নিশ্চিত করতে হবে খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা

বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠার উপলক্ষ আসে কালে-ভদ্রে। কিন্তু নেতিবাচক ঘটনায় মাথা হেঁট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে প্রায়ই। মাঠের ফল বিপর্যয়, কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় নানা সময়ে কলুষিত হয়েছে দেশের ফুটবল। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের পাঁচ ফুটবলার ভয়াবহ কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছেন, যা দেশের স্বাধীনতার ৫২ বছরের ইতিহাসে ঘটেনি।

সেপ্টেম্বরে এএফসি কাপে মাজিয়া স্পোর্ট অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাবের বিপক্ষে খেলতে মালদ্বীপ গিয়েছিল বসুন্ধরা কিংস। মালেতে অনুষ্ঠিত ম্যাচটি বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়নরা হেরেছে ১-৩ গোলে। ১৯ সেপ্টেম্বর ম্যাচ খেলে পরদিন দেশে ফেরে বসুন্ধরা কিংস। কিন্তু হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে ঘটে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। কিংসের পাঁচ ফুটবলারের লাগেজ থেকে কাস্টমস কর্মকর্তারা উদ্ধার করে ৬৪ বোতল মদ। অবৈধ মদ নিয়ে ধরা পড়া পাঁচ ফুটবলার হলেন- তপু বর্মণ, আনিসুর রহমান জিকো, তৌহিদুল আলম সবুজ, শেখ মোরসালিন ও রিমন হোসেন। এদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে বসুন্ধরা কিংস। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ফুটবলারদের। কিংসের সভাপতি ইমরুল হাসান বলেছেন, ‘ফুটবলাররা নীতিহীন কাজ করেছেন। আপাতত তাদের সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পুরো তদন্তের পর চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়া হবে।’

নিষেধাজ্ঞায় সায় দিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। অভিযুক্তরা আপাতত জাতীয় দলে বিবেচ্য হবে না। ১২ অক্টোবর মালদ্বীপের বিপক্ষে বিশ্বকাপ প্রাক-বাছাইয়ে মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। কোচ হ্যাভিয়ের কাবরেরার স্কোয়াডে জায়গা পাননি তারা কেউ। তপু, জিকো আর মোরসালিনরা যে অপরাধ করেছেন সেটার দায়ভার বাংলাদেশকে বইতে হয় কিনা কে জানে! তারা প্রত্যেকেই জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ম্যাচটিও সাধারণ কোনো ম্যাচ না। দুই লেগের প্রাক-বাছাই পর্ব পেরুতে না পারা বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য হবে বিপর্যয়। বাদ পড়তে হবে বিশ্বকাপ বাছাই থেকে। আগামী এক থেকে দেড় বছর বাংলাদেশকে ফিফা আয়োজিত ম্যাচ পেতে হা-পিত্যেশ করতে হবে।

ফুটবলারদের মদ নিয়ে ধরা পড়ার ঘটনা সাধারণ নয়। তপু আর সবুজ বয়োজ্যেষ্ঠ। জিকোর বয়সও কম না। তুলনায় ১৮ বছরের মোরসালিন কিংবা রিমনদের ক্যারিয়ার মাত্র শুরু। মোরসালিন তো এক বছরের মধ্যে ক্লাব আর জাতীয় দলে দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্সে ‘তারকা’ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুতেই তারা জড়িয়ে পড়লেন মাদক কেলেংকারিতে। অতীতে মাদককা-ে বিশ্বের বহু তারকা ফুটবলারের ক্যারিয়ার ধ্বংসের মুখে পড়েছে। আর্জেন্টিনার ফুটবল ঈশ্বর দিয়াগো ম্যারাডোনা সব জিতেও নিন্দা-কলংকিত হয়েছেন মাদকাসক্তির জন্য। অ্যালকোহলিক জর্জ বেস্টের মতো ক্ষণজন্মা ফুটবলারের জন্য আফসোস করে সমর্থকরা। বাংলাদেশের ফুটবলারদের মধ্যে অতীতে কারও কারও বিরুদ্ধে মদ-মাদক নিয়ে কানাঘুষা থাকলেও সরাসরি প্রমাণ হয়নি। কিন্তু মোরসালিন আর তপুরা লজ্জায় ডুবিয়েছে ফুটবলকে। কিন্তু তাদের কঠিন শাস্তির পক্ষে নয় কেউ। বরং তাদের প্রতি কঠোর ‘হুঁশিয়ারি’ জারি করে নজরদারিতে রাখা নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি উঠতি খেলোয়াড়রা যাতে এমন কাণ্ডে না জড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে বাফুফে কর্মকর্তাদের। প্রয়োজনে বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করতে হবে কাউন্সেলিং।

শুধু খেলোয়াড় নয়, ফুটবল কর্তাদেরকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনার সময় হয়েছে। চলতি বছরই ফিফা কর্তৃক দুর্নীতির দায়ে নিষিদ্ধ হন বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ, বাফুফে পদ থেকেও বহিষ্কৃত হন তিনি। যদিও সোহাগ দরপত্রে অনিয়ম আর জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু বাফুফের নিজস্ব তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সোহাগ দোষী প্রমাণ হয়েছেন। মূলত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাফুফের প্রধান নির্বাহীর ভূমিকায় থাকা সোহাগের ওপর ফিফার আনা সব অভিযোগের দায় চাপানো হয়েছে। এ ঘটনায় বাফুফের তদন্ত কমিটি জুলাইয়ে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের কাছে রিপোর্ট পেশ করে; যা সম্প্রতি নির্বাহী কমিটির সভায় প্রকাশ করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আবু হোসেন, সহকারী অর্থ কর্মকর্তা অনুপম সরকার ও ম্যানেজার অপারেশন মো. মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আবু হোসেন ও মিজানুর রহমান চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অন্য দুজন গ্রাসরুট ম্যানেজার হাসান মাহমুদ ও ম্যানেজার কম্পিটিশন জাবের বিন তাহের আনসারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বাফুফের অন্যতম সহ-সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদ। 

সাধারণ সম্পাদকসহ কতিপয় কর্তাব্যক্তির দুর্নীতি আর খেলোয়াড়দের মদকা- দেশের ফুটবলের জন্য অশনিসংকেত। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, নেতিবাচক ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে এসেছে। তাই বাফুফের সামনে সুযোগ রয়েছে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নত করার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //