ডেলিভারিম্যান থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চে ফোফানা

ফুটবলে বিরল কিছু রেকর্ড রয়েছে। তবে একেবারে নিচু শ্রেণি থেকে উঠে আসাটাকে রেকর্ড না বললেও বিরল কিছুই বলা উচিত। তবে এবারের কাতার বিশ্বকাপে কিছুটা অন্যরকম ঘটনাও ঘটেছে। এই যেমন ‘কারোর পৌষ মাস কারোর সর্বনাশ।’ বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত প্রবাদ এটা। এনগোলো কন্তে, পল পগবা, করিম বেনজেমাদের সর্বনাশ হয়েছে চোটের কারণে। তারকাদের গড়পড়তা চোটে খুলে গেছে ইউসুফ ফোফানার স্বপ্নের দুয়ার। ডাক পেয়েছেন ফ্রান্সের কাতার বিশ্বকাপ দলে। ইতোমধ্যে বিশ্বকাপে নজর কেড়েছেন সবার। 

বিশ্বকাপের আগেও যাকে তেমন কেউ চিনতেন না। সেই ইউসুফই এখন ইউরোপিয়ান দলটির মাঝ মাঠে অ্যান্তনিও গ্রিজম্যানদের যোগ্য সঙ্গী। গত বুধবার রাতে সেমিফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে ফ্রান্সের ২-০ গোলের জয়ে দারুণ অবদান রাখেন এই তরুণ। ইউসুফের আন্তর্জাতিক ফুটবলে পথচলার শুরু এ বছরের সেপ্টেম্বরে।

ফ্রান্স দলে একের পর এক ইনজুরি তার জন্য শাপেবর হয়ে আসে। জায়গা পান ফ্রান্সের বিশ্বকাপ দলে। সুযোগ পেয়েই বাজিমাত করেছেন ২৩ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার। ফ্রান্সের ব্যাক টু ব্যাক বিশ্বকাপ শিরোপা জেতাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন এএস মোনাকোতে খেলা এই তারকা। পগবা এবং কান্তের মতো মাঝমাঠের বিশ্বস্ত সৈনিককে এবারের বিশ্বকাপ যাত্রায় পাননি ফ্রান্স প্রধান কোচ দিদিয়ের দেশম। যারা ২০১৮ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক। তার অনুপস্থিতিতে ফরাসি কোচকে অন্যরকম কিছু একটা করতেই হতো। সেই ভাবনা থেকেই ইউসুফকে মাঠে নামিয়ে দিলেন তিনি। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে এমবাপ্পে-গ্রিজম্যানদের প্রায় নাড়িয়ে দিয়েছিল মরক্কো। নীল জার্সিতে কান্তে-পগবার মতো এমন একজনকে ঠিক যখন দরকার পড়ছিল, তখনই সবটুকু উজার করে দিলেন ইউসুফ।

মাঠে নেমেই ধীরে ধীরে আস্থার প্রতিদান দিলেন গুরু দেশমকে। আজ আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনালেও ফ্রান্সের মধ্যমাঠে দেখা যেতে পারে তাকে। বিশ্বকাপ মানেই তারকাদের মিলনমেলা। এমন একটি মঞ্চে যখন পগবা, কান্তে ও বেনজেমার মতো কাউকে মিস করবেন তখন আপনাকে বিকল্প ভাবতে হবে। তাদের শূন্যস্থান কিছুটা হলেও পূরণ করেছেন ইউসুফ। ফ্রান্স ফুটবলের খুব বেশি খবর যারা না রাখেন তারা স্বাভাবিকভাবেই এই উঠতি তারকাকে না চেনারই কথা। প্রশ্ন জাগতে পারে, কে এই ইউসুফ ফোফানা? ইউসুফের বাবা মালিয়ান এবং মা আইভোরিয়ান বংশোদ্ভূত। সুন্দর জীবনের আশায় তারা পাড়ি জমান ফ্রান্সে।

তাদের ঘর আলোকিত করে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে প্যারিসে জন্ম হয় ইউসুফের। সেখান থেকেই বেড়ে ওঠা এবং ফুটবলে হাতেখড়ি। ২০১৫ সালে শুরু হয় ক্যারিয়ার। শুরুর লগ্নটা ছিল একটি অপেশাদার ক্লাবের হয়ে। যুব পর্যায়ে কিছু অখ্যাত ক্লাবে খেলেন ইউসুফ। ২০১৭ সালে তাকে কিনে নেয় ফরাসি ক্লাব স্ট্রসবার্গ। এই ক্লাবের হয়ে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় তার। তিন বছর সেখানে কাটিয়ে তিনি নাম লেখান বিখ্যাত ক্লাব মোনাকোতে। আলো ছড়াতে থাকেন ক্লাবটির হয়ে। ইউসুফ নজরে আসেন ফ্রান্স কোচ দেশমের। ফ্রান্স ফুটবলকে প্যারিস সব সময়ই দুহাত ভরে দিয়েছে। এমবাপ্পে, পগবা, ব্লেইসি মাতুইদির জন্মস্থান এখানেই। এ ছাড়া কিংসলে কোমানও প্যারিসের উপহার। সেই শহর থেকেই উত্থান হয় ইউসুফের। যে শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে ফ্রান্স ফুটবলে। দেশটির ফুটবলকে প্যারিস উপহার দিল আরও একটি রতœকে। কিন্তু ইউসুফের এই স্বপ্নযাত্রা সহজ ছিল না। বড় ধাক্কাটা আসে মাত্র ১৫ বছর বয়সে। ফ্রান্স ন্যাশনাল একাডেমি থেকে বাদ পড়েন তিনি।

স্বাভাবিকভাবেই হতাশ হয়ে পড়েন ইউসুফ। ২০১৪-১৭ সাল, ওই সময়টাতে এই মিডফিল্ডার খেলা চালিয়ে যান অপেশাদার ফুটবল ক্লাব জেএ ড্রান্সির হয়ে। নিজের খরচ মেটাতে একটি রেস্টুরেন্টে পিৎজা ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন ইউসুফ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফ্রান্সের কোয়ার্টার ফাইনাল জয়ের আগে একটি সাক্ষাৎকারে ইউসুফ বলেছিলেন, ‘অর্থ উপার্জনের জন্য এটা দারুণ উপায় এবং নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এটাই ছিল সর্বোত্তম। আর আমি তা-ই করেছি। প্রথমে আমাকে চিন্তায় ফেলত এমন চ্যালেঞ্জ, তবে এটাও বড় সত্য যে, আপনাকে আপনার পথ বের করার উপায় জানতে হবে। এগিয়ে যাওয়ার পথটা খুঁজতে হবে। এটা ছোট কাজ ছিল; কিন্তু আমার লক্ষ্য থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারেনি। আমি এখান থেকেই অনুপ্রেরণা পেতাম।’

২০১৭ সালে ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট পেয়ে যান ইউসুফ। স্ট্রসবার্গ তাদের যুব একাডেমিতে তাকে থাকা-খাওয়া ও অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়। পরের বছরই স্বপ্নের অভিষেক অলিম্পিক লিওঁর বিরুদ্ধে। ফ্রান্সের শীর্ষস্থানীয় পেশাদার লিগ, লিগ ওয়ানে তাকে খেলার সুযোগ করে দেয় স্ট্রসবার্গ। সুযোগ পেয়ে নিজের জাত চেনান এই মিডফিল্ডার। স্ট্রসবার্গে ইউসুফের ফর্ম মোনাকোকে বাধ্য করছিল তাকে ডাকতে। ১৫ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে কিনে নেয় মোনাকো। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ইউসুফকে। তার স্বপ্নযাত্রা ছুটেই চলেছে। ক্লাব ক্যারিয়ারে আলো ছড়ানো এই মিডফিল্ডার ইতোমধ্যে ফ্রান্সের হয়ে ৭টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন।

এবার ফাইনালে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন তিনি। কে জানে স্বপ্নের মঞ্চে দেশের স্বপ্নপূরণে হয়তো অবদান রাখতে পারেন হার না মানা এই ইসুউফ। সেটাই দেখার বিষয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //