ডাগআউটের স্যার’রা

সালটা ১৯৫৪, প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হাঙ্গেরি ও ইংল্যান্ড। তৎকালীন ফুটবলে খুবই জনপ্রিয় তখনকার আর্সেনাল কোচ চ্যাপম্যানের আবিষ্কৃত ডগ ফর্মেশন। ৩-২-২-৩ বা ৩-২-৩-২ ফর্মেশনে সাজানো হতো বলে একে দেখাতো ড এবং গ-এর মতো।

ম্যান টু ম্যান মার্কিংয়ের কারণে প্রায় সব দলের কাছেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেদিন ইংল্যান্ড প্রথাগতভাবেই ডগ ফর্মেশনে খেলতে নামে; কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার পর ইংল্যান্ড আবিষ্কার করে আগের ম্যাচগুলোতে ডগ ফর্মেশনে খেলা হাঙ্গেরির রক্ষণে ৪ ডিফেন্ডার! তাদের দুই পাশের দুই ফুলব্যাক বারবার আক্রমণে উঠছে আবার প্রয়োজনে ডিফেন্সে নেমে আসছে এবং হাঙ্গেরির ৪-২-৪ ফর্মেশন কখনো কখনো ৪-৪-২ এ সুইচ করছে তো কখনো ৪-২-১-৩ এ।

এতে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড বারবার নিচে নেমে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই ম্যান টু ম্যান মার্কিংয়ের পরিকল্পনা করে নামা ইংল্যান্ড পড়ে যায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে, কাকে ছেড়ে কাকে মার্ক করবে! ফল- ম্যাচে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হয় ইংল্যান্ড। 

ম্যাচে হাঙ্গেরির ৪-২-৪ ফর্মেশনটা পরবর্তীতে আধুনিক ফুটবলে হয়ে ওঠে ৪-৪-২ বা ৪-২-২-২। ৪ ডিফেন্ডার নিয়ে এ ফর্মেশনের মূল আবিষ্কারক হাঙ্গেরির কোচ গুস্তাভ সেবেস। ডগ ফর্মেশনে মূলত গতিশীল ফুটবলাররা দারুণ সুবিধা পেতেন। তাই তুলনামূলক কম গতিশীল ফুটবলারদের জন্য নতুন কোনো উপায় ভাবতে থাকেন সেবেস এবং যে উপায়ে একই সাথে চ্যাপম্যানের ফর্মেশনের খুঁতও বের করা যাবে।

ফলস্বরূপ সেবেস ৪-২-৪ ফর্মেশন প্রয়োগ করেন, যা পরবর্তীতে হাঙ্গেরি ফুটবল টিমকে করে তোলে অনেকটা অপরাজেয়। তবে ৪-২-৪ এর সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করে সম্ভবত ব্রাজিল। সেবেসের জাদুকরি এই ফর্মেশনে খেলেই কখনো বিশ্বকাপ জিততে না পারা সেলেসাওরা জিতে নেয় ১৯৫৮, ১৯৬২ এবং ১৯৭০-এর বিশ্বকাপ।

পরবর্তীতে এই ফর্মেশনে আরও অনেক দল বিশ্বকাপে সাফল্য পেলেও সেবেসের হাঙ্গেরি বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। তবে সেবেস ঠিকই তার ফুটবলীয় জ্ঞান আর দর্শন দিয়ে অমর হয়ে আছেন। 

ফুটবলে ইতিহাস খুঁজলে এমন অসংখ্য কারিগরের নাম পাওয়া যাবে। ইয়োহান ক্রুইফ থেকে শুরু করে মার্সেলো বিয়েলসা বা হালের পেপ গার্দিওলা! যুগে যুগে ফুটবলকে নতুন নতুন রূপ দিয়েছেন অসাধারণ সব কোচ, যারা নিজেদের ফুটবলীয় দর্শনে ইতিহাস হয়ে থাকবেন চিরকাল।

এতক্ষণ যে সেবেস বা চ্যাপম্যনের ইতিহাস ঘাটা হলো তার কারণ কাতার বিশ্বকাপ। ফুটবলে কোচকে বলা হয় নিউক্লিয়াস, যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন পুরো দলকে। কাতারেও নিশ্চিতভাবেই দলগুলোর সাফল্য অনেকটা নির্ভর করবে কোচদের ওপর। কাতার বিশ্বকাপেও এমন কিছু কোচ থাকছেন, যারা নিজেদের দর্শন আর কৌশলে মুহূর্তেই ঘুরিয়ে দিতে পারেন ম্যাচের মোড়। এই প্রতিবেদনটা তাদের নিয়েই।

লুইস এনরিকে (স্পেন)

তারকা কোচরা জাতীয় দলে কোচিং করানোতে অনাগ্রহী হলেও লুইস এনরিকে তার ব্যাতিক্রম। স্পেনের দুঃসময়ে হাল ধরেছেন, সম্পূর্ণ তারুণ্যনির্ভর স্পেনকে তুলেছিলেন গত বছর ইউরোর সেমিফাইনাল এবং নেশন্স লিগের ফাইনালে। খেলোয়াড় হিসেবে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলা এনরিকে কোচ হিসেবেও দারুণ সফল। বার্সাকে মাত্র ৩ মৌসুমেই ৯টি শিরোপা জেতানো এনেরিকে ব্যক্তিগতভাবে জিতেছিলেন ২০১৫ সালের বর্ষসেরা কোচের পুরস্কার।

তিনি মূলত দলকে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলিয়ে থাকেন। তবে তার মূল দর্শন- বল পজিশন ধরে রেখে যতটা সম্ভব আক্রমণ করে যাওয়া। এবার যখন মিশন বিশ্বকাপ, এনরিকে ঘোষণা দিয়েছেন- ‘কাতারে বিশ্ব নতুন এক স্পেনকে দেখবে’।

হানসি ফ্লিক (জার্মানি)

হানসি ফ্লিক, ছিলেন ২০০৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত কোচ জোয়াকিম লোর সহকারী। পরে ২০১৯ সালে বায়ার্ন মিউনিখে আবারও সহকারী কোচ হিসেবে ফেরেন তিনি; কিন্তু অফফর্মে ভুগতে থাকা বায়ার্নের ডাগআউট থেকে কোভ্যাক সরে দাঁড়ালে অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব পেয়েই বায়ার্নের আমূল বদলে ফেলেন। প্রথম মৌসুমেই ধুঁকতে থাকা বায়ার্নকে জেতান বুন্দেস লিগা এবং চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো শিরোপা।

তার আক্রমণাত্মক কৌশলে মাত্র ৮৬ ম্যাচে বায়ার্ন করে ২৫৫ গোল। বায়ার্ন তাকে ২০২৩ পর্যন্ত চুক্তির প্রস্তাব দিলেও ফ্লিক তা ফিরিয়ে জার্মান জাতীয় দলে লোর স্থলাভিষিক্ত হন। ৪-৩-৩ কিংবা ৪-২-৩-১ এর মতো অ্যাটাকিং ফর্মেশনে খেলাতে পছন্দ করা ফ্লিকের অধীনে বিশ্বকাপে পাওয়ার ফুটবলের মিশেলে আক্রমণাত্মক জার্মানিকেই পাবে শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

তিতে (ব্রাজিল)

২০১৪-তে মারাকানায় জার্মানির কাছে ৭ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর কোচ দুঙ্গার অধীনে  আরও অবনতি হয় ব্রাজিলের। ২০১৬ সালে দুঙ্গা বরখাস্ত হলে ডাক পান করিন্থিয়ানসের কোচ তিতে। এসেই দলে বেশ কিছু অদল-বদল করে ব্রাজিলকে খেলাতে থাকলেন ইউরোপীয়ান ধাঁচের ফুটবল। এতে রাতারাতি বদলে যাওয়া ব্রাজিল ২০১৮ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলার পর জিতে নেয় ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকার শিরোপা।

তিতের অধীনে ব্রাজিল কাতার বিশ্বকাপের সবচেয়ে ফেভারিট দল। তিনি সাধারণত দলকে ৪-৪-২ এবং ৪-২-৩-১ এ খেলিয়ে থাকেন। বিশ্বকাপে নেইমার এবং ভিনিসিয়াসকে একই সাথে খেলানোর ছক হিসেবে ৪-২-৩-১ ফরমেশনই বেশি প্রয়োগ করতে পারেন তিনি। বিশ্বকাপে তিতের কোচিং কারিশমাই সেলেসাওদের এনে দিতে পারে হেক্সার স্বাদ।

দিদিয়ের দেশম (ফ্রান্স)

খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা তৃতীয় ব্যক্তি দেশম দুই ভূমিকাতেই বেশ সফল। ২০০৪ সালে পান লিগ ওয়ানের বর্ষসেরা কোচের পুরস্কার। ২০১২ সালের ৮ জুলাই ফ্রান্স জাতীয় দলের দায়িত্ব নিলেও সফলতা পেতে সময় লাগে প্রায় ৬ বছর। ২০১৮ বিশ্বকাপে সম্পূর্ণ তারুণ্যনির্ভর দল নিয়ে ফ্রান্সকে জেতান দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। তারুণ্যনির্ভর হলেও পগবা, কান্তে, গ্রিজম্যানদের নিয়ে গড়া দলটি ছিল মূলত দেশমের সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনার ফল।

ডিফেন্সকে সুগঠিত করে খেলাতে পছন্দ করা দেশম মাঠে তিনজন মূল সেন্টারব্যাক প্রয়োগ করে থাকেন। ৩-৪-৩ বা ৩-৪-১-২ এর মতো কাউন্টারনির্ভর ফরমেসন সাজিয়ে কাতারে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মিশনে নামবেন দেশম।

লুই ফন গাল (নেদারল্যান্ডস)

গত বছর ফ্রাঙ্ক ডি বোরের অধীনে ছন্নছাড়া খেলতে থাকা নেদারল্যান্ডসের হাল ধরেন ডাচদের প্রভাবশালী ফুটবল ব্যক্তিত্ব লুই ফন গাল। আয়াক্সের হয়ে লিগ-চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা ফন গল এজেড আল্কমারের মতো অখ্যাত ক্লাবকে ডাচ লিগ জিতিয়ে চমক দেখিয়েছেন। এর আগে দুই দফা ডাচদের ডাগআউটে দাঁড়ানো এই কোচ বিশ্বকাপে তৃতীয় বারের মতো দায়িত্ব সামলাবেন।

কিছুদিন আগেই প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত অবস্থায়ও দেশের হয়ে কোচিং চালিয়ে গেছেন। তিনি সচরাচর টোটাল ফুটবলের জনপ্রীয় ফর্মেশন ৪-৩-৩ ব্যাবহার করলেও এ বিশ্বকাপে ৩-৪-৩ প্রয়োগ করতে পারেন। তাঁর দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ভার্জিল ফন ডাইক, ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, ম্যাথিয়াস ডি লিখতরা বিশ্বকাপে বড় কিছু করে দেখাবেন- এমনটাই আশা নেদারল্যান্ডস সমর্থকদের।

লিওনেল স্কালোনি (আর্জেন্টিনা)

স্কালোনি কোচ হওয়ার পর ডিয়েগো ম্যারাডোনা তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন- ‘স্কালোনি কখনই ভালো খেলোয়াড় ছিল না। সে মাঠে লাথি মারা ছাড়া কিছু করতে পারত না।’ ম্যারাডোনা বেঁচে থাকলে হয়তো নিজের কথা ফিরিয়ে নিয়ে স্কালোনিকে দৃঢ় আলিঙ্গনে বাঁধতেন। কেননা এই সাদামাটা কোচই ২০২১ কোপা আমেরিকা ও লা ফিনালিসিমার শিরোপা জিতিয়ে কাটিয়েছেন আর্জেন্টিনার দীর্ঘ ২৮ বছরের শিরোপা খরা।

পেয়েছিলেন গত বছরের বর্ষসেরা কোচের মনোয়ন। প্রতিপক্ষ বুঝে ফরমেসন সাজানো স্কালোনি দলকে ৪-৩-৩ কিংবা ৪-৩-২-১ এর মতো আক্রমণাত্মক আবার কখনো ৪-৪-২ এবং ৪-১-৪-১ এর মতো রক্ষণাত্মক ধাঁচেও খেলিয়েছেন। স্কালোনি দলকে এতটাই প্রভাবিত করেছেন যে, বিশ্বকাপে ফেভারিট আর্জেন্টিনার টিম স্পিরিটই বিপক্ষের সবচেয়ে ভয়ের কারণ।

এছাড়াও ডাগআউটে বিশেষ নজর কাড়বেন ইংলিশ কোচ টিম সাউথগেট, পর্তুগালের ফার্নান্দো সান্তোস, বেলজিয়ামের রবার্তো মার্টিনেজ, মেক্সিকোর আর্জেন্টাইন কোচ টাটা মার্টিনোসহ আরো অনেকেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //