জয়া চাকমা এক সব্যসাচীর গল্প

ছোটবেলায় ‘প্রিয় খেলা’ ফুটবলের পাশাপাশি হ্যান্ডবল ও ক্রিকেট সমানতালে খেলতেন। এরপর ভালো খেলেন বলে শেষ পর্যন্ত ফুটবলকে বেছে নিলেন। আর এখন তো নিজেকে দিনে দিনে প্রত্যাশার চেয়ে বড় জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। বিচরণ করছেন খেলাধুলার একাধিক জগতে। বলা হচ্ছিল জয়া চাকমার কথা।

বর্তমানে একই সঙ্গে ফুটবলের রেফারি ও কোচ হিসেবে কাজ করছেন। এরই মধ্যে ফিফা রেফারি হিসেবে সর্বশেষ দুই বছর কাজ করেছেন। যদিও এখনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার মতো সুযোগ ঘটেনি। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়িয়েছে তার এই অপেক্ষার জটিলতা। এখন ভারতের বেনারসে ফিজিকাল এডুকেশনের উপর উচ্চতর পড়াশোনা করছেন বাংলাদেশের প্রথম এই নারী রেফারি। এছাড়া বাংলাদেশের খেলোয়াড় তৈরির সূতিকাগার বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) মেয়েদের ফুটবল কোচ হিসেবে কাজ করছেন। সব মিলিয়ে একজন জয়া চাকমা নারী খেলোয়াড়দের জন্য অনুকরণীয় হয়ে আছেন। তাকে দেখে রেফারিংয়ে যেমন মেয়েরা আসছেন, ঠিক তেমনি কোচিংয়ে। তাই তো জয়াকে বিশেষ একজন হিসেবেই অভিহিত করছেন ক্রীড়াসংশ্লিষ্টরা। তবে সর্বশেষ ফিফা রেফারি হিসেবে পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারেনি। সেই হতাশা কাটিয়ে আবারও নতুন করে নিজেকে তৈরি করতে চাইছেন। এখন অপেক্ষা সেই সময়ের।

নারী রেফারিংয়ে পথ দেখালেন জয়া

২০১০ সালে অনেকটা হঠাৎ করেই রেফারিং পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো বড় ঝুঁকি নেন জয়া চাকমা। শুরুতে ঘরোয়া আসরের বিভিন্ন ম্যাচ পরিচালনার পর হন ফিফা রেফারি। পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে দেশে ও দেশের বাইরে পরিচিত করিয়েছেন। মাঠে বাঁশি বাজিয়েছেন সুনামের সঙ্গে। জয়ার দেখিয়ে দেওয়া পথে এরপর আসেন সালমা ইসলাম মনি। ২০১৯ সালে জয়া চাকমার সঙ্গে ফিফা রেফারি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বয়সের সীমাবদ্ধতার কারণে রেফারি হতে পারেননি। এরপর আর পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে না নেত্রকোনা থেকে উঠে আসা এই রেফারির। ২০২১ সালের জন্য প্রথমবারের মতো ফিফা রেফারি হওয়ার জন্য আগেই বড় বাধা পেরিয়েছেন মনি। এরপর স্বীকৃতি পেয়েছেন। গত বছরের জন্য জয়া চাকমার সঙ্গে একই সঙ্গে মাঠে রেফারিং করতে পারবেন। তবে জয়া চাকমা আবারও মূল রেফারি হওয়ার জন্য উত্তীর্ণ হলেও সালমা ছিলেন সহকারী হিসেবে, এক বছর কাজ করেছেন। গত বছরের জানুয়ারিতে সালমার বয়স ২৩ বছর হয়েছে। ফিফার মূল রেফারি হতে গেলে অন্যূন ২৫ বছর বয়স হওয়ার প্রয়োজন। তাই সালমা আপাতত সহকারী রেফারি হয়েই খুশি, বিশেষ করে জয়ার দেখানো পথে এগিয়ে যেতে পারায়। 

কোচিংয়ে বিকেএসপিকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন

রেফারি হওয়ার পাশাপাশি কোচিংয়ে নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন জয়া। নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারটাকে পরিপূর্ণ করতে পারেননি নানা সমস্যার কারণে। এরপরই মাঠের বাইরে থেকে নিজেকে শানিয়ে ফিরতে থাকেন। যার সূত্র ধরে বিকেএসপিতে মেয়েদের দলের কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। সেখানে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরে বেশ খুশি জয়া। ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। একজন রেফারি হয়ে নিজেকে পরিচিত করার পর কোচিং ক্যারিয়ারের দিকে মনোনিবেশ করেন। জয়া বিকেএসপির নারী ফুটবলের কোচ হিসেবে কাজ করছেন। খেলোয়াড় তৈরির এই প্রতিষ্ঠানটিতে নারী ফুটবল দল ভারতে ‘সুব্রত মুখার্জি গোল্ডকাপ’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তিনি সেরা কোচেরও পুরস্কার লাভ করেন; যা কোনো বাংলাদেশি কোচ অর্জন করতে পারেনি। আর তাতেই রেফারিংয়ের পাশাপাশি কোচিংয়েও অনুকরণীয় হয়ে যাচ্ছেন জয়া।

নতুনদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস

নারী রেফারিদের জন্য চলার পথটা এতটা মসৃণ ছিল না। যেখানে খেলাটাই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বন্দি, সেখানে রেফারি কিংবা কোচ হওয়াটাও কম চ্যালেঞ্জের ছিল না। সেখানেই ধীরে ধীরে নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন জয়া চাকমা। সে কারণেই বলা যায়, এ যেন নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি, এ যেন অচলায়তন ভাঙার গান গাওয়া শুরু করে দিয়েছেন তিনি। নারী রেফারি হিসেবে দেখা স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হয়েছে অনেকেরই। জয়ার দেখিয়ে দেওয়া পথে বাংলাদেশের পেশাদার ফুটবলে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে সালমা ইসলাম মনি ছেলেদের ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। গত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলের (বিপিএল) উত্তর বারিধারা-আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের ম্যাচটাকে বেছে নিয়েছেন মাইলফলক অর্জনের জন্য। আর কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম বিরল এই কৃতিত্বের সাক্ষী হয়ে রইল আজীবনের জন্য। 

কঠিন পরীক্ষা দিয়ে রেফারি হিসেবে উত্তীর্ণ হতে হয়

প্রতিবছরই নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ফিফায় নিজেকে প্রমাণ করতে হয় রেফারিদের। এর আগে ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফিফার নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা দিতে হয়েছে জয়া চাকমাকে। তার পাশাপাশি সালমা ইসলাম মনিও ৪ হাজার মিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। এছাড়া আরও কিছু কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। প্রয়োজনীয় এসব পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন জয়া আর সালমা। 

জয়ার অপরাজিতা ২০২১ সম্মাননা লাভ

খেলোয়াড় থেকে কোচ এরপর রেফারি, সবখানেই যেন আলোচনায় থাকছেন জয়া চাকমা। এখনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাঁশি বাজানোর সুযোগ না ঘটলেও দেশে সম্মাননা পেয়েছেন। ‘অপরাজিতা’ সম্মাননা পেয়ে নিজের কাজের আরও একটি স্বীকৃতি লাভ করলেন। আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১০ বিশিষ্ট নারীকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সম্মাননাপ্রাপ্তদের হাতে পদক তুলে দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে এই সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গত বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আমিন জুয়েলার্স ও বাঘবাংলা এন্টারটেইনমেন্টের আয়োজনে ‘অপরাজিতা-২০২১’ সম্মাননা প্রদান করা হয়। এমন সম্মাননা পেয়ে বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি জয়া চাকমা বলেন, ‘কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এই সম্মাননা পাওয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছি। এ ধরনের একটি পুরস্কার আমাকে ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা জোগাবে। আমি যে এত দিন কষ্ট আর পরিশ্রম করেছি তার একটা স্বীকৃতি এটা।’ 

জয়া বাংলাদেশের মেয়েদের খেলাধুলায় অনন্য একটি নাম হয়ে আছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের মুহূর্তে মেয়েদের খেলাধুলায় প্রতিবন্ধকতা কিছুটা কমলেও এখনো পুরোপুরি নিরাপদ আর সুরক্ষিত নয়। সমাজের বাকি পেশাগুলোর চেয়ে একটু বেশিই আড় চোখে তাকানো হয়ে থাকে নারী খেলোয়াড়দের প্রতি। এসব নিয়ে না ভেবে বরং নিজেকে নিয়ে ভাবতেই বেশি পছন্দ করে থাকেন তারা। অনেকে আবার পরিবার থেকে উৎসাহ পেলেও বাইরের কারও কাছ থেকে সেভাবে সহায়তা পান না। এত নেতিবাচকতার মধ্যেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় সকল খেলাতেই এখন নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে জয়া চাকমাকে। মেয়েদের ফুটবলে রেফারি হিসেবে এরই মধ্যে ফিফা থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে জয়া আর মনিকে সহকারী রেফারি হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ। ফিফা থেকে অনুমোদন পেলেও ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ এখনো পাননি এ দুজন। জয়া চাকমা ২০১৯ সালেও পাস করেছিলেন। এবারও সে ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় রেফারি হিসেবে তার নাম ফিফায় পাঠানো হয়। 

দেশের প্রথম নারী রেফারি হলেও করোনা ভাইরাসের কারণে এখনো ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পাননি জয়া। ফিফার রেফারি হওয়ার যোগ্যতা সবার থাকে না। চেষ্টা করেও অনেকে তা করতে পারেন না। তবে মনের প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে যে অসম্ভব অনেক কিছুই সম্ভব করা যায় সেটি নানা সময় ক্রীড়াঙ্গনে প্রমাণ হয়ে থাকে। যেমন করে আবারও হলো বাংলাদেশের দুই রেফারির কল্যাণে। জয়া চাকমা এখন অপেক্ষায় রয়েছেন ফিফা থেকে ম্যাচ পরিচালনার সুযোগের অপেক্ষায়। জয়া খেলোয়াড় থেকে কোচ হওয়ার পর সবশেষ হয়েছেন রেফারি। জয়া খেলোয়াড় হিসেবে মাঠ মাতানোর পর ২০১০ সালে রেফারিং জগৎকে নিয়েছিলেন আপন করে। নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার এ লড়াইয়ে এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জয়াকে। লেভেল ৩, ২ ও ১ কোর্স করে জাতীয় রেফারি হয়েছেন আগেই। এবার সফলতার ধারাবাহিকতা ধরে রেখে ফিফা রেফারি হওয়ার ফিটনেস টেস্টে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এর আগে গত বছর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফিফার নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা দিতে হয়েছে তাদের। দুজনই ৪ হাজার মিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। এছাড়া আরও কিছু কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। পথটা যে মোটেও মসৃণ ছিল না সে কথা বলাই যায়। 

জয়া যেভাবে ইচ্ছে নিজেকে সেভাবে তৈরি করতে পেরেছেন। কিন্তু দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ফিফা রেফারি হতে গিয়ে একই সমান্তরালে থেকে লড়াই করতে হয়েছে। খেলোয়াড় হিসেবে মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর সঙ্গে ২০১০ সালে রেফারিংকে আপন করে নিয়েছিলেন জয়া চাকমা। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে। লেভেল ৩, ২ ও ১ কোর্স করে জাতীয় রেফারি হয়েছিলেন আগেই, এখন তিনি দেশের প্রথম নারী ফিফা রেফারি। সেটা পরীক্ষা দিয়ে হয়েছেন। দুই বার ফেল করার পর নিজের মনের জোরেই এত দূর আসতে পেরেছিলেন। রাঙামাটির মেয়ে জয়ার উঠে আসার গল্পটা তাই একটু অন্যরকম। নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে করতে স্বপ্ন দেখেছিলেন ফিফা রেফারি তাকে হতেই হবে। অবশেষে হয়েছেনও। 

জেদ থেকেই সাফল্যের পথে জয়া

২০১৩ সালে বয়সভিত্তিক আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করতে শ্রীলংকায় যাওয়ার পর দেখেন বিভিন্ন দেশের নারী রেফারিরা আছেন। নিজের মধ্যে জেদ চাপে, যে করেই হোক সাফল্যের চূড়ায় যেতে হবে। তখন থেকেই ফিফা রেফারি হওয়ার জন্য সাধনা শুরু করেন জয়া। দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ফিফা রেফারি আছেন চারজন। যার মধ্যে ভারতের দুজন এবং নেপাল ও ভুটানের একজন করে। তালিকায় পঞ্চম নামটি ছিল জয়ার। রাঙামাটির হয়ে চার বছর বয়সভিত্তিকের পাশাপাশি জাতীয় দলে খেলেছেন, ২০১৬ সাল পর্যন্ত খেলেছেন বিজেএমসির হয়ে। এর মধ্যে রেফারিংয়ের পাশাপাশি নাম লেখান কোচিংয়েও। এএফসি ‘বি’ লাইসেন্স করে এখন বিকেএসপির নারী দলের কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তার অধীনে ভারতে সুব্রত মুখার্জি আন্তর্জাতিক ফুটবলের শিরোপা জিতেছে বিকেএসপির মেয়েরা। অলরাউন্ডার জয়া, খেলার সঙ্গে লেখাপড়াও চালিয়ে গেছেন পুরোদস্তুর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে করেছেন মাস্টার্স, ডিপ্লোমা আছে স্পোর্টস সায়েন্সের উপরও। এবার যোগ হতে চলেছে ফিফা রেফারির তকমা; যা সূচনা করছে এক নতুন দিগন্ত। 

শেষ পরীক্ষায় ভয়ে ছিলেন জয়া

করোনার মধ্যেই ভারতের বেনারসে ফিজিক্যাল এডুকেশনের উপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে পড়াশোনা করছেন বাংলাদেশের প্রথম নারী রেফারি জয়া চাকমা। এরই মধ্যে গত আগস্টে এএফসির এলিট রেফারিদের প্যানেলে ঢুকতে জামশেদপুরে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সেখানে পাস করলে আন্তর্জাতিক ম্যাচ পেতে সহজ হবে। কিন্তু সেই পরীক্ষায় শুরুতে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ভেঙে পড়া জয়ার মনের কোণে ভয় জমে যায়, এই বুঝি রেফারিং ক্যারিয়ারটা শুরু না হতেই শেষ হয়ে গেল! এরই মাঝে ঢাকায় এসে অনেকটা ভয়ে ভয়ে ২০২২ সালের জন্য নতুন করে ফিফা রেফারি হওয়ার পরীক্ষায় বসেছিলেন। পরীক্ষায় পাস না করলে যে আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার জন্য প্রাথমিক যোগ্যতা হারাবেন, ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ে যাবে, এমন আশঙ্কাতেই ছিলেন। আশার কথা এবার সেই পরীক্ষায় সফলও হয়েছেন। এরই সঙ্গে ফিরে পেয়েছেন নতুন করে হারিয়ে ফেলা পথচলার আত্মবিশ্বাস। এ যেন একই সঙ্গে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ কঠিন পরিস্থিতিতে দেখা। পথচলায় নতুন করে রসদ পেয়ে রাঙামাটি থেকে উঠে আসা জাতীয় দলের সাবেক এই ফুটবলার বলেন, ‘মূলত করোনা ভাইরাসের কারণে খেলা কম থাকায় নিজের ফিটনেস সেভাবে মেইনটেইন করা হয়নি। জামশেদপুরে খারাপ করে নিজের মধ্যে ভয়ও ঢুকে গিয়েছিল। আমার রেফারিংয়ের ক্যারিয়ার এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল! আশা অনেকটা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তবে ঢাকায় ভালো করে আবারও এখন স্বস্তি ফিরে এসেছে।’ 

ফিফা-এএফসির নিজস্ব ম্যাচ পরিচালনা করতে শুধু ফিফা রেফারি হলেই চলবে না, জায়গা করে নিতে হবে এএফসির এলিট প্যানেলের দলের মধ্যেও। দীর্ঘদিন পর এবারই অনেক দিন পর এএফসি থেকে এলিট প্যানেলে প্রবেশের সুযোগ এসেছিল। কিন্তু শুরুতে জয়া পারেননি সেখানে জায়গা করে নিতে। এছাড়া প্রতিবছর ফিফা স্বীকৃত রেফারি হতে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়, যা গেল দুই বছর দিয়ে এসে পাসও করেছেন এই খর্বকায়। একই সঙ্গে সফলতা ও ব্যর্থতা দেখেছেন ২৯ বছর বয়সী জয়া চাকমা, ‘ভারতের জামশেদপুরের উচ্চতর কোর্স করার সময় পরীক্ষাতে এলিট রেফারি হতে পারেননি। ফেল করে আত্মবিশ্বাস কিছুটা হলেও কমে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল ঢাকার ফিফা রেফারি হওয়ার পরীক্ষাতেও বুঝি আর পাস করতে পারব না। ক্যারিয়ার বুঝি শেষই হয়ে যাবে। বয়স হয়ে যাচ্ছে, সেটাও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল! এখন পাস করে কিছুটা হলেও স্বস্তি লাগছে। অন্তত আরও এক বছরের জন্য ফিফা রেফারি হতে পেরেছি, যা বেশ তৃপ্তির।’ 

যদিও এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক ঘটানোর সুযোগ হয়নি জয়ার। ১২ বছরের ক্যারিয়ারে এএফসির বয়সভিত্তিক একাধিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। কিন্তু সিনিয়রদের ম্যাচ এখনো অধরা হয়ে আছে তার জন্য। এ নিয়ে আক্ষেপ কম নয় জয়া চাকমার, ‘ভাবলে অনেক কষ্ট দেয়। আক্ষেপও আছে তাই কিছুটা। তবে বৈশ্বিক দিক চিন্তা করলে দেখা যাচ্ছে আমি তো একা ভুক্তভোগী নই। অনেকেই আছেন। করোনা ভাইরাসের সময়ে টিকে থাকার লড়াই এখনো চলছে। তবে রেফারিং না করতে পেরে একটু খারাপই লাগছে।’ একই সঙ্গে সমানতালে জয়া রেফারিং, বিকেএসপিতে মেয়েদের ফুটবল কোচিং ও পড়াশোনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক কষ্ট হলেও রুটিন করে কঠিন সবকিছুই চালাতে হচ্ছে তাকে। 

পাহাড়ি ফুল ফোটানোর নেতৃত্বে জয়া

ফুটেছে পাহাড়ি ফুল, আর হেসেছে বাংলাদেশ। এভাবেই সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের তিন পার্বত্য জেলার মেয়েরা উঠে আসছে। জয়া চাকমা তাদেরই একজন। যদি বলা হয় তিনি নেতৃত্বও দিচ্ছেন তাহলে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না। শুরুতে খেলোয়াড় হিসেবে আর এখন কোচ ও রেফারি হিসেবে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য উচ্চতায়। যেখানে পথ দেখিয়ে চলেছেন জয়া। মাঠভর্তি সমর্থকদের সামনে উজ্জীবিত হয়ে খেলেছে লাল সবুজের দেশ। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ভারত হলেও সাহস সঞ্চার করে আধিপত্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। তাতে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবলের প্রথম শিরোপাও ঘরে তুলেছে গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যরা। দলের রক্ষণের অন্যতম স্তম্ভ আনাই মোগিনির একমাত্র গোলে রচিত হয়েছে এই ইতিহাস। তাতেই হেসেছে পুরো বাংলাদেশ। তবে আনাই যখন খেলছিলেন, তার খেলা টেন্টে বসে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন কয়েক মিনিটের যমজ ছোট বোন আনুচিং মোগিনি। ফাইনালে ইনজুরিতে পড়ার কারণে খেলা হয়নি এই ফরোয়ার্ডের। তারপরও স্কোয়াডে থেকে এই বিজয়গাথার অন্যতম অংশীদারও হয়েছেন তিনি। তবে বড় দিদির গোলে বাংলাদেশ জেতায় অন্যরকম ভালো লাগাও কাজ করেছে মনের মাঝে। সে হিসেবে পুরো দেশ ভেসেছে আনন্দ-উল্লাসে। দারুণ এই কীর্তির পর আনুচিংয়ের উচ্ছ্বাস আর আনন্দ দেখে কে! বয়সভিত্তিক কিংবা জাতীয় দলে রক্ষণভাগের অন্যতম অস্ত্র এই আনাই মোগিনি। ওভারল্যাপ করে উপরে উঠে খেলতে তিনি খুব সিদ্ধহস্ত। 

আর তাতে প্রায়ই প্রতিপক্ষকে ভড়কে দিতে পারেন। কোচের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন দলকে সামনে থেকে জিতিয়ে। অথচ একসময় দুই যমজ বোনের পরিবার ছিল অভাব-অনটনে ভরা। ফুটবল খেলেই সেই অভাব এখন প্রায় দূর হয়েছে বলা চলে। তাই আনাই-আনুচিংয়ের বাবা রিপ্রু মগের আনন্দ যেন অনেকটাই বাঁধভাঙা হয়ে আছে। ২০১১ সাল থেকে বঙ্গমাতা ফুটবল দিয়ে দুই যমজ বোনের পথচলা শুরু। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। বয়সভিত্তিক দলসহ জাতীয় দলেও সরব পদচারণা দিয়ে তারা মান রেখে চলেছেন। এই পথচলাতেই পাহাড়ি কন্যাদের শতদল মেলে ফুটে ওঠা। সৌরভ ছড়ানো পারফরম্যান্সে দুজনের স্বপ্ন আরও বহুদূর চলে গেছে। সামনে জাতীয় দলের হয়েও সাফল্য পেতে চাইছেন তারা। আনন্দের উপলক্ষ এনে দিতে চাইছেন আরও বেশি। হয়তো সেদিনও বেশি দূরে নয়, তখনো হাসবে পুরো বাংলাদেশ।

যেভাবে রেফারিং শুরু

ইনজুরির কারণে নিজের ক্যারিয়ারটাকে প্রত্যাশামতো এগিয়ে নিতে পারেননি। যার সূত্র ধরে ২০১০ সালে রেফারিংয়ে মনোনিবেশ করেন। ২০১২ সালে দল থেকে বাদ পড়ার পর কিছুকাল বিজেএমসিতে চাকরিও করেন। একই বছর বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে নিয়মিত রেফারিং শুরু তার। এরপর শ্রীলংকা, নেপাল ও তাজিকিস্তানে একে একে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপ পরিচালনার দায়িত্ব পান। আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে তিনি ২০২১ সাল পর্যন্ত অন্তত ১২ বছর ধরে রেফারিং করেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে জার্মানির বার্লিনে আন্তর্জাতিক ফুটবল উৎসবে ১০টি ম্যাচ পরিচালনা করেন। ২০১৯ সালে ঢাকায় সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টের দুটি ম্যাচে রেফারিং করেন। এছাড়া ভারতের সুব্রত কাপে, নেপাল-ভুটান, এমনকি এশিয়ার বাইরে ইউরোপে গিয়েও দায়িত্ব পালন করেছেন জয়া। লেভেল ৩, ২ ও ১ কোর্স শেষ করে বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের রেফারি হন। পরে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা রেফারি হওয়ার ফিটনেস টেস্টে উত্তীর্ণ হন।

জয়ার জায়গা মেলেনি ফিফার এলিট প্যানেলে

নিয়ম মেনে প্রত্যেকটা দেশের ফিফা তালিকাভুক্ত রেফারিদের এলিট প্যানেলে প্রবেশের জন্য নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। ফিফায় বাংলাদেশের একমাত্র নারী ফুটবল রেফারি জয়া চাকমা অনেক চেষ্টা করেও নিজের নাম এলিট প্যানেলে তুলতে পারেননি। সম্প্রতি জয়া এএফসি এলিট প্যানেলের জন্য বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পরীক্ষার পরদিনই এএফসিতে ফল পাঠানোর বাধ্যবাধকতা ছিল। এলিট প্যানেলের পরীক্ষার অনলাইন ও আগের কয়েকটি ধাপে বেশ ভালোমতোই পাস করেছিলেন তিনি। সর্বশেষ ফিটনেস পর্বের তিনটি অংশ থাকে। সেই তিন অংশের প্রথম দুটি সংক্ষিপ্ত রানিং ও স্প্রিন্ট উতরে গেলেও ৪০০ মিটারের অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকে দশটির বেশি চক্কর দিতে পারেননি জয়া। ৬ চক্করেই থেমে যাওয়ার পর এএফসি এলিট প্যানেলে যাওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো তার। এখন এশিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থাটিতে পরীক্ষা দিয়ে এলিটে প্রবেশ করতে হলে আরও একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে। 

কিন্তু এই ব্যর্থতাটাকে যেন মেনে নিতে পারছেন না। কষ্ট নিয়েই আবারও ভারতে ফিরে যেতে হয়েছে। ফুটবলকে ধ্যান জ্ঞান মেনে খেলাটিকে ভালোবেসেছিলেন জয়া চাকমা। ছোটবেলায় ‘প্রিয় খেলা’ ফুটবলের পাশাপাশি হ্যান্ডবল ও ক্রিকেট সমানতালে খেলতেন। এরপর ভালো খেলেন বলে শেষ পর্যন্ত ফুটবলকে বেছে নিলেন। আর এখন তো নিজেকে দিনে দিনে প্রত্যাশার চেয়ে বড় জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। বিচরণ করছেন খেলাধুলার একাধিক জগতে। বর্তমানে একই সঙ্গে ফুটবলের রেফারি ও কোচ হিসেবে কাজ করছেন। এরই মধ্যে ফিফা রেফারি হিসেবে দুই বছর ধরে কাজ করছেন। যদিও আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার মতো সুযোগ ঘটেনি। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়িয়েছে তার এই অপেক্ষার জটিলতা। এখন ভারতের বেনারসে ফিজিকাল এডুকেশনের উপর উচ্চতর পড়াশোনা করছেন বাংলাদেশের প্রথম এই নারী রেফারি। এছাড়া বাংলাদেশের খেলোয়াড় তৈরির সূতিকাগার বিকেএসপি মেয়েদের ফুটবল কোচ হিসেবে কাজ করছেন। সব মিলিয়ে একজন জয়া চাকমা নারী খেলোয়াড়দের জন্য অনুকরণীয় হয়ে আছেন। তাকে দেখে রেফারিংয়ে যেমন মেয়েরা আসছেন ঠিক তেমনি কোচিংয়ে। 

পরাজয়ে ভীত না হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চান

এখন জয়া চাকমার জন্য অপেক্ষা কিছুটা হলেও বেড়েছে। তবে এসব নিয়ে না ভেবে সামনের সময়গুলোতে কীভাবে স্বপ্নটা পূরণ করা যায় সেটাই দেখছেন। একটা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলেও সামনে যে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে সেটা মেনেই এই সময়গুলোকে কাজে লাগাতে চাইছেন। একটা স্বপ্ন পূর্ণ হতে কিছুটা সময় লাগলেও ভারতে কোর্সটা সম্পন্ন করে নিজেকে নিয়ে নতুনভাবে শুরু করতে চান। কারণ সর্বশেষ দুইবার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে নতুনভাবে শুরুর কোনো বিকল্প নেই। পরাজয়ে হতাশ না হয়ে নতুন করে শুরু করতে চান। যেখানে কোচ হিসেবে সফলতা পেয়েছিলেন এবার রেফারি হিসেবেও দেশের মান উজ্জ্বল করতে চান; যা তাকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সহায়তা করবে বলেই মনে করছেন। নতুন শুরুর বিষয়ে জয়া বলেন, ‘একজন ক্রীড়াবিদকে খেলা থেকে শুরু করে অনেক ধরনের চড়াই-উতরাই পার হতে হয়। আমার এসবে অভ্যস্ততা রয়েছে। সে কারণে ফিফা রেফারি হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে ব্যর্থতার পরও ভেঙে পড়িনি। কারণ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা না নিলে জীবনের বাকিটা সময় কীভাবে কাটাব? সামনে যে পরীক্ষা হবে সেটার অপেক্ষা করছি। আশা করছি ভালো কোনো খবরই দিতে পারব।’ জয়ার জন্য সবার শুভকামনা রয়েছে। যেখানে নিজেকে পুরনো রূপে ফিরে পেতে চান। নিজে জানেন পথটা মসৃণ হবে না, তবু হাল ছেড়ে না দিয়ে বিজয়ীর বেশেই ঘরে ফিরতে চান। 


সাক্ষাৎকার ও গ্রন্থনা : মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //