জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা কী?

কোনো আলাপ-আলোচনা ও প্রস্তুতি ছাড়াই আবারো জ্বালানি তেলের দাম বাড়াল সরকার। গতকাল শুক্রবার (৫ আগস্ট) মধ্যরাত থেকে ডিজেল ও কেরোসিন প্রতি লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ৮০ থেকে ১১৪ টাকা, অকটেন লিটারে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ৮৯ থেকে ১৩৫ টাকা, পেট্রল লিটারে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ৮৬ থেকে ১৩০ টাকা করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এর আগে, এক দফায় জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানোর নজির নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে কখনোই জ্বালানি তেলের দাম একসাথে এতটা বাড়ানো হয়নি। এর ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেছেন, দাম কিছুটা বাড়ানো হবে, এই আশঙ্কা ছিল। তবে সেটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত। যতটা বাড়ানো হয়েছে, তা চিন্তার বাইরে। হুট করে এত বেশি দাম বাড়ানোর চাপ অর্থনীতি নিতে পারবে না বলেই মনে করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, ডিজেলের দাম বিশ্ববাজারে ব্যারেলে ১৭০ ডলার থেকে কমে ১৩০ ডলারে নেমেছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমে ১০০ ডলারের মধ্যে এসেছে। এই দর এ বছর ৭০ থেকে ৮০ ডলারে নামতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিপুল পরিমাণে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই বিশেষজ্ঞ।

অপরিদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরূল ইমাম বলেন, জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ানোর আগে একটা প্রস্তুতি থাকে, গণশুনানি হয়। সকলে জানতে পারে যে, দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা আছে কিনা। কিন্তু রাতের অন্ধকারে ঘোষণা দিয়ে হঠাৎ করে বাড়ানো হলো তেলের দাম। কোনো প্রস্তুতি নেই, জনগণের সাথে কোনো আলাপ-আলোচনা নেই। এটাকে মোটেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষণ বলে মনে করি না।

তিনি আরো বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখন নিম্নমুখী। আর এই যে সমন্বয়ের কথা ওনারা বারবার বলেন, অথচ তেলের দাম যখন দীর্ঘদিন ধরে অনেক কম ছিল তখন কিন্তু আমরা কম দামে তেল কিনিনি। ওই টাকা যদি হিসাব করা হয়, তাহলে লাভের কত টাকা জমা আছে বিপিসির কাছে। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সেই টাকাটা কি সমন্বয় করা যায় না? এটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অভাব বলেও মনে করেন তিনি। 

কতটা প্রভাব পরবে?

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবনের নানা ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। ব্যক্তিগত গাড়ি সিএনজিতে চলার সুযোগ থাকলেও মোটর সাইকেল চালাতে হয় অকটেন বা পেট্রোলে। আর ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়বে বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের ভাড়ায়। লঞ্চসহ নৌযানের ভাড়াও বাড়বে। আর এর পরোক্ষ প্রভাব পড়বে বহু খাতে।

ট্রাক কিংবা নৌযানের ভাড়া বেড়ে গেলে শাক-সবজি থেকে শুরু করে যে সব পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাজারে আসে, তার সব কিছুরই দাম বাড়বে। ফলে দেশের সব পরিবারেরই মাসিক খরচের হিসাব নতুন করে সাজাতে হবে।

ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বা জেনারেটর চালানোর খরচ বেড়ে যাবে, দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পেও ডিজেলের দাম বৃদ্ধির আঁচ পড়বে।

মাছ ধরার ট্রলারগুলোরও জ্বালানি ডিজেল, তাই সেখানেও খরচ বাড়বে। কৃষিক্ষেত্রে সেচ পাম্প ও পাওয়ার টিলারে ডিজেলে ব্যবহার হয় বলে কৃষকেরও ব্যয় বাড়বে। অবশ্য কৃষকের জন্য ডিজেলে ভর্তুকি চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। সবমিলিয়ে বলা যায় দৈনন্দিন জীবনে বেশ বড় ধরনের প্রভাব পরতে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমেশ ঘোষ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে, তাতে যাত্রীদের ওপর চাপ বিপুলভাবে বাড়বে।

তিনি বলেন, এর আগে এক দফায় জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানোর নজির আছে কি না, তা মনে পড়ছে না। জ্বালানির দাম বাড়ানোর এই হারকে অস্বাভাবিক আখ্যায়িত করেছেন শ্যামলী পরিবহনের স্বত্বাধিকারী রমেশ ঘোষ। দ্রব্যমূল্যের ওপরও এর প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করছেন তিনি।

আইএমএফের ঋণের শর্তপূরণের জন্যই কি?

এবার ভারতের সাথে দামের পার্থক্য পুরোপুরি দূর করার পাশাপাশি জ্বালানি তেল খাতে সরকারের ভর্তুকি একবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চাপে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফের ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সেই শর্ত পূরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত ছিল ঘাটতি সমন্বয়। দাম বাড়িয়ে ঘাটতি তা করতে গিয়ে জনগণের ওপরের যে আঘাত হানা হয়েছে, তা সিডর–আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়কে হার মানায়।

এম শামসুল আলম বলেন, দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করেও ঘাটতি সমন্বয় করা যেত। সরকার সেই পথে হাঁটেনি। জ্বালানি তেলের দাম গণশুনানি করে বাড়ালে তা সহনীয় থাকত। এখন যে ‘টর্নেডো’ চালিয়ে দেওয়া হলো, তাতে ভোক্তার অধিকার তছনছ হয়ে গেছে।

প্রসঙ্গত, ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ভাবনার কথা গত সপ্তাহ থেকেই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মুখে শোনা যাচ্ছিল। গত বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ-জ্বালানি বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের আলোচনায় ‘প্রয়োজনে দাম বাড়িয়ে হলেও’ নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি উঠেছিল কয়েকজন ব্যবসায়ীর কণ্ঠে।

গতকাল শুক্রবার সকালে নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের ডেকে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ‘যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসার সময় এসেছে’ বলে মন্তব্য করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, জনবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার সবসময় আমজনতার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। যতদিন সম্ভব ছিল ততদিন সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর চিন্তা করেনি। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই কিছুটা অ্যাডজাস্টমেন্টে যেতে হচ্ছে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনঃবিবেচনা করা হবে।

এদিকে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ইঙ্গিত দিয়েছেন, বিদ্যুৎ আর গ্যাসের দামও বাড়বে। তিনি বলেছেন, বিদ্যুতের প্রাইসের অ্যাডজাস্টমেন্টের ব্যাপারে আমরা অপেক্ষায় আছি। গ্যাসের ব্যাপারে আমরা আরেকটা অ্যাডজাস্টমেন্টে যেতে চাচ্ছি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //