মেসির বিশ্বজয়, আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান

দক্ষিণ আমেরিকান এবং ইউরোপের মধ্যে এর আগে ১০ বার বিশ্বকাপ ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে ৭ বারই শেষ হাসি হেসেছিল ল্যাটিন আমেরিকানরা। কাতার বিশ্বকাপেও তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই মনে হচ্ছিলো। ২০১৮ বিশ্বকাপের শিরোপাজয়ী ফ্রান্সের বিপক্ষে ২-০ গোলে এগিয়ে শিরোপা উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আর্জেন্টিনা। তবে ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে দুই গোল করে ফ্রান্সকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন কিলিয়ান এমবাপ্পে।

অতিরিক্ত সময়ে আবারও লিওনেল মেসির গোলে এগিয়ে যায় আলবিসেলেস্তেরা। তবে ১১৭ মিনিটে এমবাপ্পের হ্যাটট্রিকে তৃতীয়বারের মতো সমতায় ফেরে ফরাসিরা। ফলে ২০০৬ বিশ্বকাপের পর আবারও কোনো বিশ্বকাপের ফাইনাল গড়ালো টাইব্রেকারে। পেনাল্টি শুটআউটের লটারিতে ফ্রান্সকে ৪-২ গোলে হারিয়ে তৃতীয়বারের সতো শিরোপা জিতলো আর্জেন্টিনা।

আজ রবিবার (১৮ ডিসেম্বর) কাতারের লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে সেমিফাইনালের অপরিবর্তিত একাদশ নিয়েই মাঠে নেমেছিল আর্জেন্টনা। পক্ষান্তরে, ক্যামেল ফ্লু ভাইরাসে শেষ চারের লড়াইয়ে অনুপস্থিত ডায়োট উপামেকানো আর আদ্রিয়েন রাবিওট ফিরেছিলেন ফ্রান্সের একাদশে। ম্যাচের শুরু থেকেই বল দখলে রেখে আক্রমণের চেষ্টা করে ফ্রান্সকে কোণঠানা করার চেষ্টারত ছিল আর্জেন্টিনা। যদিও আলবিসেলেস্তেরা পরিষ্কার আধিপত্য সৃষ্টি করতে পারছিল না।

ম্যাচের চতুর্থ মিনিটেই ফ্রান্সের ডি-বক্সের বাইরে থেকে গোলে শট নিয়েছিলেন অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার। তবে আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডারের শট নিজের আয়ত্বে নিতে অসুবিধা হয়নি ম্যানুয়েল নয়্যারকে ছাড়িয়ে বিশ্বকাপে গোলরক্ষক হিসেবে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড গড়া ফরাসি অধিনায়ক হুগো লরিসের।

ফাইনালের শুরু থেকে নড়বড়ে লাগছিল ফ্রান্সের থিও হার্নান্দেজকে। একবার তো ভুল পাস থেকে আর্জেন্টিনার রদ্রিগো ডি পলের পায়ে বল ঠেলে দিয়েছিলেন ফরাসি লেফটব্যাক। ১৬ মিনিটে আবারও থিওকে ধরাশায়ী করে আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসির সঙ্গে বল আদান-প্রদান করে ডান প্রান্ত থেকে আক্রমণে উঠেছিলেন ডি পল। তবে আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডারের বাড়ানো বলে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার শট লক্ষ্যে থাকেনি।

তবে মিনিট চারেক পর সেই ডি মারিয়াই পেনাল্টি এনে দেন আর্জেন্টিনাকে। ফ্রান্সের ওসমান ডেম্বেলে ডি-বক্সের ভেতর আর্জেন্টাইন উইঙ্গারকে অবৈধভাবে ট্যাকেল করলে পেনাল্টি পায় আলবিসেলেস্তেরা। ১২ গজ থেকে স্পটকিক থেকে লিওনেল মেসির লক্ষ্যভেদে এগিয়ে যায় লিওনেল স্কলোনির শিষ্যরা। কাতার বিশ্বকাপে এ নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো গোলের দেখা পেলেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক।

গোল হজম করে পিছিয়ে পড়ার পর আক্রমণে ওঠার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত ছিল ফ্রান্স। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের জন্য। প্রতি আক্রমণ থেকে গোল করে ব্যবধান দ্বিগুণ করে আর্জেন্টাইনরা। উপামেকানোর কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে ম্যাক অ্যালিস্টারের সঙ্গে বল দেওয়া-নেওয়া করে ফাঁকায় থাকা ডি মারিয়ার দিকে বল বাড়িয়ে দেন লিওনেল মেসি। দুরন্ত গতিতে আগুয়ান আর্জেন্টাইন উইঙ্গারের শট ঠেকাতে ব্যর্থ হন ফ্রান্স গোলরক্ষক লরিস। ডি মারিয়ার শটে বল জালে জড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। 

ম্যাচের শুরু থেকেই আর্জেন্টিনার দাপটে বিপর্যস্ত ছিল ফ্রান্স। কিলিয়ান এমবাপ্পে, আন্তোয়ান গ্রিজম্যান, অলিভিয়ের জিরুড, ওসমান ডেম্বেলের সমন্বয়ে গঠিত আক্রমণভাগ ন্যুনতম ত্রাস ছড়াতে পারেনি আর্জেন্টাইন রক্ষণে। প্রথমার্ধে দুই বর্ষীয়ান ফরোয়ার্ডের গোলে শিরোপা সুবাস নিয়েই মধ্যবিরতিতে যায় লাতিন পরাশক্তিরা।

মধ্যবিরতির পর দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আক্রমণের পর আক্রমণ করে ফ্রান্সের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করে আর্জেন্টিনা। ৪৮ মিনিটে ডান প্রান্ত থেকে লিওনেল মেসির বাঁকানো ক্রস থেকে হুলিয়ান আলভারেজ পা বাড়ালেই তৃতীয় গোল পেয়ে যেতো আলবিসেরেস্তেরা। মিনিট দুয়েক পর ক্রিস্টিয়ান রোমেরোর ইন্টারসেপশন থেকে বল পেয়ে বাঁ দিক থেকে আক্রমণে ওঠেন ডি মারিয়া। ডি মারিয়ার বাড়ানো বল থেকে ফাঁকায় থাকা রদ্রিগো ডি পলের ভলি তালুবন্দি করেন হুগো লরিস।

৫৯ মিনিটে আবারও ফ্রান্সের রক্ষণভাগে হানা দেয় লিওনেল স্কলোনির শিষ্যরা। কোলো মোয়ানির বাড়ানো বল নিজের দখলে নিয়ে হুলিয়ান আলভারেজের দিকে ঠেলে দেন আর্জেন্টিনার লেফটব্যাক নিকোলাস টাগ্লিফিয়াকো। তবে ডি-বক্সের বাঁ দিক থেকে তরুণ আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকারের নেওয়া শট ঠেকিয়ে ফ্রান্সকে ম্যাচে টিকিয়ে রাখেন লরিস।

মিনিট চারেক পর আবারও ফ্রান্সের উদ্ধারকর্তারূপে আবির্ভূত হন লরিস। প্রতি আক্রমণে ওঠা আর্জেন্টিনা অধিনায়ক বাঁ প্রান্ত থেকে বল বাড়িয়ে দেন ডি-বক্সের মাঝে আগুয়ান ম্যাক অ্যালিস্টারের দিকে। তবে আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার বলের নাগাল পাওয়ার আগেই তা বিপদমুক্ত করেন ফরাসি অধিনায়ক ও গোলরক্ষক।

দুই গোলের ব্যবধানে এগিয়ে নির্ভার আর্জেন্টিনা শিরোপা স্বপ্নে মেতে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো কিলিয়ান এমবাপ্পের আবির্ভাব। ৮০ মিনিটে কোলো মোয়ানিকে ডি-বক্সে অবৈধভাবে বাধা দেন আর্জেন্টিনার সেন্টারব্যাক নিকোলাস ওটামেন্ডি। পেনাল্টি থেকে এমবাপ্পের শট ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়েও ঠেকাতে পারেননি আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমি মার্টিনেজ।

পরের মিনিটেই আবারও এমবাপ্পে ঝলক। লিওনেল মেসির হারানো বল ধরে শানানো আক্রমণে থুরামের বাড়ানো বল বক্সে পেয়ে দারুণ ভলিতে ফরাসিদের সমতায় ফেরান এমবাপ্পে। এর মাধ্যমে কাতার বিশ্বকাপে সপ্তম গোল করে গোল্ডেন বুটের দৌড়েও এগিয়ে যান ফরাসি উইঙ্গার।

যোগ করা আট মিনিট সময়ের তৃতীয় মিনিটে আর্জেন্টাইন রক্ষণকে ঘোল খাইয়ে এমবাপ্পে জোরালো শট নেন। যদিও তা ওটামেন্ডির গায়ে লেগে প্রতিহত হয়। পরের মিনিটেই আবারও আর্জেন্টাইন রক্ষণে হানা ফরাসিদের। কিংসলে কোম্যানকে ফাউর করলেও কামাভিঙ্গার মাধ্যমে বল পান কোলো মোয়ানি। তবে তার প্রচেষ্টা ঠেকিয়ে দেন মার্টিনেজ।

যোগ করা সময়ের শেষদিকে ডি-বক্সের বাইরে থেকে জোরালো শট নেন লিওনেল মেসি। তবে আর্জেন্টাইন অধিনায়কের জোরালো শট হুগো লরিস কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধে দুই দলই সমানে আক্রমণ চালালেও কেউই গোলের দেখা পায়নি। এ কারণে অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্যভাবেই।

তবে অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে ঠিকই এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। ১০৮ মিনিটে ডান দিক থেকে লাউতারো মার্তিনেসের বুলেট গতির কোনাকুনি শট কোনোমতে ফেরান হুগো লরিস, তবে বল হাতে রাখতে পারেননি তিনি। গোলমুখে বল পেয়ে ডান পায়ের টোকায় দলকে উচ্ছ্বাসে ভাসান মেসি। বিশ্বকাপে গোলসংখ্যার দিক থেকে পেলেকে (১২) ছাড়িয়ে যান আর্জেন্টিনা অধিনায়ক।

আর্জেন্টিনার তৃতীয় গোলের পর ফ্রান্স আর ম্যাচে ফিরতে পারবে না বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু এমবাপ্পের শটে ডি-বক্সের ভেতর গন্জালো মন্তিয়েল হ্যান্ডবল করলে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। সেখান থেকে গোল করে ফরাসিদের তৃতীয়বারের মতো সমতায় ফেরান এমবাপ্পে। এই গোলের মাধ্যমে জিওফ হার্স্টের পর দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্রিক গড়েন এমবাপ্পে। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করে ফেলেন কাতার বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুটও।

অতিরিক্ত সময়ের শেষদিকে আবারও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল ফ্রান্স। তবে কোলো মোয়ানির শট দারুণ দক্ষতায় পা দিয়ে আটকে আর্জেন্টিনাকে ম্যাচে টিকিয়ে রাখেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। ম্যাচের বাকি সময়ে গোল না হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে।

ফ্রান্সের প্রথম শট নিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। বুলেট গতির শটে জাল খুঁজে নিলেন তিনি। আর্জেন্টিনার প্রথম শট নিলেন লিওনেল মেসি। হুগো লরিস ঠিক দিকেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঠেকাতে পারেননি।

ফ্রান্সের দ্বিতীয় শট নিলেন কিংসলে কোমান। ডানদিকে ঝাঁপিয়ে ঠেকিয়ে দিলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ! আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় শট নিলেন পাওলো ডিবালা। ডাইভ না দিলেই বল পেয়ে যেতেন লরিস। তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেদিক দিয়ে জাল খুঁজে নিলেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড দিবালা। ফ্রান্সের তৃতীয় শট নিলেন অঁরেলিয়েন শুয়ামেনি। তিনি মারলেন বাইরে।

আর্জেন্টিনার তৃতীয় শট নিলেন লেয়ান্দ্রো পারেদেস। তিনি খুঁজে নিলেন জাল। ৩-১ গোলে এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা। ফ্রান্সের চতুর্থ শটে গোল করলেন রন্দাল কোলো মুয়ানি। টিকে থাকল ফরাসিদের আশা।

ঠাণ্ডা মাথার শটে জাল খুঁজে নিলেন গনসালো মনতিয়েল। বিশ্ব জয়ের আনন্দে মেতে উঠল আর্জেন্টিনা। ৩-৩ গোলে মূল ম্যাচ সমতায় শেষ হওয়ার পর টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে জিতে উল্লাসে মাতলো আর্জেন্টিনা! 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //