ত্রয়ীর বিদায়ের সুর ফুটবল বিশ্বে

লিওনেল মেসি-ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো-নেইমার জুনিয়র, এই তিনজনই খেলছেন কাতার বিশ্বকাপে। যার মধ্যে সবাই নিজের নামের প্রতি পুরোপুরি সুবিচার করতে পেরেছেন। তকবে ইনজুরির কারণে নেইমার ছিটকে গেছেন। বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা তিন ফুটবলারই এবার শেষবারের মতো মাঠে নেমেছেন। এই তিনত্রয়ীর বিদায়ের সুরে অশ্রুসিক্ত এখন ফুটবল বিশ্ব। ৯২ বছরের ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে কাতার; সেটি করে দেখানোর মঞ্চেও নেমে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবের দেশটি। তবে কাতার বিশ্বকাপ এমন এক মঞ্চ যেখানে বাজছে পূর্ণচ্ছেদের সুর, তাতে অশ্রুসিক্ত বিশ্ব। লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও নেইমার। হালের ফুটবলের তিন অমূল্য রত্ম, যাদের পায়ের জাদুতে বিশ্ব দোল খায়। অথচ কাতার বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে ত্রয়ীর দাঁড়ি টানার মঞ্চ! জাতীয় দলের জার্সিতে হয়তো তাদের আরো কিছুদিন দেখা যেতে পারে, কিন্তু বয়সের কারণে বিশ্বমঞ্চে, বিশ্বকাপ আসরে, দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে এটিই হতে যাচ্ছে তাদের শেষ পদচারণা, মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ বয়সটা যে তাদের শেষ বাশি বাজিয়ে রাখার ঘোষণা দিয়েছে।

যদিও ঘোষণাটা সবার আগে দিয়েছেন ব্রাজিলের নেইমার; আর্জেন্টাইন সুপারস্টার মেসি কিছুদিন আগে বলেছেন, এটাই শেষ বিশ্বকাপ। বাকি রোনালদো, সিআরসেভেন ঘোষণা দেননি। তবে ইংলিশ ও স্প্যানিশ গণমাধ্যম তার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের বরাত দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, এবারই পূর্ণচ্ছেদ। ম্যাচের পর ম্যাচ, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস চোখ ধাঁধানো ফুটবল খেলেছেন ত্রয়ী। মুগ্ধতা ছড়ানো তাদের ফুটবল জ্ঞান, অসাধারণ তাদের ক্ষীপ্রতা, ড্রিবলিংয়ে তাদের ঐশ্বরিক প্রতিভা। তবুও ত্রয়ীর চিরকালীন শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন, রয়েছে কিন্তু। কারণ একটাই, জাতীয় দলের জার্সিতে জেতা হয়নি বিশ্বকাপের মুকুট। এ নিয়ে রয়েছে তাদের আক্ষেপ, রয়েছে হাহাকার। সেই হাহাকার কি এবার মিটবে কাতার বিশ্বকাপে?

চারটি বিশ্বকাপ এরই মধ্যে খেলেছেন মেসি ও রোনালদো, নেইমার খেলেছেন তিনটি। তিনজনের মধ্যে মেসিই শুধু শিরোপার খুব কাছে যেতে পেরেছিলেন। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছিলেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার। কিন্তু জার্মান শ্রেষ্ঠত্বে কপাল পোড়ে জাদুকরের। ব্রাজিল সে বছর খেলেছে সেমিফাইনাল, জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হওয়া ম্যাচে নেইমার ছিলেন দলের বাইরে। কিন্তু সেটিই ছিল বিশ্বকাপে তার সর্বোচ্চ অবস্থান। রোনালদোর অবশ্য বিশ্বকাপ শুরুই হয়েছিল দারুণভাবে। ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে তার দল খেলেছিল সেমিফাইনাল। ফ্রান্সের কাছে সেমিফাইনালে হারের পর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষেও পারেনি পর্তুগাল। ফলে চারেই শেষ তার যাত্রা। দেশের জার্সিতে তিন জনই মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা জিতেছেন।

নেইমার ও মেসির শোকেসে আছে কোপা আমেরিকার শিরোপা। রোনালদোও জিতেছেন ইউরোর শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। এসব জিততেও কম ঘাম ঝরাতে হয়নি তাদের। তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে একটাই স্বপ্ন বিশ্বকাপ জয়। বিশ্বকাপে মেসি-রোনালদো-নেইমারের পারফরম্যান্স হলো- মেসি ২০০৬ থেকে ২০১৮ চার বিশ্বকাপে ১৯ ম্যাচ খেলেছেন, গোল করেছেন ছয়টি, অ্যাসিস্ট পাঁচটি। শুধু ২০১০ বিশ্বকাপে গোল পাননি। রোনালদো গত চার বিশ্বকাপে ১৭ ম্যাচ খেলেছেন, প্রতি আসরেই গোল পেয়েছেন মোট গোল সাতটি, দুটি অ্যাসিস্ট। আর নেইমার ২০১৪ ও ২০১৮ আসরে ১০ ম্যাচে গোল করেছেন ছয়টি, অ্যাসিস্ট তিনটি। তিনজনের মধ্যে বয়সে এগিয়ে রোনালদো, ৩৭। ফুটবলে এমন বয়সে খেলা ছেড়ে দেন অনেকে। কিন্তু তিনি এ বয়সেও যেন টগবগিয়ে ফুটছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফিটনেস থাকায় কাতার বিশ্বকাপ জয়ের দাবিদার তিনি।

পর্তুগালের অনেকেই বলছেন কাতার বিশ্বকাপ তারা রোনালদোর জন্য খেলতে চান। শুধু খেলতেই নয়, নকআউট পর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্য পর্তুগালের। ২০০৬ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলা পর্তুগাল এবার কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের অধীনে শিরোপা জিততে চায়। তার অধীনেই ২০১৬ ইউরো ও ২০১৯ সালে ইউরোপিয়ান নেশন্স লিগ জিতেছে পর্তুগাল। এবার বিশ্বকাপে চোখ রোনালদোর। বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনা রয়েছে চূড়ান্ত ফর্মে, ৩৫ ম্যাচে অপরাজিত। মেসিও দলের মতো অপ্রতিরোধ্য, নিয়মিত গোল করছেন, করাচ্ছেন। পিএসজির পাশাপাশি আর্জেন্টিনার জার্সিতেও একের পর এক অনবদ্য পারফরম্যান্স করছেন। জাতীয় দলের হয়ে শেষ তিন ম্যাচে করেছেন ৯ গোল। গত বছর ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা জিতেছিলেন মেসি। বিশ্বকাপ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আসর, যেখানে ২০১৪ সালে ফাইনাল খেলেছিলেন মেসি। সাতটি ব্যালন ডি’অর ট্রফিসহ ফুটবলের প্রায় সব ট্রফিই রয়েছে। তাই মেসি ভক্তদের আশা দেশের হয়ে শেষ বিশ্বকাপে ট্রফিটা জিতুন এই মহাতারকা। ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার যতটা সামর্থবান, যতটা প্রতিভাবান তার ছিঁটেফোটাও বিশ্বমঞ্চে দেখাতে পারেননি।

২০১৪ এবং ২০১৮ দুটি বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্স গড়পড়তা। অথচ ওই সময়ে নিজের সেরা সময় কাটাচ্ছিলেন নেইমার। মাঠের বাইরের নানা বিতর্ক সব সময় তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। মাঠের ভেতরে তার অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু তার ফুটবল মস্তিষ্ক বরাবরই ক্ষিপ্র, তার স্কিল অন্য সবার চেয়ে আলাদা। শরীরে ব্রাজিলিয়ান রক্ত বহমান। তাই কোনো কিছুর থেকে তাকে আড়াল করা যাবে না। অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পথ দেখাতে পারেন। পথহারা জাহাজ নিয়ে যেতে পারেন গন্তব্যে। তার উপস্থিতিতে ব্রাজিলের হেক্সা মিশন সফল হলেও হতে পারে। এমনটা হলে অমরত্বের স্বীকৃতিই পেয়ে যাবেন নেইমার। কখনো ব্যালন ডি’অর না জেতা নেইমারের জন্য এই শিরোপাই হতে পারে জীবনের সব। খুব কাছে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা স্পর্শ করার সুযোগ পাননি মেসি, রোনালদো, নেইমার। এবার কি সেটা পারবেন তারা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //