রেফারিদের গাইড ও কো-অর্ডিনেটর শিয়াকত আলী

দরজায় কড়া নাড়ছে কাতার বিশ্বকাপ। বাংলাদেশ দল হিসেবে অংশগ্রহণ না করলেও অনেকভাবেই থাকছে। যার মধ্যে অগ্রগণ্য বলা যেতে পারে শিয়াকত আলীকে। একজন টেকনিক্যাল কর্মকর্তা হিসেবে এশিয়ার একক কোন দেশে প্রথমবার বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখতে চাইছেন। 

তবে বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই এই সর্ববৃহৎ ফুটবল আসরের সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা খোঁজার চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলোতে বিশ্বকাপের জার্সি বানানো নিয়ে। এখন অবশ্য অন্যভাবে সরাসরি বিশ্বকাপের মাঠেই থাকেন বাংলাদেশিরা। 

এবারের কাতার বিশ্বকাপে রেফারিংয়েও আছে লাল সবুজ প্রতিনিধিত্ব। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে মেডিক্যাল কমিটিতে ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি। চারবছর আগের সেই আসরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পাওয়া যায় দুই বাংলাদেশিকে। এর আগে ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে ছিলেন বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা। রাশিয়া বিশ্বকাপে শুভেচ্ছা দূত ছিলেন বর্তমান ফিফা কাউন্সিল মেম্বার, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও মহিলা উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ। আর এবার প্রথমবারের মতো কাতার বিশ্বকাপে রেফারিদের গাইড ও কো-অর্ডিনেটরের ভূমিকায় দেখা যাবে শিয়াকত আলীকে।

এ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই অবস্থা। কারণ এই শিয়াকত ২০১৩ সালে কাতারে গিয়েছিলেন একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে। সময়ের বিবর্তনে মাত্র ৯ বছরের মাথায় তিনি এখন কাতারের প্রথম শ্রেণির এলিট সহকারী রেফারি। ২৫০ মতো ফিফা প্রীতিম্যাচে মাঠে ছিলেন বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার এই ছেলে। এর মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস এই সব ক্লাবের বয়সভিত্তিক দলের খেলায় সহকারী রেফারির ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। 

এবার বিশ্বকাপের আগে কাতারে অনুষ্ঠিত নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ফিফা প্রীতিম্যাচের মাঠে পতাকা হাতে ছিলেন শিয়াকত। কাতারের সাথে অন্য দেশের ফিফা প্রীতিম্যাচ হলেও মাঠে নিয়মিত ভাবেই থাকেন তিনি। কাতার পেশাদার লিগের নিয়মিত সহকারী রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শিয়াকত। দেশে স্থানীয় পর্যায়ে শখের বশে মাঝে মধ্যে রেফারিং করতেন শিয়াকত। তবে কাতার যাওয়ার পর সময় কাটাতে বার্সেলোনার একটি প্রজেক্টের খেলা দেখতে মাঠে যান। আর ঠিক তখন মাঠে উপস্থিত রেফারিদের সাথে আলাপকালে শিয়াকত নিজের রেফারিং করার ইচ্ছে রেফারিদের জানালে তারা তাকে কাতার ফুটবল ফেডারেশনের রেফারিজ কমিটির চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।

বাকবদলের এই তো শুরু। তারপর তো এখন ইতিহাসই গড়তে যাচ্ছেন শিয়াকত। কথা মতো সেই যোগাযোগের পরই শিয়াকত আজ মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে বাংলাদেশের গর্বের ধনে পরিণত হয়েছেন। আলোচিত সেই কোর্সে বিদেশীদের মধ্যে একাধিক পরীক্ষায় সব সময়ই প্রথম স্থান অধিকার করেন। যার সূত্র ধরে এবারের বিশ্বকাপে আসা ৩৬ রেফারি, ২৪ জন ভিডিও অ্যাসিসট্যান্ট রেফারি এবং ৬৯ সহকারী রেফারির গাইড হিসেবে কাজের সুযোগ পেয়ে যান তিনি। সাফ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই দায়িত্ব পালনের দোড়গোড়ায় দাড়িয়ে রয়েছেন। শ্রমিকের পর এখন রেফারি হিসেবে গত ১০ বছর ধরে কাতারে রেফারি করছেন শিয়াকত। উল্লাস আর উত্তেজনার কাতার বিশ্বকাপ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কাতারের মাঠ মাতানোর অপেক্ষায় লিওনেল মেসি-ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো-নেইমার জুনিয়র-কিলিয়েন এমবাপ্পেরা। এই বিশ্বকাপে ফুটবল দল হিসেবে বাংলাদেশ না থাকলেও রয়েছে অন্যভাবে। এবার পুরো ফিফা বিশ্বকাপ জুড়ে শিয়াকত থাকবেন বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি হিসেবে। 

চট্টগ্রামে শিয়াকতের নিজ প্রাম মরিয়মনগর ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য রহিমা আক্তার জানান, একজন ফুটবলপ্রেমি হিসেবে কাতার বিশ্বকাপে রেফারিদের কো অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন আমাদের গ্রামের মেধাবী সন্তান শিয়াকত। শিয়াকত ছোটবেলা থেকেই ফুটবলপ্রেমী ছিল বলে আমরা জানি। কিন্তু অর্থাভাবে নিজের খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নটাকে মাটি চাপা দিয়েছেন।

শিয়াকত মরিয়মনগর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ২০১৩ সালে তিনি কাতার গিয়ে কাতার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হন। কাতারেই তিনি ফুটবল রেফারিংয়ের ওপর একাধিক প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর ডিগ্রীও অর্জন করেন। একজন চৌকস রেফারি হিসেবে তিনি এবার কাতার বিশ্বকাপে কো অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে দারুণ খুশি হয়েছেন। এছাড়া শিয়াকত কাতার ফুটবল এসোসিয়েশনের স্থায়ী সহকারী রেফারি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এবার কাতার বিশ্বকাপে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের একক প্রতিনিধি শিয়াকত আলী। 

কাতার বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালন করা নিয়ে শিয়াকত আলী বলেন, আমাকে পাওয়া এই সুযোগ তাকে গর্বিত করেছে। আমি এই সুযোগ পেয়ে দারুণভাবে উচ্ছ্বসিত ও আনন্দিত। বিশ্বকাপের মাঠে থেকে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ কাজে লাগাতে চাই। নিজের মেধা দক্ষতা দিয়ে সফলভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পুরো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করতে চাই। 

ফুটবলে অনেক পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি মাঠে থাকাটাকেই বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //