ডেঙ্গু রুখতে পরিকল্পনা কী

পৃথিবীতে যত সফল মানুষ আছেন বা ছিলেন, সবার মধ্যে কিছু মিল আছে। তার একটি হলো- ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া। তাই তো ‘ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত’- কথাটি জীবনে মোটামুটি সবাই শুনে থাকি; কিন্তু আমরা আসলে কোনো শিক্ষাই নিই না। 

গত মৌসুমে ডেঙ্গু যে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়ায়, সবাই ভেবেছিল- এবার বুঝি মৌসুম শুরুর আগেই এডিসসহ সব মশার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা হবে। আসলে আমাদের দায়িত্বশীলরা কথায় কামান দাগাতে যতটা ওস্তাদ, ততটা কাজে নন। তার প্রমাণ মেলে ঢাকায় মশার বংশবৃদ্ধি দেখেই। ওষুধের কার্যকারিতা, সেই সাথে পর্যাপ্ততা নিয়েও অনেক আলোচনা। শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে গত বছর হাইকোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। তাতেও ছড়িয়ে পড়া মশা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। উপায় না দেখে ঢাকার দুই মেয়র তো তখন ভাগ্যের হাতেই মশাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। ডেঙ্গু থেকে রক্ষায় বৃষ্টি থামানোর প্রার্থনাই যেন ছিল তাদের শেষ ভরসা।

শুধু তা-ই নয়, নিজেদের ব্যর্থতার দায় সাধারণের ওপর চাপিয়ে আদায় করা হয় জরিমানাও।

বসন্ত হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে শীত। বাড়ছে তাপমাত্রা। এরই সাথে পাল্লা দিয়ে মৌসুমের শুরুতেই রাজধানীতে বেড়ে গেছে মশার উৎপাত। এতে নগরবাসীর মনে আবারো ভর করছে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর ভয়। কারণ গত বছর ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন দেড় শতাধিক লোক। গোটা দেশে লাখ ছাড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা। দুই সিটি কর্পোরেশন এবার নানা পদক্ষেপের কথা বললেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল বলেই মনে করছেন শহরবাসী। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও এখন সারাবছরই তা ছড়ানোর আশঙ্কা। এর মধ্যে ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন ঢাকায় মশার ঘনত্ব ও আগাম সতর্কবার্তা নিয়ে কাজ করা এক দল গবেষক।

তাদের দাবি, এখনই ব্যবস্থা না নিলে কয়েকদিনের মধ্যে মশার আক্রমণ সব রেকর্ড ছাড়াবে। এমন সংবাদে ক্ষুব্ধ যাত্রাবাড়ীর জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনের আগে মেয়রপ্রার্থীরা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়ান। কেউ কেউ তো আবার ভঙ্গুর ঢাকাকে একেবারে সিঙ্গাপুর-দুবাই বানিয়ে দেন। অথচ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের প্রধান কাজ দুটি- প্রতিদিন ময়লা পরিষ্কার আর মশা মারা। এগুলো করতেই তাদের নাভিশ্বাস।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে অনেক কথাবার্তা হওয়ার পর গত বছর ওষুধ ছিটানো হয়েছিল। এর ফলে কিছুদিন মশাও কম ছিল। কিন্তু পরে আর ওষুধ দিতে দেখিনি। এখন আবার মশার উৎপাত বেড়েছে। সন্ধ্যার পর তো টেকাই দায়। অনেক এলাকায় দিনদুপুরেও মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। কয়েল জ্বালিয়েও রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। বর্ষায় জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে ধুলা আর এখন মশার অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে।’

ঢাকার ১১ ভাগ এলাকায় ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি

দুই সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে রাজধানীর অন্তত ১১ শতাংশ এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দক্ষিণের (ডিএসসিসি) ১২ ও উত্তরের (ডিএনসিসি) ১০ শতাংশ ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর এ বাহকের লার্ভার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি মিলেছে এক জরিপে। মূলত এটি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্স বা সূচকের মাধ্যমে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিএনসিসির ১২, ১৬, ২৮, ৩১ ও ১ এবং ডিএসসিসির ৫, ৬, ১১, ১৭, ৩৭ ও ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে এডিসের ব্রুটো সূচক মিলেছে ঝুঁকিপূর্ণ ২০ পয়েন্টের বেশি। উত্তরের শুধু ১২ নম্বর ওয়ার্ডেই এ সূচক ৩০ পয়েন্টে গিয়ে উঠে। অন্য বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এডিস মশার উপদ্রব তেমন ছিল না; এবার জানুয়ারি থেকেই নগরীতে এর উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ডেঙ্গু সার্ভিলেন্স অ্যান্ড প্রেডিকশন প্রোজেক্টের আওতায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মশার উপস্থিতি নিয়ে তার নেতৃত্বেই গবেষণাটি চলছে। 

কবিরুল বাশার বলেন, ‘এডিসের উপস্থিতি এখন কম থাকলেও তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্চ-এপ্রিলের দিকে এর প্রকোপ আরো বাড়বে। তাই বৃষ্টি হওয়ার আগে আগেই মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের উদ্যোগ নিতে হবে।’ 

এ গবেষক আরো জানান, দেশে ১২৩ প্রজাতির মশা রয়েছে। আর ঢাকায় রয়েছে ১৩ প্রজাতির। এর মধ্যে কিউলেক্স মশাই আমাদের কাছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বিরক্তির কারণ। নগরীর মোট মশার ৯৫ ভাগই এদের দখলে। এগুলোকে ধ্বংস করতে হলে এখনই ড্রেন, ডোবা ও নর্দমার পানি চলন্ত করার পাশাপাশি লার্ভা মারার কীটনাশক ছিটানো জরুরি।

মৌসুমের আগেই ডেঙ্গুতে পঙ্গু

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু এসেছিল নানা রেকর্ড নিয়ে। এবার তা ভেঙে নতুন রেকর্ডের দিকে এগোচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গেল বছর জানুয়ারি তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। এখন পর্যন্ত সারাদেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিন শতাধিক রোগী। অথচ গত বছর এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন মাত্র ৫৬ জন। আর জানুয়ারিতে গত বছর ৩৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। চলতি বছর সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ১৯৭ জনে। 

ফেব্রুয়ারির চিত্রটা আরো ভয়াবহ, তিন শতাধিক লোক আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। 

ডেঙ্গু রুখতেও দুর্নীতি

অকার্যকর ওষুধ কেনা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা না থাকা, কীটনাশক কেনায় সরকারি নীতি অনুসরণ না করায় ঢাকায় মশা বাড়ছে। আর এর পেছনে রয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সীমাবদ্ধতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। 

এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই তুলে ধরেছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। 

সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, জৈবিক ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ ও যান্ত্রিক- এ চারটি পদ্ধতি প্রয়োজন। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন শুধু রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাকিগুলো তাদের পরিকল্পনায় কিংবা বাজেটেও রাখা হয় না। শুধু তাই নয়, মশা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কেবল সাধারণ কিউলেক্স মশাকে লক্ষ্য করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। গেল বছর ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করলেও এবার এডিস মশার উৎস নির্মূলে তেমন কোনো কার্যক্রম নেয়া হয়নি।

কামান আছে কেমন

ডিএনসিসিতে ২০০টি ফগার মেশিন, ২৩৮টি পালস ফগমেশিন, ১৫০টি হার্টসন হস্তচালিত মেশিন, ৩৪০টি প্লাস্টিক হস্তচালিত মেশিন, দুটি ভেহিকল মাউন্টিং ফগার মেশিন, ১০টি মোটরসাইকেল ফগার ও হস্তচালিত মেশিন, ২০টি মিস্ট ব্লোয়ার-পাওয়ার স্প্রে মেশিন দিয়ে মশা নিধন চলছে বলে জানান সংস্থার উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা সারওয়ার। 

অন্যদিকে ডিএসসিসিতে মশার ওষুধ ছিটানোর মেশিন রয়েছে ৯৪০টি। এর মধ্যে হস্তচালিত, ফগার ও হুইল ব্যারো মেশিনের অর্ধেকই প্রায় অচল। সব মিলিয়ে রাজধানীর মশা নিধনে অনেকটাই হিমশিম খাচ্ছে দুই সিটি কর্পোরেশন। 

এদিকে গত বছরের ডেঙ্গু মৌসুমে উত্তর সিটির উদ্যোগে জরুরি ভিত্তিতে মেসার্স প্যারেন্টস এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেনা হয় জার্মানির তৈরি ২০০ ফগার ও পাঁচটি ভেহিক্যাল মাউন্টেন্ড ফগার মেশিন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেগুলো সফলভাবে ব্যবহার করতে পারেনি তারা। অভিযোগ উঠেছে, ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই তুলনামূলক বেশি দাম দিয়ে কেনা মেশিনগুলো চালুর পর আগুন ধরে যায়। এর বাইরে কোথাও কোথাও ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চললেও তাতে কোনো কাজেই আসছে না। 

টিআইবি অবশ্য বলছে, দুই সিটিতে গড়ে ওয়ার্ড প্রতি পাঁচজন মশক নিধন কর্মী রয়েছেন, যা খুবই অপ্রতুল। আবার এলাকার আয়তন বিবেচনায় নিয়েও এসব কর্মী বণ্টন হয় না। তাছাড়া কর্মীদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি তো রয়েছেই। 

বিষয়টি আংশিক স্বীকার করে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, ‘কিউলেক্স মশার অন্যতম প্রজননস্থল সরু নর্দমাগুলোতে মশার ওষুধ ছিটানো যায় না। সেখানে কীভাবে কাজ করব সেটা নিয়ে আমরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন সংস্থার জলাধারে কচুরিপানা আছে, যেগুলো নিয়েও কাজ করছি।’ 

এছাড়াও ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াসহ মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে ‘কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট’ তৈরির জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে ডিএসসিসি। সিঙ্গাপুরের আদলে রাজধানীতে কীভাবে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে এতে। কৌশলপত্রটির আলোকে একটি প্রকল্প গ্রহণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যদিও এতে মন্ত্রণালয়ের সায় মিলছে না। 

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন যে প্রকল্প দিয়েছে, সেটা একটি আইনি বিষয়। চাইলেই জনবল দিয়ে দেয়া যায় না। তবে শুধু সিটি কর্পোরেশন নয়, আমরা সারাদেশের জন্য একটা ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর (রোগের জীবাণু বহনে সক্ষম বাহক) ম্যানেজমেন্ট করার বিশেষ কাজ করছি। আমাদের মন্ত্রণালয় এটার জন্য একটি কাঠামো তৈরি করছে।’

গবেষক কবিরুল বাশার অবশ্য সিটি কর্পোরেশনের এ প্রকল্পকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনের যে জনবল কাঠামো ও যন্ত্রপাতি, তা খুবই নগণ্য। তাই এডিস মশা রুখতে আলাদা প্রকল্প নিতেই হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //