প্রশাসন ‘সন্তুষ্ট’ করার পদোন্নতি ও চুক্তি

চলতি মাসের (অক্টোবর) শেষ কিংবা আগামী মাসের (নভেম্বর) শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। নির্বাচন সামনে রেখে শেষ মুহূর্তেও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘সন্তুষ্ট’ রাখতে আরও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে চলছে আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের ‘খুশি’ রাখতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না জানালেও ভোটের কার্যক্রম এগোচ্ছে। ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে বিদেশিদের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে বিগত কয়েক মাসে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের খুশি রাখতে চাইছে সরকার। কারণ নির্বাচন কমিশন ভোট আয়োজনের দায়িত্বে থাকলেও প্রশাসনের মাঠের কর্মকর্তারাই ভোট কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে থাকেন।

অন্যদিকে ভোটে বাধা দিলে ভিসা দেবে না বলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য। এ প্রেক্ষাপটে কর্মকর্তাদের চাঙ্গা রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। সম্প্রতিক সময়ে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিবের পর শিগগিরই উপসচিব পদে পদোন্নতি হতে যাচ্ছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এখন প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা চুক্তিতে রয়েছেন। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের রেখে দিচ্ছে সরকার। আগামী কিছুদিন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা অবসরে গেলে তারও চুক্তিতে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পদোন্নতি
চলতি মাসের মধ্যেই সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে আড়াইশ কর্মকর্তা পদোন্নতি পেতে পারেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সূত্রে জানা যায়, এবার উপসচিব হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিসিএস ২৯তম ব্যাচকে নিয়মিত গণ্য করা হচ্ছে। এ ব্যাচের পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তার সংখ্যা ১৯৫। এ ক্ষেত্রে আগের বঞ্চিত এবং অন্যান্য ক্যাডারের অন্তত ১৫০ জনসহ সাড়ে তিনশর বেশি কর্মকর্তার কর্মজীবনের নথিপত্র যাচাই-বাছাই করছে পদোন্নতির সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করে প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে।

এর আগে গত বছরের নভেম্বর মাসে ২৫৯ জনকে উপসচিব এবং গত ৪ সেপ্টেম্বর ২২১ জনকে যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখন যুগ্ম সচিবের মোট স্থায়ী পদ ৫০২টি। এর বিপরীতে পদোন্নতি পাওয়ার পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৯৪৬ জন। এর আগে মে মাসে ১১৬ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত সচিব করা হয়। ওই পদোন্নতির ফলে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২৬। অথচ অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১৪০।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের সচিব মো. আব্দুস সবুর মন্ডল বলেন, উপসচিব হিসেবে পদোন্নতির জন্য ইতোমধ্যে এসএসবির বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। আরও বৈঠকের মাধ্যমে সুপারিশ চূড়ান্ত হবে। এরপরই পদোন্নতি হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচনের আগে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কিছুটা উদারভাবে দেখতে বলা হয়েছে। এ কারণে ২৯তম ব্যাচের পদোন্নতিযোগ্য প্রায় সবাই এ যাত্রায় পার হয়ে যেতে পারেন। পাশাপাশি আগের বঞ্চিত সিনিয়র কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশেরও সুযোগ মিলতে পারে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ প্রায় ২৫০ জন উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেতে পারেন। সবশেষ গত বছরের ১ নভেম্বর ২৫৬ জনকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।

পদোন্নতি বিধিমালা অনুযায়ী উপসচিব হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডারের ২৫ শতাংশ কর্মকর্তাকে বিবেচনায় নিতে হয়। উপসচিব হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ৫ বছর চাকরিসহ সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ১০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। অন্তত ৮৩ বেঞ্চমার্ক (মূল্যায়ন নম্বর) পেতে হয়।

চুক্তি চলছেই
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, এ মুহূর্তে প্রশাসনের শীর্ষ দুই কর্মকর্তাসহ অন্তত ২১ সচিব চুক্তিতে কর্মরত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অবসরে যাচ্ছেন অন্তত ৮ সচিব। তাদের মধ্যেও দু-তিনজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন। অথচ যোগ্যতা অর্জন করে সচিব হওয়ার অপেক্ষায় আছেন বিসিএস ১১, ১৩ ও ১৫তম ব্যাচের কয়েকশ কর্মকর্তা। 

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্যমতে, প্রশাসনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ ৮৮ জন সচিব আছেন। তাদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অন্তত ২১ জনই চুক্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে অন্তত ১০০ কর্মকর্তা আছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত।

জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে সাবেক এক অতিরিক্ত সচিবকে সম্প্রতি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তার মতো অন্তত সাতজন সাবেক অতিরিক্ত সচিবকে চলতি বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদের প্রায় তিন গুণ কর্মকর্তা প্রশাসনে কর্মরত। উপযুক্ত দপ্তর না পেয়ে অনেকে ইন-সিটু বা আগের পদেই কাজ করছেন। একইভাবে চলতি বছর অবসরে যাওয়া ১৯ জন সচিবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে।

বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ছাড়াও চুক্তিতে আছেন বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে ড. আহমদ কায়কাউস, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের শ্যাম সুন্দর সিকদার এবং রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব পদে সম্পদ বড়ুয়া। বিসিএস ১৯৮৫ ব্যাচের মো. আখতার হোসেন আছেন এসডিজির মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্বে এবং মাসুদ বিন মোমেন আছেন পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বে। চুক্তিতে আরও আছেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম, সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আবদুস সালাম, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফিজুর রহমান, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে সংযুক্ত সচিব ওয়াহিদুল ইসলাম খান ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী। এ ছাড়া পূর্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, ইরাকের রাষ্ট্রদূত ফজলুল বারী, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ এবং রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিয়াও চুক্তিতে আছেন।

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে চুক্তিতে আছেন বেশ কয়েকজন সাবেক সচিব। তাদের মধ্যে আছেন ফয়েজ আহম্মদ, কে এম আলী আজম, ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারী, হেলালুদ্দিন আহমদ, খলিলুর রহমান, এস এম গোলাম ফারুক, এন সিদ্দিকা খানম প্রমুখ। এ ছাড়া কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন পদে চুক্তিতে আছেন সাবেক সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সাবেক খাদ্য সচিব শাহাবুদ্দিন আহমদ, সাবেক আইজি জাভেদ পাটোয়ারী, সাব্বির বিন শামস, ড. খলিলুর রহমান প্রমুখ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস এবং পুলিশের বর্তমান আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও চুক্তিতে আছেন।

তবে প্রশাসনের বেশিরভাগ নিয়মিত কর্মকর্তা নতুন করে আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চান না। একই রকম অভিমত প্রশাসন বিশেষজ্ঞদেরও। তারা বলছেন, কোনো একটি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে চার-পাঁচজন কর্মকর্তা বঞ্চিত হন। এতে প্রশাসনে হতাশা সৃষ্টির পাশাপাশি চেইন অব কমান্ড বিঘিœত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞায় দুর্ভাবনা
জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের অভ্যন্তরে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনের সম্পৃক্ততা বেশি থাকায় তাদের মধ্যে এক ধরনের উৎকণ্ঠাও কাজ করছে বলে জানা গেছে। কর্মকর্তারা জানান, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। কিন্তু বিএনপি হঠাৎ করে নির্বাচনে এলে সেই মনোভাব থাকবে কিনা সেটিই বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি কী হয়, তারা সেটা নিয়ে টেনশনে আছেন। তবে মাঠ প্রশাসনের বাইরে যারা নির্বাচনী দায়িত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন এমন কর্মকর্তাদের ভিসানীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা কম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //