কেন নয়, এই মন্ত্রটাই সাবিনাদের চিন্তা-মননে গেঁথে দিয়েছিল-পারব।

সাবিনারা পেরেছেন। কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথম বারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের মেয়েরা। সাবিনা-সানজিদাদের মতো শিরোপা স্বপ্নে বিভোর ছিল বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষও। ফাইনালে উঠার পর গত তিনদিন ধরে ফাইনাল ঘিরে আলোচনা ছিল তুঙ্গে। সবাই প্রচণ্ড আশাবাদী মনোভাব নিয়ে তাকিয়ে ছিল কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামের দিকে।

দেশবাসী আশার সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছিল দোয়াও।  সবারই কায়মনো প্রার্থনা ছিল, সাবিনারা যেন চ্যাম্পিয়ন হতে পারে। সাবিনারা হতাশ করেননি। বরং দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের মধ্যদিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থায় জীবন-যাপন করা দেশবাসীকে উপহার দিয়েছে অন্য রকম এক তৃপ্তি-সুখ। ভাসিয়েছেন শিরোপা আনন্দে। যে জয়ের নায়ক কৃষ্ণা রানী সরকার ও শামসুন্নাহার জুনিয়র। কৃষ্ণা করেছেন ২ গোল, একটি শামসুন্নাহার।

চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নে ফাইনালে বাংলাদেশের মেয়েদের শুরুটা ছিল দারুণ।  তার ফলও পায় দ্রুতিই। ম্যাচের ১৪ মিনিটেই বাংলাদেশ পেয়ে যায় লিড। দারুণ এক গোল করে দলের শিরোপা স্বপ্নে রঙ লাগান বদলি হিসেবে শামসুন্নাহার।

তার আগে অবশ্য বড় একটা ধাক্কা লাগে বাংলাদেশ শিবিরে। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সিরাত জাহান স্বপ্না ম্যাচের ১০ মিনিটেই চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। সেমিফাইানালেও চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। শঙ্কা থাকলেও ফাইনালে ঠিকই তাকে একাদশে রাখেন কোচ গোলাম রব্বানি। কিন্তু কাদায় পা পিছলে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। তার বদলি হিসেবে নেমে ৪ মিনিটের মাথায়ই গোল পেয়ে যান শামসুন্নাহার।

গোল খেয়ে স্বাগতিক নেপাল যেন জেগে উঠে। গোল পরিশোধের আশায় চেপে ধরে বাংলাদেশকে। পরিস্থিতি বুঝে বাংলাদেশও দ্রুতই নিজেদের খেলার কৌশল পাল্টে ফেলে। আক্রমণাত্মক মনোভাব থেকে সরে এসেছে অনেকটাই রক্ষণাত্মক খেলা শুরু করে। কৌশলটা কাজে দিয়েছে দারুণভাবে।

প্রতিপক্ষের আক্রমণ সামলানোর পাশাপাশি পেয়ে যায় দ্বিতীয় গোলের দেখাও।  ৪২ মিনিটে বাংলাদেশের লিডটা ২-০ করেন কৃষ্ণা রানী সরকার। তার এই গোলটা অবশ্য নেপালের এক ডিফেন্ডারের ভুলের পুরষ্কার।

২-০তে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যাওয়া বাংলাদেশ দ্বিতীয়ার্ধেও শুরু করে সাবধানে। গোল করার চেয়ে গোল না খাওয়াকেই প্রাধান্য দেয়। তবে সাবধানতার পরও ৬৯ মিনিটে একটা গোল হজম করতে হয়। ব্যবধান ২-১ করার পর নেপাল হয়তো স্বপ্ন দেখেছিল সমতা ফেরানোর। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন গুড়িয়ে দিয়েছেন কৃষ্ণা।

নিজের দ্বিতীয় গোলটি করে তিনি নিশ্চিত করেন বাংলাদেশের জয়। নিশ্চিত করেন সাফ চ্যাম্পিয়নের মুকুট।  বাংলাদেশের নামটা লেখা হয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়। অস্থিরতার জীবনে দেশের মানুষ পায় স্বস্তির কোমল পরশ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //