সরকারি প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগে কেন এত কালক্ষেপণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান। কলা অনুষদের একটি বিভাগ থেকে ২০১৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর থেকেই সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু গত বছর বিশ্বজুড়ে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে দেশে লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় সরকারি-বেসরকারি বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া। এতে কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন আরিফুর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মুক্তারুল ইসলাম জানান, বিসিএস ও ব্যাংক কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু পদে আবেদন করে এখন পরীক্ষার জন্য বসে আছেন। করোনার কারণে সবকিছু আটকে আছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান, দুলাল রাব্বানীসহ কয়েকজন বলেন, তাদের সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স প্রায় শেষ পর্যায়ে, কিন্তু নতুন আবেদন করার মতো বিজ্ঞপ্তি পাচ্ছেন না। 

কিছুটা হতাশার সুরে তারা বলেন, একটি চাকরি মানে একজনের বিষয় নয়। এর সঙ্গে গোটা পরিবারের সুখ-শান্তি জড়িয়ে থাকে। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করা শিক্ষার্থীদের কষ্ট কেউ বুঝতে চায় না।

শুধু আরিফুর কিংবা মুক্তারুল নন, করোনার প্রভাবে বেকারত্বের এমন হতাশা নিয়ে দিন পার করছেন স্নাতকোত্তীর্ণ অনেক তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য মতে, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রতি বছর সাড়ে তিন লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। করোনার কারণে গত বছর এ সংখ্যা কিছুটা কমলেও তা লাখের ওপরে ছিল।  

অথচ মঙ্গলবার (১৫ জুন) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকারি চাকরিতে ৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি পদ শূন্য। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি পদ শূন্য। এই স্তরে প্রায় দুই লাখ পদ শূন্য রয়েছে।

সরকারি চাকরিতে শূন্য পদ গত কয়েক বছর ধরেই বাড়ছে। করোনাকালে সেটি আরও বেড়েছে। অন্যদিকে বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী। বিশেষ করে যাদের চাকরির বয়স শেষ পর্যায়ে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না থাকায় তাদের দিন কাটছে হতাশা ও দুশ্চিন্তায়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোতে নিয়োগের দায়িত্ব সংশ্নিষ্ট সরকারি দফতরের। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্ব ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির (বিএসসি)। নিয়োগ বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়া ও মামলা জটিলতাসহ নানা কারণে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদফতর ও সংস্থায় শূন্য পদের ছড়াছড়ি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্বাভাবিক কাজকর্মও ব্যাহত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, করোনায় শিক্ষাবর্ষের মতো নিয়োগ পরীক্ষায়ও বড় জট তৈরি হয়েছে। আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেয়াও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থান না হওয়ায় চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ বাড়ছে। বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। কেননা চাকরিপ্রত্যাশী বেকার স্নাতকের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়ে চলেছে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ৬৬ আর গ্রামাঞ্চলের ৪১ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। 

অন্যদিকে প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আউটপাস নিয়ে ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা ৩৬ হাজার ২১০। কেউ করোনায় কাজ না থাকা বা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া, কেউ বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে আবার কেউ ভিসার মেয়াদ না থাকায় সাধারণ ক্ষমার আওতায় আউটপাস নিয়ে দেশে ফিরেছেন। অর্থাৎ করোনায় চাকরি হারিয়ে প্রবাসীরাও দেশে ফিরছেন। এ প্রেক্ষাপটে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এভাবে কতদিন চলবে, তা আমরা কেউ জানি না। তাই চাকরির বিজ্ঞপ্তিগুলো কোনোভাবেই আটকে রাখা ঠিক হবে না। কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে চাকরির বিজ্ঞপ্তি স্থগিত না রাখে, এজন্য সরকারকে নির্দেশ দিতে হবে। সরকার কিছু শিক্ষার্থীর জন্য বয়সে ছাড় দিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি নিয়মিত প্রকাশ না হলে আরও অনেক শিক্ষার্থী বঞ্চিত হবে। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতি বছর গড়পড়তায় সরকার ৫০ হাজারের বেশি জনবল নিয়োগ করতে পারে না। গত ১০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোনো বছরই জনবল নিয়োগ ৫০ হাজার অতিক্রম করতে পারছে না। জাতীয় প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে সেবা দেয়ার জন্য পদসৃজন করা হচ্ছে। একদিকে পদ সৃজন হচ্ছে অন্য দিকে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ হচ্ছে না। এ কারণে প্রতি বছরই শূন্য পদ বাড়ছে।  

এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে জনবল নিয়োগে তিনটি প্রধান সমস্যা আছে। শূন্য পদ পূরণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের সম্মতি নিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে কখনো কখনো অযাচিত বিলম্ব হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার। পছন্দের লোককে নিয়োগ দিতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়। আর তৃতীয় কারণ হলো মামলা-মোকদ্দমা। এসব কারণেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জনবল নিয়োগকেই চ্যালেঞ্জ মনে করে থাকে। নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য এসব বাধা দূর করতে হবে। চাহিদা আসার সঙ্গে সঙ্গে এর যৌক্তিকতা নিরূপণ করতে হবে। কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করা যাবে না। এজন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উভয় দিক থেকে সতর্ক থাকতে হবে। মামলা-মোকদ্দমা যেগুলো চলমান আছে সেগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে। আর নতুন করে যেন না হয় সেজন্য চাকরির আইনকানুন বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।’

বর্তমানে অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। প্রযুক্তির উৎকর্ষে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটানো যেতেই পারে। তবে মানুষের কাজ না থাকলে তা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। করোনা পরিস্থিতি উত্তরণে প্রথম প্রশ্নটিই অর্থনীতির পুনরুদ্ধার। প্রচুর কাজ সৃষ্টির মাধ্যমে এ পথে এগোতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বেকারত্ব দূরীকরণে সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কীভাবে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করা যায় সে বিষয় এখনই ভাবতে হবে ও দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। 

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও অ্যাকশন এইডের এক যৌথ গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণ কোনোটিতেই নেই। সানেম বলছে, এক্ষেত্রে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় তরুণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদান, শ্রমবাজারে নারীদের অধিক অংশগ্রহণের জন্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //