বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচার করা এসব টাকা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পাচারকারীরা গড়ে তুলেছেন প্রাসাদসম বাড়ি, বিলাসবহুল প।রাট, বিপুল বিনোয়োগের ব্যবসা, নামি-দামী গাড়ী আর ঐশ্বর্যপূণ জীবনযাপন। এই তালিকায় রয়েছেন, বিগত সরকারের মন্ত্রী, এমপি,দলীয় নেতাকর্মীরা। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন পদে থাকা বড় কর্মকর্তাদের বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসেছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় মদদে বিভিন্ন বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠীর অর্থ পাচারের তথ্য ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। আর তাই দেশে-বিদেশে প্রভাবশালীদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে জোর তৎপরতা শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাচারের অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যেই পাচারের টাকা ফেরত আনতে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে চিঠি।
দেশের শীর্ষ অর্থ পাচারকারী হিসেবে শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ, সামিট, বসুন্ধরা, ওরিয়ন, নাসা, থার্মেক্স গ্রুপসহ বিভিন্ন গ্রুপের নাম রয়েছে। ইতোমধ্যে এসব গ্রুপের অনেকের কাছে তথ্য চেয়ে একাধিক দেশে চিঠি দিয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। কই সঙ্গে অর্থ পাচার করা হয়েছে যেসব দেশে যেমন- সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত (দুবাই), সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইউ) থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। অর্থ পাচার নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মতে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। তবে বাস্তবে আরও বেশি অর্থ পাচার হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে শুধুমাত্র ২০১৫ সালের চিত্র তুলে ধরে বলেছে, বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫৯০ কোটি ডলার (দেশীয় মুদ্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি ওয়াশিংটন থেকে জিএফআই’র এ রিপোর্ট প্রকাশ হয়। জিএফআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪টি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে এই অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা।
জিএফআই’র তথ্যমতে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা ওই সময়ে দেশের ২০১৮-২০১৯ জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি ছিল। প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এছাড়া অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবেই পাচার হচ্ছে। তবে জিএফআই’র ২০১৯ সালের প্রতিবেদনের পর গত ৫ বছরে অর্থ পাচারের হিসাব ছিল আরও বেপরোয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় মদদে অর্থ পাচার হয়েছে। তবে গত ৫ বছরে এই অর্থ পাচার বেড়েছে আগের দশ বছরের দ্বিগুণ। এই সময়ে প্রতিবছর লাখো হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞই সাধুবাদ জানিয়েছেন পাচারের অর্থ ফেরত আনা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন বলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। তাদের মতে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই পাচারের এই অর্থ পুনরুদ্ধার সম্ভব। কারণ কোন রাজনৈতিক সরকারই চাইবেনা পাচারের অর্থ ফেরত আসুক।
সূত্র মতে, পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই পুনরুদ্ধার কাজে সরকার ব্যাংকগুলোর নতুন ব্যবস্থাপনা পরিষদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ, পুলিশের সিআইডি ও দুদকের যৌথ সহায়তা নিচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা ও দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবারও পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সুইজারল্যান্ডের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেটো রেংগলি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি বিষয়টি উত্থাপন করেন। প্রফেসর ড. ইউনূস তার কাছে জানতে চান ‘টাকা ফেরতের কোনো উপায় আছে কি? চুরি করা অনেক টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক আইনি সহায়তার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, সুইজারল্যান্ড সবসময়ই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি ও মানদÐ মেনে চলতে এবং সা¤প্রতিক বছরগুলোতে পেশ করা প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক। রাষ্ট্রদূত বলেন, তার কাছ থেকে সরকারের অগ্রাধিকার সম্পর্কে জানতে পারাটা ছিল আনন্দের। সামনে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সুইজারল্যান্ড অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা করবে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যাংক খাত সংস্কারের মাধ্যমে টেকসই করতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করে তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যমে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি নামে-বেনামে ঋণের নামে কত টাকা আত্মসাত করে পাচার করেছেন, তার হিসাব করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh