একঝাঁক ‘বিদেশি’ ফুটবলারের দল মরক্কো

ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে এই প্রথম কোনো আফ্রিকান এবং আরব দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মরক্কো। স্পেন, পর্তুগালের মত দেশকে হারিয়ে তারা পৌঁছে গেছে স্বপ্নের ফাইনালের দ্বারপ্রান্তে। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে তারা মুখোমুখি হবে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের।

ইতিহাসের ধারা কী তারা আরও অব্যাহত রাখতে পারবে? মরক্কোর দলটিকে দেখে বিস্ময়ই তৈরি হচ্ছে সবার, কীভাবে তারা এত বড় একটি আসরের সেমিফাইনালে এসে পৌঁছালো? এ নিয়ে বিশ্লেষণের কোনো অন্ত নেই। তবে, মরক্কোর এই সাফল্যের পেছনে অনেক বড় করে দেখা হচ্ছে, একঝাঁক বিদেশি ফুটবলারের অবদানকে। কাতার বিশ্বকাপ খেলতে আসা মরক্কোর ২৬ ফুটবলারের ১৪ জনেরই জন্ম অন্যদেশে। কাতার বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ৩২টি দলের মধ্যে যা সবচেয়ে বেশি। এর ফলে এখনই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, কাতারে এসে যে সাফল্য দেখাচ্ছে আফ্রিকান দেশটি।

আর তা আসলেই কতটা মরক্কান ফুটবলের সাফল্য? মূলত বিদেশে জন্ম নিলেও সব ফুটবলারই মরক্কান বংশোদ্ভূত। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে খেলার প্রশ্নে সবার মধ্যেই রয়েছে দেশপ্রেম। যে কারণে মা-বাবার দেশকে তারা ভুলতে পারেনি এবং বিদেশে জন্ম নিলেও খেলতে এসেছে মরক্কোর জার্সি গায়ে। মরক্কোর এখনও পর্যন্ত সেমিতে আসার পেছনে অন্যতম বড় অবদান গোলরক্ষক ইয়াসিন বোনোর। খেলেন স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়ায়। জন্ম কানাডায়। এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপে মাত্র একটি গোল হজম করেছেন তিনি। তাও আত্মঘাতী থেকে। দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার আশরাফ হাকিমির জন্ম স্পেনের মাদ্রিদে। ক্লাব ফুটবলে খেলেন লিওনেল মেসি, নেইমার, কিলিয়ান এমবাপের পিএসজিতে। অথচ, তিনি মরক্কোর আক্রমণভাগের অন্যতম ভরসা। মিডফিল্ডার সোফিয়ানে আমরাবাতের জন্ম নেদারল্যান্ডসে।

দলের আরেক মিডফিল্ডার সোফিয়ানে বউফালের জন্ম ফ্রান্সে। বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালিতে জন্ম নেওয়া ফুটবলাররাও বিশ্বকাপে খেলছেন মরক্কোর হয়ে। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের আগে বিদেশে জন্ম নেওয়া দেশীয় বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের জন্য জাতীয় দলের দরজা খুলে দিয়েছে মরক্কো। এরপর থেকেই মূলত দেশটির ফুটবল উন্নত হতে শুরু করে। আফ্রিকান গণ্ডি পেরিয়ে মরক্কোর জাতীয় দলের পারফরম্যান্স আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাড়তে থাকে। রয়্যাল মরক্কান ফুটবল ফেডারেশন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিয়েছে তাদের দেশীয় বংশোদ্ভূত প্রতিভা চিহ্নিত করার জন্য। বিদেশে জন্ম দেয়া দেশীয় প্রতিভাবান কিশোরদের মরক্কোর হয়ে খেলার জন্য উৎসাহিত করেন তারা। সে কারণেই মরক্কো পেয়েছে হাকিম জিয়াচকে। নেদারল্যান্ডসে জন্ম তার। পেশাদার ফুটবলে পা রাখার সময় দু’দেশের ফুটবল সংস্থার সঙ্গে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এক রকম দরাদরি করেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত জন্মভূমিকে ছেড়ে বেছে নিয়েছেন মাতৃভূমিকে। আমরাবাতও জুনিয়র পর্যায়ে নেদারল্যান্ডসের হয়ে কয়েকটি ম্যাচ খেলেছিলেন। পরে বেছে নিয়েছেন মাতৃ ও পিতৃভূমি মরক্কোকে।

তিনি বলেছেন, আমার বাবা-মা দুজনই মরক্কোর মানুষ। আমার পরিবারের অন্যরাও মরক্কোয় থাকেন। ছোট থেকে যখনই মরক্কোয় দাদা-দাদীর কাছে যেতাম, একটা অন্যরকম অনুভূতি হত। সবটা বলে বোঝাতে পারবো না। মনে হত নিজের বাড়িতে এসেছি। আমার জন্ম নেদারল্যান্ডসে। নেদারল্যান্ডসেই আমার সব কিছু। তবু মরক্কো আমার মনের বিশেষ জায়গায় রয়েছে।

অন্যদেশে জন্ম নেওয়ার প্রতিভাবান কিশোরদের মরক্কোর হয়ে খেলার জন্য উৎসাহিত করা কতটা সহজ? মরক্কোর হয়ে গত নয় বছর ধরে প্রতিভা খোঁজার কাজ করছেন ফুটবল কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই। যিনি এখন দায়িত্ব পালন করছেন মরক্কো জাতীয় দলের। নিজেও অতীতে মরক্কোর হয়ে খেলেছেন। 

তিনি বলেছেন, এই বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত খুবই কঠিন ছিল। সাংবাদিকরা প্রশ্ন তুলতেন, কেন অন্য দেশে জন্ম নেওয়া ছেলেদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? মরক্কোয় জন্ম নেওয়া ফুটবলারদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। কেন ওদের নিয়েই জাতীয় দল তৈরি করা হচ্ছে না? কিন্তু এখন আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি বিশ্বের সব মরক্কানই মরক্কোর জন্য। জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময় সবাই মরক্কোর জন্য জীবন দিতেও তৈরি। মরক্কোর জন্য নিজের সেরাটা দিয়ে লড়াই করে। আমি এখন কোচিং করাই। আমার জন্ম ফ্রান্সে; কিন্তু নিজের দেশের চেয়ে বেশি জায়গা আর কিছুর জন্য নেই আমার হৃদয়ে।

ফুটবলের সেরা মঞ্চে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য মরক্কোর এই কৌশল নতুন কিছু নয়। বিশ্বের বহু দেশই অন্য দেশে জন্ম নেওয়া প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। কাতার বিশ্বকাপে ৩৮ জন ফুটবলার খেলছেন যাদের জন্ম ফ্রান্সে। তাদের ১৭ জন খেলছেন ফ্রান্সের হয়ে। বাকিরা খেলছেন অন্য কোনো দেশের হয়ে। এমন খেলোয়াড়রা অংশগ্রহণকারী ২৮টি দলেই রয়েছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //