মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী, দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যাল্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান। মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষটি আপাদমস্তক একজন ক্রীড়াপ্রেমীও। সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) নির্বাচনে সহ-সভাপতি হিসেবে পেয়েছেন সর্বোচ্চ ভোট। আগামী ৪ বছর বাফুফের অন্যতম শীর্ষকর্তা হিসেবে শামিল থাকবেন বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নের মহাযজ্ঞে।
খেলাধুলার সাথে তার সম্পর্ক নিবিড়। ২০১১ সালের ১৪ মে যশোরে গড়ে তোলেন ‘শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমী’, যা দেশের প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ফুটবল একাডেমি। জাতীয় দল থেকে দেশের বিভিন্ন শীর্ষক্লাব এবং বয়সভিত্তিক দল মাতাচ্ছে শামস-হুদা-একাডেমী থেকে দীক্ষা পাওয়া ফুটবলাররা। এ ছাড়া কিশোর-তরুণদের বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নকে উস্কে দেওয়ার কাজটাও করে যাচ্ছে নাসের শাহরিয়ার পরিচালিত এই একাডেমি।
সমাজসেবা কিংবা খেলাধুলায় পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছেন নিভৃতে। কখনও কোনো ক্রীড়া ফেডারেশনের সাথে জড়াননি। তবে কেন ফুটবলের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খেলার অভিভাবক প্রতিষ্ঠানে নিজেকে জড়ালেন তিনি?
নাসের শাহরিয়ারের ভাষায়, ‘আমি খেলাধুলাকে হৃদয় দিয়ে ধারণ করি। আপনারা জানেন, আমার একাডেমির নামকরণ করা হয়েছে মরহুম শামস-উল-হুদা সাহেবের নামে। তিনি আমার ফুফা। শ্বশুরও। তিনি খেলোয়াড় এবং সংগঠক হিসেবে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। আমি দেখেছি, যশোর অঞ্চলের যুব সমাজ আর খেলাধুলার উন্নয়নে তার অক্লান্ত পরিশ্রম। যশোর স্টেডিয়াম গড়ে তোলার পেছনে মানুষটা নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। এখন তার নামেই যশোর স্টেডিয়াম স্বীকৃতি পেয়েছে।’
নাসের শাহরিয়ার জানান, ‘আমি মূলত মরহুম শামস-উল-হুদার জীবন দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, খেলাধুলার মাধ্যমেই সুস্থ আর মানবিক জাতি গড়ে তোলা সম্ভব। আমিও আমার একাডেমির মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল সুনাগরিক গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। তবে আমি কখনও খেলাধুলার কোনো ফেডারেশনে নিজেকে জড়াতে চাইনি। এটা হুট করেই হয়েছে। বলতে পারেন শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে যারা ফুটবলের সাথে জড়িত, তাদের অনুরোধেই বাফুফে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। মনোনয়ন সংগ্রহের সময় আমি সিংহভাগ কাউন্সিলরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না। অথচ তাদের ভোটেই বাফুফের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। বলা যায়, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর সবার সাথে পরিচয়। অনেকের সাথে প্রথম দেখাও। তবে মাননীয় কাউন্সিলররা ব্যালটের মাধ্যমে আমাকে যেভাবে সমর্থন দিয়েছেন, তা অভাবনীয়। আমি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ। সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হওয়া অবশ্যই আনন্দের। তবে চ্যালেঞ্জটাও অনেক বড়।’
ফুটবল বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের খেলা। কিন্তু ফুটবল নিয়ে কাজ করা বর্তমানে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। গত প্রায় দুই দশকে দেশের ঘরোয়া ফুটবল হারিয়েছে জনপ্রিয়তা। জেলাভিত্তিক লিগগুলো মাঠে গড়ায় কালেভদ্রে। এ ছাড়া বিগত সময়ে ফুটবল সংশ্লিষ্ট অনেকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম আর ব্যর্থতার অভিযোগ এসেছে প্রকাশ্যে।
এ বিষয়ে নাসের শাহরিয়ার জাহেদী জানান, ‘হ্যাঁ, বাংলাদেশের ফুটবল খুব ভালো অবস্থানে নেই। তবে সব আশা শেষ হয়ে যায়নি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের ফুটবলকে জাগাতে তৃণমূল পর্যায়ে নজর দেওয়া খুব জরুরি। প্রতিটা জেলার ফুটবল সংস্থাকে শক্তিশালী আর সক্রিয় হতে হবে। ৬৪ জেলার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের জন্য মানসম্পন্ন আলাদা স্টেডিয়াম বরাদ্দ হওয়া দরকার।’
খেলার মাঠে দর্শক ফিরিয়ে আনা নিয়েও নাসের শাহরিয়ারের পরিকল্পনা রয়েছে, ‘বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পেশাদার ফুটবল লিগে দর্শক হয় না। অথচ একটা সময় ঢাকা লিগের খেলা দেখতে ফুটবল অনুরাগীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল সাধারণ ঘটনা। এখন কেন হয় না? এখন বেশিরভাগ খেলা হয় দিনের বেলা। অথচ ওয়ার্কিং ডেতে অনেক বড় ফুটবলপ্রেমীর জন্যও কাজ ফেলে বিকেল তিনটা/চারটার সময় মাঠে ছুটে আসা মুশকিল। একই খেলা সন্ধ্যার পর আয়োজন করা হলে স্টেডিয়াম ভরে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই আমাদের এখন স্টেডিয়ামগুলোতে ফ্লাড লাইটের ব্যবস্থা করার কথা জরুরিভিত্তিতে ভাবতে হবে।’
শাহরিয়ার জাহেদী ভুল বলেননি। বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালি সময় ধরা হয় সত্তর থেকে নব্বই দশককে। সেই সময় ঢাকা কিংবা মিরপুর স্টেডিয়ামে বেশিরভাগ বড় ক্লাবের খেলা আয়োজন হয়েছে কৃত্রিম আলোয়। অর্থাৎ ফ্লাড লাইটের উজ্জ্বলতায়। মাঠেও দর্শকের অভাব হয়নি।
বাংলাদেশে বর্তমানে মানসম্পন্ন ফুটবলার খুব বেশি উঠে আসছে না। তাতে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে লাল সবুজের দেশ। বাফুফে নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১১৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত সহ-সভাপতি জানান, ‘খেলোয়াড় তৈরির জন্য একাডেমির কোনো বিকল্প নেই। একাডেমি হচ্ছে ফুটবলার তৈরির আঁতুড়-ঘর। ইউরোপসহ ফুটবলে উন্নত প্রতিটা দেশের ক্লাবগুলোর নিজস্ব একাডেমি রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ফুটবলার তৈরির কাজ চলছে হরদম। আমাদেরও ফুটবল একাডেমি গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শুরুতে অন্তত আটটি জেলার প্রতিটিতে একাডেমি গড়ে তুলতে হবে। আপনি ফুটবল ফেডারেশন আর ফুটবল উন্নয়ন নিয়ে কথা বলবেন, কিন্তু আপনার কোনো কার্যকর একাডেমি নেই- তাহলে তো হবে না। আশার কথা হচ্ছে, বাফুফের নবনির্বাচিত সভাপতি জনাব তাবিথ আউয়াল ফুটবল নিয়ে আধুনিক চিন্তায় মগ্ন একজন মানুষ। তিনি জেলা পর্যায়ে ফুটবলকে জাগাতে চান। জোর দিতে চান একাডেমির দিকেও। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে মাননীয় ক্রীড়া উপদেষ্টা জনাব আসিফ মাহমুদ বাফুফেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন।’
নাসের শাহরিয়ার দৃঢ় ভাষায় জানান, ‘ফুটবল উন্নয়নে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। ফুটবল ফেডারেশন মূল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। ফুটবলের জন্য সরকারি সহায়তাও জরুরি। এ ছাড়া ফেডারেশনের সাথে ক্লাব, জেলা ফুটবল সংস্থা আর স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে স্বল্প সময়ে দেশের ফুটবলের দৃশ্যমান উন্নয়ন খুবই সম্ভব। আমাদের এখন দেশের ফুটবলকে জাগাতে হবে। দেশের ফুটবল জাগলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সুফল পাওয়া যাবে।’
নাসের শাহরিয়ার জাহেদী জানান, ‘আমি আশা করছি, জনাব তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্ব আর দিক-নির্দেশনায় ফুটবল উন্নয়নে আমরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারব। তবে আমি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। আগামী ৪ বছর আমাদের কাজের মূল্যায়ন করার সুযোগ আপনাদের সামনে থাকছে।’
শামস-উল-হুদা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা জানান, দেশের ফুটবলকে এগিয়ে নিতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এই জন্য প্রয়োজন কার্যনির্বাহী পরিষদের পারস্পরিক সহযোগিতা আর সম্মানবোধ। আমি মনে করি, বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় যা কিছু সম্ভব; আমরা করব ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সাল থেকে ক্রীড়াঙ্গনে শুরু হয় নির্বাচনী ব্যবস্থা। এসএ সুলতান বাফুফের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। কাজী সালাউদ্দিন ছিলেন দ্বিতীয় সভাপতি। ২০০৮ সাল থেকে চার মেয়াদে সভাপতি ছিলেন তিনি। এবার তিনি নির্বাচনে অংশ নেননি। তাবিথ আউয়াল বাফুফের তৃতীয় সভাপতি। আর সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বসুন্ধরা কিংস প্রেসিডেন্ট জনাব ইমরুল হাসান। সহ-সভাপতি পদে নাসের শাহরিয়ার জাহেদী ছাড়াও জয়ী হয়েছেন ফাহাদ মোহাম্মদ আহমেদ করিম, সাব্বির আহমেদ আরেফ আর ওয়াহিদউদ্দীন চৌধুরী হ্যাপি। নির্বাহী কমিটিতে রয়েছে ১৫টি সদস্য পদ।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh