বিদেশে কেন কমছে কর্মসংস্থান

বিদেশের শ্রমবাজারগুলো বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বড় কর্মসংস্থান। ২০১৭ সালে রেকর্ডসংখ্যক ১০ লাখ ৮ হাজার বাংলাদেশি চাকরি নিয়ে বিদেশ যান। পরের বছর ২৭ শতাংশ কমে যায়। গত বছর ৭ লাখ ৩৪ বাংলাদেশি চাকরি পান বিদেশে। 

চলতি বছরে পতন অব্যাহত রয়েছে। বছরের প্রথম ১০ মাসে ৪ লাখ ৭০ হাজার ২৬৫ জন বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশে গেছেন, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ কম। এ বছরে ফেরত এসেছেন প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে গেছে। বিনিয়োগ, উৎপাদন কমেছে। তাই আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারগুলোতে চাকরির সুযোগ কমেছে। বাংলাদেশিরাও এর শিকার। তেলের দরপতনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো নেই, তার খেসারত দিচ্ছে বাংলাদেশ। মধ্যপ্রাচ্যই বাংলাদেশিদের প্রধান শ্রমবাজার। এসব কারণে জনশক্তি রপ্তানি কমে গেছে। 

তবে জনশক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া একটি মাত্র কারণ। আগের বছরের তুলনায় নেপাল, পাকিস্তান, ফিলিপাইনের জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে ২০১৮ সালে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার মূল কারণ জনশক্তি খাতে নৈরাজ্য ও দক্ষ জনশক্তির অভাব। 

জনশক্তি, কর্মস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে যে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ বাংলাদেশি চাকরি নিয়ে বিদেশ গিয়েছেন, তাদের মধ্যে মাত্র দুই হাজার ৬৫৩ জন পেশাদার। যাদের পেশাগত বিশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা রয়েছে। এ হিসেবে মাত্র শূন্য দশমিক তিন শতাংশ বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী কাজ নিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন। এ শ্রেণিতে রয়েছেন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ, গবেষক, মানবসম্পদ কর্মকর্তা ও ব্যবসায় প্রশাসনে ডিগ্রিধারীরা।

সরকারি হিসেবে গত বছর ৩ লাখ ১৭ হাজার ৫২৮ জন ‘দক্ষ’ কর্মী বিদেশ গিয়েছেন। এ শ্রেণিতে রয়েছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা। ১ লাখ ১৭ হাজার ‘আধাদক্ষ’ কর্মী বিদেশ গেছেন গত বছর। বাকি ২ লাখ ৮৩ হাজার ছিলেন অদক্ষ কর্মী। 

কিন্তু ‘দক্ষ’ কর্মী হিসেবে যারা বিদেশ গিয়েছেন তাদের অধিকাংশের দক্ষতা ‘কাগুজে’। 

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিব বলেছেন, দক্ষ শ্রমিক মানে যার ন্যূনতম ছয় মাসের প্রশিক্ষণ রয়েছে। কিন্তু কেন কাজ না শিখে বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সনদ কিনে ‘দক্ষ’ বনে যাচ্ছে। সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) থেকে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ বাংলাদেশি কর্মীরা বিদেশ গিয়ে এ কারণে বিদেশে গিয়ে ভালো কাজ পায় না। দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা কমে যাচ্ছে।

সাতদিন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকদের সরকারি ভাষায় ‘আধা-দক্ষ’ কর্মী বলা হয়। গত বছর এ ক্যাটাগরিতে ১ লাখ ১৭ হাজার কর্মী বিদেশ গিয়েছেন। 

জনশক্তি রপ্তাতিকারক থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, যাদের ‘আধাদক্ষ’ বলা হচ্ছে, আদতে তাদের কোনো দক্ষতাই নেই। 

সাবেক প্রবাসী কল্যাণ সচিব খন্দকার ইফতেখার হোসেন বলেছেন, সাতদিন প্রশিক্ষণ দিয়ে কাউকে দক্ষ করা যায় না।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সি আর আববার বলেছেন, ‘বাংলাদেশে দক্ষ পেশাজীবীর খুব সংকট। বাংলাদেশে অধিকাংশ বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদগুলোতে রয়েছে বিদেশিরা। গার্মেন্টস, অটোমোবাইল, প্রযুক্তি, ইস্পাত, অবকাঠামো নির্মাণকারী সব প্রতিষ্ঠানে একই চিত্র। দেশেই যখন পেশাজীবী দক্ষ জনবলের এমন সংকট, তখন বাংলাদেশ বিদেশে কীভাবে জনবল রপ্তানি করবে!’

তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে রয়েছে ভারতীয়রা। আর ঝুঁকিপূর্ণ, নোংরা নিম্নপদস্থ কাজে রয়েছে বাংলাদেশিরা। একজন ভারতীয় যে বেতন পান, তা শতাধিক বাংলাদেশি কর্মীর চেয়ে বেশি। তাই লাখ লাখ অদক্ষ কর্মী পাঠানোর চেয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা সৃষ্টি করে কর্মী পাঠানো উচিত।’

জনশক্তি রপ্তানিকারক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সাবেক সভাপতি আবুল বাশার বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যসহ সব জায়গাতেই বাংলাদেশিদের জন্য সুযোগ ছিল। কিন্তু দক্ষ কর্মীর অভাবে বাংলাদেশ সুযোগ নিতে পারেনি। এ কারণে প্রতি বছর কর্মী রপ্তানি কমছে। ৭০ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করে। ফলে বছরে দেশ ১৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পায়। ফিলিপাইনের ২৫ থেকে ৩০ লাখ কর্মী বিদেশে কাজ করে। তারা বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়।’ 

বায়রার সাবেক মহাসচিব আবুল মনসুর কালাম বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে, মালয়েশিয়ার নাগরিকরা এক সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ, নোংরা ও কম বেতনের কাজ করত না। তাই এসব কাজে অদক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক নেয়া হতো কম বেতনে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশগুলোতে বেকারত্ব বেড়েছে। স্থানীয় নাগরিকরাই কম বেতনে কাজ করছে। তাই বাংলাদেশিদের চাকরি কমে গেছে। শুধু দক্ষদের জন্য চাকরি আছে। কিন্তু বাংলাদেশি শ্রমিকদের দক্ষতা নেই।’ 

বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার আরেক কারণ জনশক্তি খাতে অনিয়ম। কর্মী পাঠাতে দুর্নীতির কারণে গত বছর বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। এখনো দেশটির শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্য। জিটুজি প্লাস চুক্তি অনুযায়ী, মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের কাছ থেকে অভিবাসন ব্যয় বাবদ সর্বোচ্চ এক লাখ ৬০ হাজার টাকা নেয়ার শর্ত ছিল; কিন্তু এখানকার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়। তারা মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে ভিসা কিনে আনে। জিটুজি প্লাসে প্রায় তিন লাখ কর্মী মালয়েশিয়া গিয়েছেন। এতে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে বলে মালয়েশিয়ার অভিযোগ।

অনিয়মের অভিযোগ তুলে কর্মী নেয়া বন্ধ রেখেছে আরব আমিরাত। খুলছে না ইউরোপের শ্রমবাজার। অনিয়ম চলছে সৌদি আরবের শ্রমবাজারেও।

সরকারি শর্তানুযায়ী, কর্মীর কাছ থেকে অভিবাসন ব্যয় বাবদ এক লাখ ৬৫ হাজার টাকার বেশি নেয়া যাবে না। কিন্তু এজেন্সিগুলো এক সময় ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। এখনো চার লাখ টাকা নিচ্ছে। দুই বছরের ভিসায় চাকরি করতে সৌদি আরব গিয়ে কর্মীরা তাদের বিদেশ যাওয়ার খরচই তুলতে পারছে না। এ কারণে কর্মীরা কাজের অনুমতির (অকামা) শর্ত লঙ্ঘন করে, যেখানে কাজ করার কথা সেখান থেকে পালিয়ে অন্যত্র কাজ করে। বাড়তি কাজ করতে বাধ্য তারা। শুধু এই দুই কারণে চলতি বছরে সৌদি আরব থেকে ১৯ হাজার কর্মী ধরা পরে ফেরত এসেছে।

জনশক্তি রপ্তানি কমার কথা স্বীকার করে প্রবাসী কল্যাণ সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বলেছেন, তারা সংখ্যা নয়, নিরাপদ অভিবাসনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে, যারা বিদেশ যাচ্ছেন, তারা যেন ভালো থাকেন। তাই গণহারে বিদেশ পাঠানোর চেয়ে যারা যোগ্য তাদের পাঠানো হচ্ছে। এ কারণে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে বলে তিনি দাবি করেন।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //