শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্প বিশ্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত: ড. পিয়ারসন

নরওয়েজিয়ান একাডেমিক-বিশ্লেষক ড. অ্যাটল পিয়ারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পকে বিশ্বের মধ্যে অনন্য ও মৌলিক একটি প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। পিয়ারসন বলেন, সরকারি জমিতে স্থায়ী বাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করে ভূমিহীনদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করার নজির বিশ্বে বিরল এমন লোকদের মালিকানা দেওয়ার নজির নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি ।

তিনি বলেন, আশ্রয়ণ শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বে একটি অনন্য প্রকল্প হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।  বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সাহায্যার্থে নানা উদ্যোগ থাকলেও সরকারি জমিতে স্থায়ী বাড়ি নির্মাণ করে ঠিকানাহীন মানুষকে মালিকানা দেওয়ার নজির যেমন নেই অনুরূপ সরকারি খরচে বিদ্যুৎ ও স্যানিটেশন সুবিধাসহ বাড়ি নির্মাণের বিষয়টিও একটি অভিভূত হওয়ার মত ঘটনা। 

ড. আল্টে পিয়ারসন এভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে তার লেখা প্রবন্ধে বর্ণনা করেছেন। 

নেপালের অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাতোপতিতে ৮ আগস্ট, ২০২৩ সংখ্যায়  "উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হিসাবে বাংলাদেশের আশ্রয়ণ প্রকল্প" শিরোনামে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। ড. আল্টে পিয়ারসনের দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি এবং ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষক হিসেবে সুপরিচিত। 

নীচে নিবন্ধটি তুলে ধরা হলো:

বাংলাদেশের আশ্রয়ণ প্রকল্প (গৃহহীনদের জন্য) দারিদ্র্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করেছে। পাশপাশি এই আবাসন প্রকল্পটি দেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি)’র অন্তত আটটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করার ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে নিয়েছে। 

'শেখ হাসিনা মডেল ফর ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট' হিসেবে চিহ্নিত আশ্রয়ণ প্রকল্পটি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রবৃদ্ধির এক নতুন যুগের সূচনা করছে। প্রকল্পের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জন্য প্রবৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নতুন মাত্রার সূচনা করছেন যেখানে আশা করা যাচ্ছে - ‘কেউ পিছিয়ে থাকবে না’।

২২ হাজার ১০১টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে এই ঘর দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক নেওয়া আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের চারটি ধাপের দ্বিতীয় ধাপে এ বাড়িগুলো হস্তান্তর করছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বিনা মূল্যে বাড়িগুলো দুইশত একর জমিসহ এসব পরিবারের হাতে তুলে দিবেন। একই সঙ্গে দেশের ১২৩টি উপজেলাকে সম্পূর্ণ ভূমিহীন ও গৃহহীন ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী।

২০২০ সালের মে মাসে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য আশ্রয়ন-২ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। 'মুজিব বছরে বাংলাদেশের একজনও গৃহহীন বা ভূমিহীন হবে না'- এমন লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। পরে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে, প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ৬৩ হাজার ৯৯৯টি একক বাড়ি হস্তান্তর করেন। একই সময়ে ৭৪৩টি ব্যারাকে ৩ হাজার ৭১৫ পরিবারকে পুনর্বাসনও করা হয় এ প্রকল্পের অধীনে। ওই বছরের জুনে দ্বিতীয় দফায় ৫৩ হাজার ৩৩০টি বাড়ি হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী। তৃতীয় ধাপে ৬৫ হাজার ৬৭৪টি ঘর নির্মাণসহ চতুর্থ ধাপে চলতি বছরের মার্চে ৩৯ হাজার ৩৬৫টি বাড়ি হস্তান্তর করা হয় এ প্রকল্পের আওতায়। এ প্রকল্পের চার ধাপে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৮৫১টি পরিবারকে জমিসহ বাড়ি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পরিবারে গড়ে পাঁচজন সদস্য নিয়ে মোট ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৫ জন  বাস্তুচ্যুত লোককে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। আর সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও পুনর্বাসন পদ্ধতির পরিপ্রেক্ষিতে এটি বিশ্বের বৃহত্তম সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচি।

এই প্রকল্পে গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারগুলোকে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আধা-পাকা একক পরিবারের ঘরের মালিকানা প্রদান করা হয় যেখানে বিদ্যুত সুবিধা সহ স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ২ শতাংশ খাস (সরকারি মালিকানাধীন জমি) জমির বন্দোবস্ত রয়েছে। এ প্রকল্পটি কেবল একজন পুরুষ এবং তার পরিবার মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার সুযোগই পাচ্ছেন না শুধু বরং স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীদের জমির মালিকানা নিশ্চিতের বিষয়টি নারীর ক্ষমতায়নের একটি অনন্য উদাহরণও বটে।

গবেষণায় নিশ্চিত করা হয়েছে যে, ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্প শুরু হওয়ার পর ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৭ টি পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। কারণ সেসময় বাংলাদেশে বাস্তচ্যুতের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ৮৫ জন। আর তাই গৃহহীন প্রান্তিক ও অতি-দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই ‘শেখ হাসিনা মডেল ফর ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট’  চালু করেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ পরিবার সারা দেশে তাদের বাড়ি পেয়েছে আর ৩৫ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় লাভ করেছেন। বীর নিবাস, সংখ্যালঘু পুনর্বাসন, ক্লাস্টার ভিলেজ, দুর্যোগ প্রতিরোধী ঘর এবং হাউজিং ফান্ড হাউস সহ আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনেকগুলো প্রকল্প রয়েছে। আর এসব প্রকল্পের মাধ্যমে ৪ লাখ ১৪ হাজার ৮০০ মানুষ বাড়ি ও জমির মালিক হয়েছেন। শুধুমাত্র বসতবাড়ির জন্য ২৮ হাজার একরের বেশি জমি বরাদ্দ করা হয়েছে।

এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মিত বাড়িগুলোতে প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি টয়লেট, একটি রান্নাঘর ও একটি বারান্দাসহ দুই কক্ষ বিশিষ্ট আধা-সজ্জিত ঘর রয়েছে। নদীতীরবর্তী এলাকা, পাহাড়ি এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং অন্যান্য এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে এসব ঘরের নকশা করা হয়েছে যাতে করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সুরক্ষিত থাকে। এছাড়াও রয়েছে টং হাউস, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বহুতল ভবন, উপকূলীয় লোকদের জন্য পাকা ব্যারাক, সমতল এলাকার জন্য আধা-পাকা ব্যারাক, চরাঞ্চল ও দ্বীপ এলাকায় বসবাসরতদের জন্য ব্যারাকসহ একক আবাসের ব্যবস্থা।

এ প্রকল্পের ফলে দেশটির আর্থ-সামাজিক খাতে এক বর ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী ও নারীর ক্ষমতায়নে বিশাল ভূমিকা রাখবে এই প্রকল্প। এতে করে পুনরায় এসব অসহায় মানুষদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হলো। 

ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্থায়ী আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সঠিক স্যানিটেশন প্রদান, সামাজিক নায্যতা নিশ্চিতসহ জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে এই উদ্যোগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক ও দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মূল দর্শন শুধু তত্ত্ব বা কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই দর্শনের ব্যবহারিক দিকটিও অত্যন্ত শক্তিশালী। আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং অনুরূপ প্রকল্পগুলি দৃশ্যত 'শেখ হাসিনা মডেল অফ ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট'-এর একটি বাস্তব রূপ। আর এই মডেলের বৈশিষ্ট্যগুলি হল- দরিদ্রতমদের উপার্জনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, তাদের জন্য একটি সম্মানজনক জীবিকা ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা, জমি ও বাড়ির মালিকানায় নারীর ক্ষমতায়ন করা, পিছিয়ে পড়া মানুষের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা এবং দক্ষতা তৈরি করা, তাদের পরিবেশগত সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি সুরক্ষা ব্যবস্থাকেও করেছে নিশ্চিত। এছাড়াও গ্রামে থেকে নগরের সুবিধা নিশ্চিতেও এ প্রকল্পের ব্যপক অবদান থাকবে। 

পরিসংখ্যান ও সূচক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুবিধাভোগী মানুষদের নিরাপত্তাজনিত ৯৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ, সামাজিক অবস্থানের জন্য ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির ব্যাপারে ৯৫ দশমিক ২ শতাংশ সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি তাদের নতুন আসবাবপত্র কেনার সক্ষমতাও ৭০ দশমিক ২২  শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ইতিবাচক আচরণ ৬০ দশমিক ৭৮ শতাংশ, সামাজিক সম্প্রীতি ৬০ দশমিক ২১ এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইস কেনার ক্ষেত্রেও তাদের সক্ষমতা ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। অনুরূপ সঞ্চয়ের হার বেড়েছে ৪৪ শতাংশ এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ৩৫.৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যান্য উদ্যোগের মতো আশ্রয়ণ প্রকল্পটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইউএন হ্যাবিট্যাট নামে পরিচিত জাতিসংঘের মানব বসতি কর্মসূচিতেও প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকরা 'শরণার্থী: অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনা মডেল' শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেন।

আজ বাংলাদেশের দরিদ্র, অসম্মানিত ও অবহেলিত নারীরা জমি ও বাড়ির মালিক হয়েছেন। প্রকল্পটি তাদের সম্মান, মর্যাদা, শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। 

সূত্র: বাসস ইংরেজি 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //