আগের ২১ আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা

ফিফা আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার দেওয়ার প্রচলন শুরু করে ১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকে। বিশ্বখ্যাত ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাডিডাস’ ও বিশ্বখ্যাত ফুটবল সাময়িকী, ব্যালন ডি’অর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফ্রান্স ফুটবল’-এর যৌথ উদ্যোগে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

সেরা খেলোয়াড়কে দেওয়া হয় ‘গোল্ডেন বল’, সর্বোচ্চ গোলদাতাকে দেওয়া হয় ‘গোল্ডেন বুট’। অবশ্য সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরোস্কারের নাম ‘গোল্ডেন বুট’ রাখা হয় ২০১০ বিশ্বকাপ থেকে। শুরুতে নাম ছিল ‘গোল্ডেন শু’।

যাই হোক, ১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে বটে, তবে ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপ থেকে প্রতিটা আসরেই সর্বোচ্চ গোলদাতারা বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এই প্রতিবেদনে সংক্ষিপ্তভাবে বিগত ২১ আসরের ২১ জন সর্বোচ্চ গোলদাতাকে তুলে ধরা হলো।

গুইলারমো স্তাবিলে, ১৯৩০ বিশ্বকাপ

১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় উরুগুয়েতে। প্রথম চ্যাম্পিয়নও হয় স্বাগতিক উরুগুয়ে। তবে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন রানার্সআপ আর্জেন্টিনার সেন্টার ফরোয়ার্ড গুইলারমো স্তাবিলে। ৪ ম্যাচে তিনি করেন ৮ গোল। নিজে খেলা প্রতি ম্যাচেই গোল করেন তিনি। স্তাবিলে নিজের প্রথম ম্যাচেই করেন হ্যাটট্রিক, মেক্সিকোর বিপক্ষে।

বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম হ্যাটট্রিককারী তিনিই। এর পর চিলির বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। যুক্তরাষ্ট্রের সেমিফাইনালে জোড়া গোল করা স্তাবিলে উরুগুয়ের বিপক্ষে ফাইনালেও একটি গোল করেন; কিন্ত দুর্ভাগ্য, তার দল আর্জেন্টিনা ফাইনালে ৪-২ গোলে হেরে যায় উরুগুয়ের কাছে।

ওলড্রিচ নেজেদলি, ১৯৩৪ বিশ্বকাপ

প্রথম আসরেরই যেন পুনরাবৃত্তি। নিজেদের মাঠে অনুষ্ঠিত ১৯৩৪ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি; কিন্তু সর্বোচ্চ গোলদাতা হন রানার্সআপ হওয়া চেকোস্লোভাকিয়ার ফরোয়ার্ড ওলড্রিচ নেজেদলি। ৪ ম্যাচে ৫ গোল করা নেজেদলি সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে করেন হ্যাটট্রিক। এর আগে রোমানিয়ার বিপক্ষে রাউন্ড অব ১৬ এবং কোয়ার্টার ফাইনালে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে একটি করে গোল করেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, ইতালির বিপক্ষে ফাইনালে গোল করতে পারেননি। তার দলও হেরে যায় ২-১ গোলে। 

লিওনিদাস ডি সিলভা, ১৯৩৮ বিশ্বকাপ

প্রথম দুই আসরে তবু রানার্সআপ দল থেকে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। ১৯৩৮ সালের তৃতীয় বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন তৃতীয় হওয়া ব্রাজিলের লিওনিদাস ডি সিলভা। ৪ ম্যাচে করেছিলেন ৭ গোল। পোল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই করেন হ্যাটট্রিক। চেকোস্লোভাকিয়ার সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালের দুই লেগে করেন দুই গোল।

বিস্ময়কর হলো- ইতালির বিপক্ষে সেমিফাইনালে উড়তে থাকা লিওনিদাসকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখেন ব্রাজিল কোচ। ব্রাজিল ম্যাচটাও হারে ২-১ গোলে। তবে সুইডেনের বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ফিরেই জোড়া গোল করেন লিওনিদাস। ব্রাজিলও ম্যাচ জিতে ৪-২ গোলে। সর্বোচ্চ গোলদাতার পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও হন লিওনিদাস।

আদেমির, ১৯৫০ বিশ্বকাপ

ব্রাজিলের মাটির এই বিশ্বকাপেও সর্বোচ্চ গোলদাতা হন রানার্সআপ ব্রাজিলের আদেমির। তবে তার গোল সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে ৬ ম্যাচে তার গোল সংখ্যা ৮টি দেখানো হয়েছে। তবে ম্যাচভিত্তিক পর্যালেচনায় দেখা যায় তিনি মোট ৯ গোল করেছিলেন। মেক্সিকোর বিপক্ষে জোড়া গোল করে শুরু। এর পর সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে গোল না পেলেও যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে করেন একটি গোল।

ফাইনাল রাউন্ডে সুইডেনের বিপক্ষে আদেমির একাই করেন ৪ গোল। ব্রাজিলও ম্যাচ জিতে ৭-১ গোলে। এর পর স্পেনের বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। উরুগুয়ের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে তিনি গোল পাননি। তার দল ব্রাজিলও জিততে পারেনি।

সান্দর ককসিস, ১৯৫৪ বিশ্বকাপ

এই আসরেও সর্বোচ্চ গোলদাতা হন রানার্সআপ হাঙ্গেরির সান্দর ককসিস। মাত্র ৫ ম্যাচেই ১১ গোল করেছিলেন তিনি। গ্রুপপর্বে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেন ককসিস। হাঙ্গেরি ম্যাচ জিতে ৯-০ গোলে। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে পরের ম্যাচে ককসিস একাই করেন ৪ গোল। টানা দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিক।

হাঙ্গেরিও ম্যাচ জিতে ৮-৩ গোলে। অথচ ফাইনালে এই পশ্চিম জার্মানির কাছেই অপ্রত্যাশিতভাবে ৩-২ গোলে হেরে যায় ককসিস-ফেরেঙ্ক পুসকাসদের হাঙ্গেরি। ফাইনালে গোল পাননি ককসিস; তার দলও জিততে পারেনি। তার আগে ব্রাজিলের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ও উরুগুয়ের বিপক্ষে সেমিফাইনাল, দুই ম্যাচেই দুটি করে গোল করেন ককসিস। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন ককসিসেরই সতীর্থ ফেরেঙ্ক পুসকাস।

জাস্ট ফন্টেইন, ১৯৫৮ বিশ্বকাপ

সুইডেনে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপটি পেলের বিশ্বকাপ হিসেবেই খ্যাত। তরুণ পেলের অবিস্মরণীয় পারফরম্যান্সে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিল। তবে গোল করায় বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিলেন ফ্রান্সের জাস্ট ফন্টেইন। টুর্নামেন্টে ৬ ম্যাচে তিনি করেছিলেন ১৩ গোল! বিশ্বকাপের এক আসরে এত বেশি গোল করতে পারেননি আর কেউই। জাস্ট ফন্টেইন শুরুটা করেছিলেন প্যারাগুয়ের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক দিয়ে।

পরে যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ২টি, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে করেন ১টি গোল। গ্রুপপর্বে ৩ ম্যাচে ৬ গোল করা ফন্টেইন নকআউটপর্বে ৩ ম্যাচে করেন আরও ৭ গোল। কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২টি, সেমিফাইনালে ব্রাজিলের কাছে ৫-২ গোলে হারা ম্যাচে ১টি। সবশেষ পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে করেন ৪ গোল। তার দল ফ্রান্সও ৬-৩ গোলে জিতে তৃতীয় হয়। টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬টি করে গোল করেছিলেন পেলেসহ ৫ জন।

ছয়ের লড়াই, ১৯৬২ বিশ্বকাপ

চিলিতে অনুষ্ঠিত এই আসরটি গোল-খরার বিশ্বকাপ হিসেবেই পরিচিত। কোনো আত্মঘাতী গোল না হওয়া আসরে গোল হয়েছিল মোটে ৮৯টি। গোল করেছিলেন মোট ৫৪ খেলোয়াড়। তবে গোল-খরার এই আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতার লড়াইটা হয়েছিল সবচেয়ে বেশি জমজমাট। সমান ৪টি করে নিয়ে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন মোট ৬ জন। চ্যাম্পিয়ন হওয়া ব্রাজিলের গারিঞ্চা ও ভাভা, তৃতীয় হওয়া চিলির লিওনেল সানচেজ, হাঙ্গেরির ফ্লোরিয়ান আলবার্ট, রাশিয়ার ভ্যালেনটাইন ইভানভ ও যুগোস্লাভিয়ার দ্রজান ইয়ারকোভিচ। এদের মধ্যে গারিঞ্চা পেয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব।

ইউসেবিও, ১৯৬৬ বিশ্বকাপ

নিজেদের মাটির এই বিশ্বকাপে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে নাটকীয় ফাইনালে হ্যাটট্রিক করেন জিওফ হার্স্ট। তবে ইংল্যান্ড বা হাস্টের কারণে নয়, ১৯৬৬ বিশ্বকাপটি বিখ্যাত হয়ে আছে ইউসেবিওর কারণে। পর্তুগিজ কিংবদন্তি বিস্ময়কর একটা টুর্নামেন্টই কাটিয়েছিলেন। হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা। অবশ্য তার গোল সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে।

এমনিতে তার গোল সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৯টি; কিন্তু ম্যাচ পর্যালোচনায় পাওয়া যায় ৮ গোল। ৯ হোক বা ৮, তিনিই সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন। ব্রাজিলের বিপক্ষে করেছিলেন জোড়া গোল। উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ইতিহাসখ্যাত সেই নাটকীয় কোয়ার্টার ফাইনালে করেছিলেন হ্যাটট্রিক। একটি করে গোল করেছিলেন সেমিফাইনাল ও তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে। গ্রুপপর্বে ব্রাজিল ম্যাচের আগে বুলগেরিয়ার বিপক্ষেও করেছিলেন একটি গোল।

জার্ড মুলার, ১৯৭০ বিশ্বকাপ 

মেক্সিকোর বিশ্বকাপটি পেলে এবং ব্রাজিলের বিশ্বকাপ হিসেবেই খ্যাত। এই আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আজীবনের জন্য জুলে রিমে ট্রফি নিজেদের করে নেয় ব্রাজিল। তবে গোল বিস্ময়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন পশ্চিম জার্মানির জার্ড মুলার। জার্মান কিংবদন্তি ৬ ম্যাচে করেন সর্বোচ্চ ১০ গোল। গ্রুপপর্বে টানা ২ ম্যাচে হ্যাটট্রিকসহ ৩ ম্যাচে করেন ৭ গোল। মরক্কোর বিপক্ষে একটি, বুলগেরিয়া ও পেরুর বিপক্ষে পরের দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিক।

এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে একটি, ইতালির বিপক্ষে সেমিফাইনালে করেন ২ গোল। তার পরও ইতালির কাছে ৪-৩ গোলে হেরে যায় তার দল পশ্চিম জার্মানি। পরে উরুগুয়েকে হারিয়ে তৃতীয় হয় জার্মানরা।

জর্জ লাটো, ১৯৭৪ বিশ্বকাপ

পশ্চিম জার্মানিতে অনুষ্ঠিত এই আসরটি নেদারল্যান্ডস (হল্যান্ড) ও ইয়োহান ক্রুইফের বিশ্বকাপ হিসেবেই খ্যাত। যদিও ফাইনালে ক্রুইফের নেদারল্যান্ডসকে ২-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিন হয় স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানি। অথচ টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন তৃতীয় হওয়া পোল্যান্ডের উইঙ্গার জর্জ লাটো। ৭ ম্যাচে ৭ গোল করেছিলেন তিনি।

আর্জেন্টিনার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই করেন জোড়া গোল, হাইতির বিপক্ষে পরের ম্যাচেও জোড়া গোল। এরপর দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইডেনের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই আবার গোল করেন লাটো। গোল করেন যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচেও। তার পরও পোল্যান্ড ফাইনালে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয় রাউন্ডের বি গ্রুপ থেকে রানার্সআপ হয়ে খেলে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ। সেখানে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে তৃতীয় হয় পোল্যান্ড। 

মারিও কেম্পেস, ১৯৭৮ বিশ্বকাপ

এই প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলের কোনো খেলোয়াড় এককভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। কীর্তিটা গড়েন আর্জেন্টিনার মারিও আলবার্তো কেম্পেস চিওদি। ৭ ম্যাচে ৬ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছিলেন কেম্পেস। এই কেম্পেস জাদুতেই নিজেদের মাটির বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। কেম্পেসের জোড়া গোলেই ফাইনালে ফেভারিট নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা।

প্রথম রাউন্ডের তিন ম্যাচে একটিও গোল করতে না পারা কেম্পেস দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। জোড়া গোল করেন পেরুর বিপক্ষেও। এই ম্যাচে ৬-০ গোলের জয়ের সুবাদেই ব্রাজিলকে টপকে ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। গুরুত্বপূর্ণ তিন ম্যাচে জোড়া গোল করা কেম্পেসই ছিলেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের আসল নায়ক।

পাওলো রসি, ১৯৮২ বিশ্বকাপ

১৯৭৮ আসরে যেমন চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার মারিও কেম্পেস টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জেতেন, ১৯৮২ বিশ্বকাপেও এই দুটি পুরস্কারই জেতেন চ্যাম্পিয়ন হওয়া ইতালির পাওলো রসি। ৬ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পাশাপাশি হয়েছিলেন সেরা খেলোয়াড়ও। মানে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ফিফার দেওয়া সোনার বল ও সোনার জুতা- দুটোই জিতে নেন পাওলো রসি।

অথচ পাওলো রসিকে বিশ্বকাপ দলে রাখা নিয়েই ইতালিয়ান গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। টুর্নামেন্টের মাঝপথে তো রসিকে ‘না’ খেলার দাবিও ওঠে। নিজেদের প্রথম ৪ ম্যাচেই গোল করতে ব্যর্থ হন রসি, এমন অফফর্মের স্ট্রাইকারকে না খেলানোর দাবিটা যুক্তিযুক্তই ছিল; কিন্তু অতিআস্থার কারণে হোক বা জেদের বশে, ইতালির কোচ এঞ্জো বেয়ারজোত ঠিকই ব্রাজিলের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও রসিকে শুরুর একাদশেই নামান।

বিস্ময়করভাবে এই ম্যাচ দিয়েই রসি রূপকথার শুরু।। ব্রাজিলের বিপক্ষে অন্য রূপে ধরা দেওয়া রসি করেন হ্যাটট্রিক। তার একার নৈপূণ্যেই ফেভারিট ব্রাজিলকে ৩-২ গোলে হারিয়ে গ্রুপের শীর্ষ দল হিসেবে সেমিফাইনালে পা রাখে ইতালি।

সেমিতেও রসি জাদুতে জিতে ইতালি, তার জোড়া গোলে পোল্যান্ডকে ২-০-তে হারিয়ে ওঠে ফাইনালে। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালেও ইতালির ৩-১ গোলের জয়ে প্রথম গোলটি করেন রসি। শেষ তিন ম্যাচের অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সে ফুটবল দুনিয়াকে বিমোহিত করেছিলেন রসি।

গ্যারি লিনেকার, ১৯৮৬ বিশ্বকাপ

১৯৮৬ মেক্সিকো আসরটি ডিয়েগো ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ হিসেবেই খ্যাত। বল পায়ে অবিশ্বাস্য মোহনীয়তার পাপড়ি ছড়িয়ে আর্জেন্টিনাকে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন করেন ম্যারাডোনা। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও হন তিনিই; কিন্তু ম্যারাডোনার বিশ্বকাপটিতে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি জিতে নেন ইংল্যান্ডের ফরোয়ার্ড গ্যারি লিনেকার। ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নেয় ইংল্যান্ড।

তার পরও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার সোনার বল নিজের করে নিয়েছিলেন লিনেকার। ৫ ম্যাচ খেলে তিনি করেছিলেন ৬ গোল। গ্রুপপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে শেষ ষোলোর ম্যাচে করেন জোড়া গোল। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলে হারা ম্যাচেও ইংল্যান্ডের একমাত্র গোলটা করেছিলেন লিনেকার; কিন্তু ম্যারাডোনার সেই ঐতিহাসিক দুই গোলের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয় লিনেকারকে।

সালভাতোরে শিলাচি, ১৯৯০ বিশ্বকাপ

নিজেদের মাটির এই বিশ্বকাপে তৃতীয় হয়েছিল ইতালি। এই ইতালিরই সালভাতোরে শিলাচি জিতে নিয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার সোনার বল ও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার সোনার জুতা। ৭ ম্যাচে ৬ গোল করেছিলেন তিনি। গোল ৬টি তিনি করেছিলেন ৬ ম্যাচে। মানে প্রতি ম্যাচে একটি করে।

গ্রুপপর্বে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচটি ছাড়া নিজেদের বাকি সব ম্যাচেই গোল পান ইতালির সুযোগ সন্ধ্যানী ফরোয়ার্ড। গোল করেছিলেন সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে টাইব্রেকারে হারা ম্যাচেও। পরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও গোল করেন শিলাচি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের সুবাদে সর্বোচ্চ গোলদাতার পাশাপাশি সেরা খেলোয়াড়ও হন তিনি।

ওলেগ সালেঙ্কো ও হৃস্তো স্টয়ইচকোভ, ১৯৯৪ বিশ্বকাপ

প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত এই আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার সোনার বল ওঠে ব্রাজিলেরই ফরোয়ার্ড রোমারিওর হাতে। তবে টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন যৌথভাবে দুজন। রাশিয়ার ওলেগ সালেঙ্কো ও বুলগেরিয়ার হৃস্তো স্টয়ইচকোভ। দুজনই করেছিলেন সমান ৬টি করে গোল। মজার ব্যাপার হলো- এদের একজন ওলেগ সালেঙ্কোর রাশিয়া গ্রুপপর্বই পেরোতে পারেনি। মানে গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার পরও ওলেগ সালেঙ্কো সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। তিনি দুই ম্যাচেই করেছিলেন ৬টি! ব্রাজিলের কাছে ২ -তে হারা ম্যাচে তার গোল পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

পরের ম্যাচে সুইডেনের কাছে ৩-১ গোলে হারা ম্যাচে রাশিয়ার একমাত্র গোলটি করেন ওলেগ সালেঙ্কো, পেনাল্টি থেকে। এর পর ক্যামেরুনের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে তিনি একাই করেন ৫ গোল, যা বিশ্বকাপের এক ম্যাচে কোনো খেলোয়াড়ের সর্বেচ্চ গোলের রেকর্ড। ম্যাচ ৬-১ গোলে জিতলেও রাশিয়া শেষ ষোলোতে উঠতে পারেনি।

অন্যদিকে হৃস্তো স্টয়ইচকোভ পায়ের জাদু দেখিয়ে বুলগেরিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেমিফাইনালে; কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, সেমিফাইনালে ইতালির কাছে ২-১ গোলে হেরে শিরোপাস্বপ্ন ভেঙে যায় তাদের। ওই ম্যাচেও দলের একমাত্র গোলটা করেছিলেন বার্সেলোনার সাবেক তারকা। 

ডেভর সুকের, ১৯৯৮ বিশ্বকাপ

১৯৯২ সালে স্বাধীনতা লাভের ৬ বছরের মাথায়ই ফুটবল দুনিয়াকে চমকে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। একের পর এক ম্যাচে বিস্ময় উপহার দিয়ে উঠেছিল সেমিফাইনালে; হয়েছিল তৃতীয়। ফ্রান্সের মাটির বিশ্বকাপে নবাগত ক্রোয়েশিয়ার এই বিস্ময়যাত্রার নায়ক ছিলেন ডেভর সুকের। রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক স্ট্রাইকার জিতেছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার সোনার জুতা। গোল করেছিলেন সর্বোচ্চ ৬টি। গ্রুপপর্বে শুধু আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোল করতে পারেননি। এ ছাড়া বাকি ৬ ম্যাচেই একটি করে গোল করেন তিনি; ঠিক ১৯৯০ সালে ইতালির সালভাতোরে শিলাচির মতো। সেমিফাইনালে স্বাগতিক ফ্রান্সের (পরে চ্যাম্পিয়ন) কাছে হেরে শেষ হয় ডেভর সুকেরদের স্বপ্নযাত্রা। ২-১ গোলে হারা সেই ম্যাচেও দলের একমাত্র গোলটা করেছিলেন তিনি। গোল করেছিলেন নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয় হওয়া ম্যাচেও।

রোনাল্ডো, ২০০২ বিশ্বকাপ

১৯৯৮ বিশ্বকাপে অবিশ্বাস্য ফুটবল খেলেও দেশ ব্রাজিলকে শিরোপা জেতাতে ব্যর্থ হন রোনাল্ডো নাজারিও। সেই হতাশা ২০০২ বিশ্বকাপেই মুছে ফেলেন রোনাল্ডো ও তার সতীর্থরা। কোরিয়া-জাপানের আসরে ঠিকই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। আর এশিয়ার মাটির প্রথম এই বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন গোলমেশিন রোনাল্ডো; করেন টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৮ গোল, জিতে নেন সোনার জুতা। দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচটি বাদে সব ম্যাচেই গোল করেন তিনি।

সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে তো তার কাঁধে চেপেই জয় পায় ব্রাজিল। সেমিতে তুরস্কের বিপক্ষে ১-০ ও ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়- দুই ম্যাচে তিনটি গোলই করেন রোনাল্ডো। গোল করেন কোয়ার্টার ফাইনাল এবং গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচেই। আফসোস, এমন বিস্ময়কর পারফরম্যান্সে দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাননি। সেটি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন রানার্সআপ জার্মানির গোলরক্ষক অলিভার কান।

মিরোস্লাভ ক্লোসা, ২০০৬ বিশ্বকাপ

নিজেদের ঘরের মাটির এই বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে ইতালির কাছে হেরে যায় জার্মানি। পরে পর্তুগালকে হারিয়ে জার্মানি তৃতীয় স্থান পায়। দল শিরোপা না পেলেও জার্মানির ফরোয়ার্ড মিরোস্লাভ ক্লোসা জিতে নেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার, সোনার জুতা। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৫ গোল করেন তিনি। গ্রুপপর্বে কোস্টারিকার বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই জোড়া গোল করেন ক্লোসা। পোল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচে গোল পাননি। তবে ইকুয়েডরের বিপক্ষে গ্রুপের শেষ ম্যাচে করেন জোড়া গোল।

এর পর আর্জেন্টিনার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে করেন একটি গোল। সেমিফাইনাল, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ক্লোসা গোল না পেলেও ঠিকই সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার সোনার জুতা জিতে নেন পরবর্তীতে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়ে।

টমাস মুলার, ২০১০ বিশ্বকাপ

২০০৬ আসরের মতো ২০১০ বিশ্বকাপেও তৃতীয় হয় জার্মানি। দক্ষিণ আফ্রিকার এই আসরেও টুর্নামন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা নির্বাচিত হন তৃতীয় হওয়া জার্মানির একজন, টমাস মুলার। যথারীতি ক্লোসার মতো মুলারও সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ৫ গোল করে। তবে ক্লোসার মতো একা নন, ২০১০ আসরে মুলারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫টি করে গোল করেছিলেন আরও ৩ জন- চতুর্থ হওয়া উরুগুয়ের দিয়েগো ফোরলান, চ্যাম্পিয়ন হওয়া স্পেনের ডেভিড ভিয়া ও রানার্সআপ হওয়া নেদারল্যান্ডসের ওয়েসলি স্নাইডার। মানে মোট ৪ জন সর্বোচ্চ ৫টি করে গোল করেন।

তবে অ্যাসিস্ট বেশি করায় সোনার জুতা জোড়া জিতে নেন মুলার। ৫ গোলের মধ্যে ৪টি গোলই তিনি করেন নকআউটপর্বে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ষোলোতে ২টি, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ১টি ও উরুগুয়ের বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ১টি।

হামেশ রদ্রিগেজ, ২০১৪ বিশ্বকাপ

আগের দুই আসরে তৃতীয় হওয়া জার্মানি ২০১৪ সালে হয় চ্যাম্পিয়ন। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার সোনার বল জিতেন রানার্সআপ আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসি। তবে টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বড় চমকটা উপহার দেন কলম্বিয়ার হামেশ রদ্রিগেজ। ওই বিশ্বকাপের আগে ফুটবল দুনিয়া তাকে সেভাবে চিনতই না। সেই রদিগ্রেজই হয়ে ওঠেন ব্রাজিল বিশ্বকাপের বড় তারা। বলতে গেলে কলম্বিয়াকে একাই টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে। এই কোয়ার্টার ফাইনালেই স্বাগতিক ব্রাজিলের কাছে হেরে তাদের বিশ্বকাপযাত্রা থেমে যায়।

তবে হামেশ রদ্রিগেজ তার আগেই করে ফেলেন ৬টি গোল, যা তাকে বানিয়ে দেয় র্টুামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা। গ্রুপপর্বে ৩ ম্যাচেই একটি করে গোল করা হামেশ রদ্রিগেজ শেষ ষোলোতে উরুগুয়ের বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। ব্রাজিলের বিপক্ষে শেষ আটেও গোল করেছিলেন একটি। ৫ ম্যাচে ৬ গোল করা রদ্রিগেজের হাতেই উঠেছিল সোনার জুতা।

হ্যারি কেন, ২০১৮ বিশ্বকাপ

২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে ইংল্যান্ডকে নিয়ে তেমন আলোচনাই ছিল না; কিন্তু অঘটনের বিশ্বকাপটিতে ঠিকই ঝলসে ওঠে ইংল্যান্ড। উঠে যায় সেমিফাইনালে। ইংল্যান্ডের এই সাফল্যের বড় কারিগর ছিলেন হ্যারি কেন, যিনি ৬ গোল করে হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা। অর্জন করেছিলেন সোনা জুতা। ৬ গোলের ৫টি গোলই তিনি করেছিলেন গ্রুপপর্বের প্রথম দুই ম্যাচে। তিউনিসিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে করেন জোড়া গোল, পানামার বিপক্ষে পরের ম্যাচে হ্যাটট্রিক।

এর পর একটাই গোল করেন হ্যারি কেন, কলম্বিয়ার বিপক্ষে শেষ ষোলোর ম্যাচে। কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে গোল পাননি তার পরও সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে সমস্যা হয়নি তার। ফ্রান্স চ্যাম্পিয়ন হওয়া আসরটিতে সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়ার লুকা মড্রিচ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //