কর্পোরেট দাপটে অসহায় ঐতিহ্যবাহীরা

বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে চলছে বসুন্ধরা কিংসের দাপট। ২০১৮-১৯ মৌসুমে পেশাদার লিগে অভিষেকের পর টানা পাঁচ শিরোপা জয়ে দলটি গড়েছে অবিস্মরণীয় রেকর্ড। কিংসের দাপটে ঢাকা আবাহনী কিংবা মোহামেডানের মতো সফল দলগুলো রীতিমতো কোণঠাসা। অন্যরাও বসুন্ধরার তুলনায় যোজন ব্যবধানে পিছিয়ে। কিন্তু কেন?

দেশের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বসুন্ধরা কিংসের পেছনে রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ। ক্লাবের সভাপতি ইমরুল হাসান নিজেই জানিয়েছেন, ‘যে কোনো ক্লাবের সফলতার মূল শর্ত শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি। প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। জনশক্তি মানে শুধু খেলোয়াড়রা নন। টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে সাপোর্টিং স্টাফের দক্ষতায় সফলতা আসে।’

মোটা পারিশ্রমিকে জাতীয় দলের সিংহভাগ খেলোয়াড় কিংসের ডেরায়। আনা হচ্ছে উঁচুমানের বিদেশি খেলোয়াড়। রয়েছে দক্ষ কোচিং স্টাফ। খেলোয়াড়দের অনুশীলন থেকে শুরু করে ফিটনেস রক্ষায় কিংসের  জিমনেশিয়াম ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিক মানের। নিজস্ব স্টেডিয়াম ‘কিংস অ্যারেনা’ তৈরি করে বসুন্ধরা সৃষ্টি করেছে অনন্য ইতিহাস। অথচ মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের স্থায়ী অনুশীলন মাঠই নেই। মোহামেডান কিংবা আবাহনীসহ বাংলাদেশের কোনো ক্লাবের নিয়মিত আর্থিক জোগান নেই। দলগুলো ব্যক্তিগত অনুদাননির্ভর। এক সময় দৈনন্দিন খরচ মেটাতে ক্লাবগুলোতে হাউজির আসর ছিল ওপেন সিক্রেট। বিভিন্ন কর্পোরেট হাউস বিভিন্ন সময় স্পন্সর হিসেবে ক্লাবগুলোর পেছনে দাঁড়ালেও স্থায়িত্ব পায় না। ফলে প্রায়শই ক্লাবগুলোকে স্পন্সর খুঁজতে হয় হন্যে হয়ে।

ইউরোপের ম্যানচেস্টার সিটি, পিএসজি কিংবা এসি মিলানের মতো দলের মালিকানায় রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত কোনো না কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ক্লাবগুলোর পেছনে যাদের রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ। ফলে খেলোয়াড় কেনা থেকে শুরু করে ক্লাব পরিচালনা নিয়ে বাড়তি ভাবনা নেই। কিংসের সভাপতি জানিয়েছেন, ‘অর্থের নিশ্চয়তা না পেলে কোনো ক্লাব পরিচালনা করা কঠিন। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ব্যক্তি-অনুদান নির্ভর হয়ে কোনো ক্লাবের সাফল্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রতিটা ক্লাবের পেছনে কর্পোরেট পাওয়ার হাউসের সমর্থন থাকলে সংগঠকরাও ক্লাব পরিচালনায় স্বাচ্ছন্দ্য পায়। কর্পোরেট হাউসগুলো পছন্দের ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসুক। নতুবা নিজেরা ক্লাব গঠন করুক।’

সাবেক ফুটবলার হাসানুজ্জামান খান বাবলু বলেছেন, ‘শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি, সাংগঠনিক দক্ষতা আর সেরা কিছু করার প্রত্যয় থাকলে সফলতা পাওয়া কতটা সহজ, তা বসুন্ধরা কিংস দেখাচ্ছে।’ ১৯৯৯ সালে এসএ গেমসের শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ দলের সদস্য মিজানুর রহমান ডন বলেন, ‘যতদূর জানি, বসুন্ধরা সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক দিয়ে খেলোয়াড়দের দলে ভেড়ায়। তাই সেরারা কিংসে নাম লেখায়। মোহামেডান কিংবা আবাহনীর মতো দল নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী না করলে পিছিয়ে পড়বেই।’

দ্বিমতও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, বসুন্ধরার মতো দলগুলোকে নিয়ে আলাদা কর্পোরেট লিগ চালু করা উচিত। তাতে ফুটবলাররা বাড়তি আয়ের সুযোগ পাবে। আবার মূলধারার দলগুলো অসম প্রতিযোগিতায় মুখ 

থুবড়ে পড়বে না। বাংলাদেশে ক্রিকেট আর হকি ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছে ফ্র্যাঞ্চাইজি যুগে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনও এক সময় ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ’ আয়োজন নিয়ে বেশ সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে চাপা পড়ে আছে সে উদ্যোগ।

কর্পোরেট হাউসগুলোর নিজস্ব ক্লাব গড়া উচিত নাকি নিয়মিত ‘স্পন্সর’ হিসেবে পুরনো ক্লাবগুলোর পেছনে দাঁড়ানো উচিত-এটা বিতর্কের বিষয়। তবে এটা ঠিক, কর্পোরেট দল হলেও সঠিক পরিকল্পনা আর নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকলে সফল হওয়া সম্ভব না। যার প্রমাণ সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব। ২০১৭-২২ পর্যন্ত চার মৌসুম খেলেছে পেশাদার লিগে। শুরুতেই বিদেশে ক্যাম্প, বিদেশি কোচ, বিগ বাজেটের দল নিয়ে আলোচনায় ছিল দলটি। ২০১৮ সালে ভারতের আসামের আমন্ত্রণমূলক বাদোসা কাপের শিরোপা জিতে চমকও দেখায়। কিন্তু বাফুফের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে পেশাদার লিগ থেকে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //