যেমন হবে এবারের নির্বাচনকালীন সরকার

নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আকার ছোট হচ্ছে নাকি বাড়বে, আওয়ামী লীগের বাইরের কোনো দল থেকে কি কেউ নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিচ্ছে বা বর্তমান মন্ত্রিসভা থেকে কি কেউ বাদ যাচ্ছে- এরকম নানা আলোচনা চলমান। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীর বক্তব্যে নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামোটা মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছে।

গতবারের মতোই থাকছে এবারের নির্বাচনকালীন সরকার। অর্থাৎ বর্তমান মন্ত্রিসভাই তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকালীন দায়িত্বে থাকবে। তবে টেকনোক্র্যাট (সংসদ সদস্য নন) মন্ত্রীরা থাকবেন নাকি পদত্যাগ করবেন, সেই বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। যেহেতু আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তাই টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীরা এবার থেকে যেতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দুজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ছাড়া বাকি সবার স্থান হয়েছিল নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায়। 

তফসিলের পর এই সরকার শুধু রুটিন কাজ চালিয়ে যাবে, কোনো নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। কোনো প্রকল্পও উদ্বোধন করতে পারবে না। এজন্য গত কিছুদিন ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ হওয়া বড় প্রকল্পগুলো উদ্বোধনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। যদিও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে বিএনপি। 

আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন।

যেমন হবে এবারের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা
গত ৩১ অক্টোবর গণভবনে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস সফর নিয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী দ্বাদশ সংসদের ভোটের আগে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তা জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও কানাডার মতো সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে যেভাবে নির্বাচনকালীন সরকার থাকে, সেভাবে চলবে। অর্থাৎ সেসময় আমরা যারা থাকব, আমরাই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে রুটিন ওয়ার্ক দায়িত্বপালন, দৈনন্দিন কাজকর্ম করব, যাতে সরকার অচল হয়ে না যায়, সেটা আমরা করব।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আরপিও অনুযায়ী যখন নির্বাচনের সময় ঘোষণা হবে, মনোনয়নপত্র দাখিল হবে, তখন থেকে আর সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা মন্ত্রীরা ব্যবহার করতে পারবে না, পতাকা বা কোনো সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে না। তখন একজন প্রার্থী হিসেবেই তাদেরকে ভোট চাইতে হবে।’

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা ছোট করা হলেও এবার তেমন পরিকল্পনা নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৪-তে আমি কিছু মন্ত্রী অন্যান্য দল থেকে নিয়োগ করেছিলাম, এরপর ২০১৮-তে সেই পদ্ধতি করিনি, যেটা অন্যান্য দেশে হয়- এবারও সেভাবে হবে।’

এবারও প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারণা শুরু হলে মন্ত্রীরা আর সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করবেন না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে নির্বাচনী প্রচারণার কাজ। এই নির্বাচনী প্রচারণার সময় কোনো মন্ত্রী কোনো ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে না, আর কোনো রকম সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে না, এটাই নিয়ম।’

এর আগে গত ২৬ অক্টোবর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী যদি আমরা বলি, যখন থেকে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন (তফসিল) ঘোষণা করবে, সেই মুহূর্ত থেকে এই সরকার নির্বাচনকালীন সরকার।’

বর্তমান মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।

তত্ত্বাবধায়ক উঠে শুরু হয় নতুন ব্যবস্থা
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার স্থায়ীভাবে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। এরপর থেকে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে পরবর্তী সরকার গঠিত হচ্ছে। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে এই পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে। পরে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এরপর ২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। বিদ্যমান সরকারই এ দুটি নির্বাচনের সময় দায়িত্বে থাকে। 

২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীসহ ২৯ সদস্যের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। এর মধ্যে ২১ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ৭ জন। ওই মন্ত্রিসভায় মহাজোট সরকারের ১৬ মন্ত্রী ও ১৪ প্রতিমন্ত্রী বাদ পড়েন। নিয়োগ দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর আরও দুই উপদেষ্টা।

নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর মন্ত্রিসভা বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তারিখবিহীন পদত্যাগপত্র জমা দেন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা। রাষ্ট্রপতি যে পদত্যাগপত্রগুলো গ্রহণ করেন তারাই নির্বাচকালীন সরকারে স্থান পাননি। ওই মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জাসদের ৬ জন মন্ত্রী ও দুজনকে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ওই বছরের ৮ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।

নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের পদত্যাগের নির্দেশ দেন। ওই দিনই বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে চার মন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পদত্যাগপত্র জমা দেন। তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয় এক মাস পর অর্থাৎ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর ঠিক আগের দিন।

যা বলছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ-আইনজীবীরা
সংবিধানের বিধানের কথা উল্লেখ করে সরকার সমর্থিত আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী একটি সরকার থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে আরেকটি সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। আর নির্বাচনের সময় আগের নির্বাচিত সরকারই তার দায়িত্ব¡ পালন অব্যাহত রাখবে। এই দায়িত্ব¡ পালনের বিষয়টি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় যে বিধান, জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাই। এর অর্থ হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় সরকার যেভাবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখে জাতীয় নির্বাচনের সময়ও বিদ্যমান সরকারই স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করবে।

তারা আরও বলছেন, নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ক্ষেত্রে সরকারের কর্তব্য হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনকে সহায়তা করা। নির্বাচনের সময় সরকারের আকার ছোট করা বা কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিকে নিয়ে সরকার গঠনে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, এমনকি টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। তবে সরকারের আকার ছোট বা বড় করার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে। এটা তার সাংবিধানিক ক্ষমতা। তিনি যে কোনো সময় তা করতে পারেন। তিনি চাইলে সেটা এখন যেমন করতে পারেন, নির্বাচনের আগেও করতে পারেন। এতে সংবিধানের কোনো ব্যত্যয় হবে না।

সংবিধান বিশেষজ্ঞরা জানান, নির্বাচন কারও অধীনে অনুষ্ঠানের কথা সংবিধানে নেই। সংবিধানে জাতীয় নির্বাচনের সময় সরকারের ধরন পরিবর্তনের কথা নেই। সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনসহ সব ধরনের নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। তবে এ সময়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ইসির কাছে ন্যস্ত হতে হবে এমনটিও সংবিধানে উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনীয় কর্মচারী নিযুক্ত করবেন। সরকারের নির্বাহী বিভাগ ইসিকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা করবে।

সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিধান নেই। সংবিধানে বলা আছে, কোনো সরকার নির্বাচন করবে না। নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। আর নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারই দায়িত্বে থাকবে। সরকার ভোটের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগসহ কমিশন যা চাইবে তা করতে বাধ্য থাকবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //