মহোৎসবে আছে বাংলাদেশও

বিশ্বকাপ উন্মাদনায় কাঁপছে বিশ্ব।। বেড়েছে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে আবিষ্ট বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের চোখ। সবাই অপেক্ষায় আন্তর্জাতিক ফুটবলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আসর ফুটবল বিশ্বকাপের।

দীর্ঘ এক মাস মানুষ বুঁদ হয়ে থাকবে ফুটবলের মাতাল হাওয়ায়। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার ফুটবল কাতারে উপহার দেবে এবারের চ্যাম্পিয়ন দল। সফল আয়োজনে পুরোপুরি প্রস্তুত এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশটি। মরুর দেশের মাঠে ফুটবলের ফুল ফোটাতে প্রস্তুত হচ্ছে দলগুলো।

আয়োজক দেশ আর অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে প্রস্তুত দর্শকও। একটি দেশের বিভিন্ন শহরের ফুটবল ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। একটি চামড়ার গোলক নাচিয়ে দেবে পৃথিবীর প্রতিটি কোণের মানুষের হৃদয়। চার বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপ শুরুর প্রহর গুনছেন কোটি কোটি ফুটবলপিপাসু দর্শক।

বাংলাদেশ বিশ্বকাপের মূলপর্বে না খেললেও এই মহাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাল-সবুজের দেশটির নাম। কারণ বাংলাদেশও বিশ্বকাপ খেলে। মূল বাছাইয়ে খেলতে না পারলেও প্রাক-বাছাই কিংবা গ্রুপ বাছাইপর্বে খেলেছে। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব থেকে অংশ নিয়ে আসছে বাংলাদেশ। যে বাছাইপর্ব হয়েছিল মূলপর্বের এক বছর আগে ১৯৮৫ সালে।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের অভিষেক হয়েছিল ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত মারদেকা কাপে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। এর এক বছর আগে ১৯৭২ সালে গঠন হয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। ১৯৭৪ সালে ফিফা ও এএফসির সদস্য পদ পাওয়ার এক বছর আগেই বাংলাদেশের অভিষেক হয়েছিল আন্তর্জাতিক ফুটবলে। এর এক যুগ পর বিশ্বকাপের বাছাই খেলার সুযোগ পায় লাল-সবুজের দেশ।

কখনো প্রাক-বাছাই, কখনো বাছাইয়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দৌড়টা থেমে যায়, সেটাই বাস্তবতা; কিন্তু বিশ্বকাপ এলে বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনার কমতি থাকে না এক চুলও। বিশ্বকাপে খেলতে না পারার দুঃখটা মনে থাকে না যখন খেলা শুরু হয় মূলপর্বের। বাংলাদেশের দিকে তাকালে বোঝাই যাবে না- এই দেশটি নেই বিশ্বকাপের মূলপর্বে। ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’র মতো আমরা শামিল হই অন্যদের উৎসব-আনন্দে।

চার বছর অন্তর যখন ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ নামের বিশ্বকাপ হাজির হয়, আমরা উৎসেব শামিল হই কোনো না কোনো দেশকে সমর্থন দিয়ে। লাল-সবুজের এই দেশের বেশি মানুষের প্রিয় দল হয় ব্রাজিল, না হয় আর্জেন্টিনা। জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ডেরও আছে অনেক সমর্থক। এবার অবশ্য বিশ্বকাপে নেই সাবেক চ্যাম্পিয়ন ইতালি।

অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর চেয়ে কোনো অংশে কম থাকে না বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনা। কেবল রাত জেগে টিভিতে খেলা দেখে কিংবা পত্রপত্রিকায় বিশ্বকাপ নিয়ে নানা খবর পড়েই থেমে থাকেন না বাংলাদেশের মানুষ, নানা আয়োজনের বিশ্বকাপের উচ্ছ্বাসে রং ছিটায়। দালানের ছাদে, কিংবা গাছের মগডালে প্রিয় দলের পতাকা উত্তোলন, কে কত বড় পতাকা তৈরি করতে পারে তার প্রতিযোগিতায়ও মেতে ওঠে এই দেশের মানুষ।

ফুটবল যে বাঙালির প্রাণের খেলা তার প্রমাণ মেলে চার বছর পর পর বিশ্বকাপ এলে। ফুটবল ভালোবাসে বলেই সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে যেখানেই বিশ্বকাপ হোক, হৃদয় দিয়ে কাছে নিয়ে আসেন সবাই। যেখানেই বিশ্বকাপ হোক সেই মহোৎসবে আমাদেরও থাকে সরব অংশগ্রহণ।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে- বাংলাদেশের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে অভিষেক হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। মাসটি ছিল মার্চ। বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল ইন্দোনেশিয়া। ম্যাচটি হয়েছিল জাকার্তায়। অভিষেক ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল ২-০ গোলে। ১৯৮৫ সালের ১৮ মার্চে জাকার্তা থেকে শুরু করে ২০২১ সালের ১৫ জুন কাতারের দোহা পর্যন্ত বাংলাদেশ খেলেছে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ৫৮টি ম্যাচ। প্রথম ম্যাচটিতে জাকার্তার বিপক্ষে প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে দুই গোল খেয়ে বসে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের মিছিলে বাংলাদেশের শুরুটা হয় হার দিয়ে।

ওই আসরে বাংলাদেশের গ্রুপে আরও ছিল থাইল্যান্ড ও ভারত। হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৬টি ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছিল দুটিতে। দুটি জয়ই বাংলাদেশ পেয়েছিল ঘরের মাঠ ঢাকায়। ২ এপ্রিল ১৯৮৫ সালে হোম ম্যাচে বাংলাদেশ ২-১ গোলে হারিয়েছিল ইন্দোনেশিয়াকে। প্রথমার্ধে বাংলাদেশ ১-০ গোলে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয়ার্ধে ২ গোল দিয়ে ম্যাচ জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে। ৫ এপ্রিল থাইল্যান্ডকে হারিয়েছিল ১-০ গোলে।

১৯৯০ সালের ইতালি বিশ্বকাপের বাছাইয়ে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল থাইল্যান্ড, চীন ও ইরান। হোম ম্যাচে থাইল্যন্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ওই আসরের একমাত্র জয়টি পেয়েছিল বাংলাদেশ। বাকি ৫ ম্যচেই হেরেছিল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা।

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল জাপান, শ্রীলংকা, আরব আমিরাত ও থাইল্যান্ড। খেলা হয়েছিল আরব আমিরাত ও জাপানে। ৮ ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছিল দুইটি। দুইটি জয়ই বাংলাদেশ পেয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকার বিপক্ষে। জাপানের ইয়োকোহামায় অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছিল ১-০ গোলে এবং আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ শ্রীলংকাকে হারিয়েছিল ৩-০ গোলে। প্রথম লেগে আরব আমিরাতের সঙ্গে লড়াই করে ১-০ গোলে হারা ছাড়া বাকি ম্যাচগুলোয় কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রথম ম্যাচে জাপানের কাছে ৮-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ।

ফ্রান্স বিশ্বকাপে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল মালয়েশিয়া, চাইনিজ তাইপে ও সৌদি আরব। খেলা হয়েছিল কুয়ালালামপুর আর জেদ্দায়। এ আসরে মাত্র একটি জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে প্রথম লেগে ৩-১ গোলে হারলেও ফিরতি লেগে বাংলাদেশ জিতেছিল ২-১ গোলে। বাকি ৫ ম্যাচই হেরেছিল বাংলাদেশ।

জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল সৌদি আরব, ভিয়েতনাম ও মঙ্গোলিয়া। সব ম্যাচ হয়েছিল সৌদি আরবে। বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে মঙ্গোলিয়াকে হারিয়েছিল ৩-০ গোলে, ফিরতি ম্যাচটি ড্র হয়েছিল ২-২ গোলে। বাকি চার ম্যাচের মধ্যে ভিয়েতনামের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করেছিল এবং হেরেছিল সৌদি আরবের কাছে ৩-০ ও ৬-০ গোলে, ভিয়েতনামের কাছে ৪-০ গোলে।

জার্মানি ও দক্ষিণ আফ্রিকা-এই দুই বিশ্বকাপেই বাংলাদেশ বাদ পড়ে প্রাক-বাছাই থেকে। দুইবারই প্রাক-বাছাইয়ে প্রতিপক্ষ ছিল তাজিকিস্তান। জার্মান বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাইয়ে বাংলাদেশ দুই ম্যাচই হারে ২-০ গোলে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাইয়ের হোম ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র করে এবং অ্যাওয়ে ম্যাচটি ৫-০ গোলে হেরে যায়।

ব্রাজিল বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্রথম পর্বে বাংলাদেশ খেলেছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। ঢাকায় পাকিস্তানকে ৩-০ গোলে হারিয়ে লাহোরে গিয়ে গোলশূন্য ড্র করে পরের রাউন্ডে ওঠে বাংলাদেশ। পরের রাউন্ডে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল লেবানন। লেবাননের বিপক্ষে বৈরুতে অ্যাওয়ে ম্যাচ হেরেছিল ৪-০ গোলে এবং ঢাকায় হোম ম্যাচ হেরেছিল ২-০ গোলে।

রাশিয়া বিশ্বকাপে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও জর্ডান। এই আসরে বাংলাদেশ একটি ম্যাচ ড্র করে ঢাকায় তাজিকিস্তানের বিপক্ষে ১-১ গোলে। বাকি সব ম্যাচই হেরে যায়। এর মধ্যে আম্মানে বাংলাদেশ ৮-০ গোলের বড় ব্যবধানে হেরেছিল জর্ডানের কাছে। ১৯৯৩ সালে টোকিওতে জাপানের কাছে ৮-০ গোলে হারার পর দ্বিতীয়বার এই ব্যবধানে হারে কোন দলের কাছে।

এবারের কাতার বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল কাতার, ওমান, ভারত ও আফগানিস্তান। এর আগে বাংলাদেশ গ্রুপপর্বে উঠেছিল লাওসকে হারিয়ে। অ্যাওয়ে ম্যাচে লাওসকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। ঢাকায় হোমম্যাচ ড্র করে গোলশূন্যভাবে। গ্রুপপর্বে বাংলাদেশ একটি ম্যাচও জিততে পারেনি। দুটি ম্যাচ ১-১ গোলে ড্র করেছে ভারত ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে।

প্রাক-বাছাই ও বাছাইপর্ব মিলে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৫৮টি ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে জিতেছে ১০ ম্যাচ, ড্র করেছে ৮ ম্যাচ এবং হেরেছে ৪০ ম্যাচ। বাছাইপর্বে বাংলাদেশ কখনো কখনো প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, চীন, ইরান, আরব আমিরাত ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দল।

বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের বড় জয় ৩-০ গোলে। ১৯৯৩ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে, ২০০১ সালে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে এবং ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে এই জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। বড় হার ৮-০ গোলের। ১৯৯৩ সালে জাপানের বিপক্ষে এবং ২০১৬ সালে জর্ডানের বিপক্ষে শোচনীয় এই হার হয়েছিল বাংলাদেশের।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //