জরায়ুমুখ ক্যান্সার : নিয়মিত পরীক্ষা জরুরি যে কারণে

জরায়ু ক্যান্সারকে বলা হয় ‘নীরব ঘাতক’। কারণ এই অসুখে আক্রান্ত হলেও অনেক নারী এর লক্ষণ বুঝতে পারেন না। আবার ভিন্ন লক্ষণ দেখা দিলেও অনেক সময় গুরুত্ব দেন না। জরায়ুমুখ ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী নারীদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন।

আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের পরেই জরায়ুমুখ ক্যান্সারের স্থান। প্রতি পাঁচজন নারী- ক্যান্সার রোগীর একজন জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত। সাধারণত ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সীরা এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তবে ৪০-৫০ বছর বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হন। সমাজের নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার এবং শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর নারীরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৫ লাখ ৭০ হাজার নারী এই জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৩ লাখ ১০ হাজার নারী এর ফলে মারা যান। আর ৯০ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনাই ঘটছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন করে ৮ হাজার ২৬৮ জন নারীর শরীরে শনাক্ত হচ্ছে জরায়ুর ক্যান্সার। আর বছরে ৪ হাজার ৯৭১ জন নারী জরায়ুমুখের ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন।

হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসকে (এইচপিভি) জরায়ুমুখ ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ১০০টিরও বেশি ধরনের এইচপিভি আছে। এর মধ্যে দুই ধরনের হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের কারণে এই ক্যান্সার হয়ে থাকে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তবে ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের পরপরই কিন্তু ক্যান্সার হয় না।

গবেষক ও চিকিৎসকরা বলছেন, জীবাণু প্রবেশের পর ১৫ থেকে ২০ বছরও সময় লাগে জরায়ুমুখের ক্যান্সার হতে। তার মানে হলো এটি নির্ণয়ে অনেকটা সময় পাওয়া যায়। তাই নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। যৌন সংযোগে এর সংক্রমণ ঘটে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ২০ বছরের কম বয়সী নারী। এ বয়সে বিয়ে বা যৌন সংযোগ ঘটলে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জন্য ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়।

ক্যান্সার কোষে রূপান্তর হলে রোগটি দ্রুত বাড়তে থাকে। কখনো পিণ্ডের মতো আকার ধারণ করে, কখনো ঘা এর মতো হয়। তখন বিভিন্ন লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। অতি ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি আক্রান্ত হলে জরায়ুমুখ, জরায়ুপথ, পায়ুপথ ও সংলগ্ন স্থানে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রকমের রোগ হতে পারে।

অন্য ধরনের ক্যান্সারের তুলনায় জরায়ুমুখের ক্যান্সার কিন্তু খুব সহজে নির্ণয় করা যায়। তবে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের মুল সমস্যা হল এটি শেষ পর্যায়ে গেলেই শুধুমাত্র ব্যথা দেখা দেয়।

রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে, এমনকি রোগ দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে গেলেও তেমন কোনো উপসর্গ হয় না। তাই রোগ সম্পর্কে সচেতন না হলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা কঠিন। আর এই ক্যান্সারের লক্ষণগুলোকে অনেকেই পিরিয়ডের সমস্যা বলে ভুল করে থাকেন। 

জরায়ুমুখ ক্যান্সারের কোনো উপসর্গ নেই কিন্তু জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খুঁজে দেখা ক্যান্সার হয়েছে কি না। ১. পেপস স্মেয়ার টেস্ট- জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিং এ রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায়। এটি একটি সহজ পরীক্ষা। জরায়ুমুখ থেকে রস নিয়ে অণুবীক্ষণিক (মাইক্রোস্কোপিক) যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা। এ পরীক্ষা দিয়ে ক্যান্সার, ক্যান্সার হওয়ার আগের অবস্থা ও জরায়ুমুখের অন্যান্য রোগ যেমন প্রদাহ (ইনফ্লামেশন) শনাক্ত করা যায়। এতে কোনো ব্যথা হয় না। এ পরীক্ষার খরচও কম। সাধারণত বিবাহিত নারীদের বিয়ের তিন বছর পর থেকে (২১ বছর বয়সের পর, আগে নয়) এ টেস্ট শুরু করা যেতে পারে। ৩০ থেকে ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি তিন বছর পরপর এ পরীক্ষা করা উচিত। তবে চিকিৎসকের পরামর্শে এ রুটিনের পরিবর্তন হতে পারে।

২. ভায়া পরীক্ষা- ৩ থেকে ৫ শতাংশ অ্যাসিটিক অ্যাসিড তরল দিয়ে জরায়ুমুখ ভিজিয়ে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা। এ পরীক্ষায় জরায়ুমুখের রঙের পরিবর্তন না হলে বা সাদা দেখা গেলে ক্যান্সার হিসেবে সন্দেহ করা হয়।

কীভাবে হয় এই ক্যান্সার? এই ক্যান্সারের প্রথম কারণ এইচপিভির সংক্রমণ। এই সংক্রমণ মূলত যৌন মিলনের কারণে ঘটে থাকে। ভাইরাস জরায়ুমুখে বাসা বাঁধে। একাধিক মানুষের সঙ্গে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হলেই সারভাইকাল ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেশি।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজির অধ্যাপক পারভীন শাহিদা আখতার বলেছেন, যেসব কারণে জরায়ুতে এইচপিভির স্থায়িত্ব বেড়ে যায় সেগুলো হলো-

১. একাধিক বিয়ে বা একাধিক যৌনসাথি,

২. স্বামীর একাধিক বিয়ে বা যৌনসাথি,

৩. ধূমপান ও তামাক পাতার ব্যবহার (যেমন- পান জর্দা, সাদা পাতা খাওয়া, গুল ব্যবহার),

৪. দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন (টানা ১০-২০ বছর),

৫. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে (যেমন- পুষ্টিহীনতা, এইডস, জরায়ুর অন্যান্য ইনফেকশন, কিডনি প্রতিস্থাপিত হলে ইত্যাদি) ও

৬. অল্প বয়সে সন্তান প্রসব, ঘন ঘন সন্তান ধারণ।

এইচপিভি প্রতিরোধ

- কার্যকর প্রতিরোধ হলো এইচপিভি টিকা নেয়া।

- এইচপিভি-১৬ ও এইচপিভি-১৮-এর প্রতিষেধক টিকা (সারভারিক্স) ও এইচপিভি-১৬, ১৮, ১১ ও ৬-এর প্রতিষেধক টিকা নেয়া হলে শরীরে উল্লিখিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়। জরায়ুতে ঝুঁকিপূর্ণ ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে সৃষ্টি হওয়া অ্যান্টিবডি তা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়।

- শারীরিক মেলামেশায় কনডম ব্যবহার।

কত বছর বয়সে টিকা দেয়া হয়

যেকোনো এক ধরনের টিকা (সারভারিক্স) ১২-১৩ বছরের মেয়েদের এইচপিভি আক্রান্ত হওয়ার আগে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নিয়মানুযায়ী- ৯ বছর থেকে ২৫ বছর বয়সে এ টিকা কার্যকর হয়।

মাংসপেশিতে ইনজেকশন উপযোগী তিনটি ডোজ দিয়ে এ টিকা থাকে। প্রথম ডোজ নেয়ার এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ ও ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ দেওয়া হয়। টিকা নেয়ার পরমুহূর্ত থেকে চার থেকে ছয় বছর এ টিকা কার্যকর থাকে বলে বর্তমানে গণ্য করা হয়।

তবে বিবাহিত জীবনযাপন করা নারীদের এ টিকা তেমন কার্যকরী হয় না, গর্ভাবস্থায় এ টিকা নেয়া এখনো অনুমোদন পায়নি। এইচভিপি ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার পর বা ক্যান্সার হয়ে যাওয়ার পর টিকা দিলে কোনো কাজে আসে না। কারণ এ টিকা ইনফেকশন দমন করতে পারে না এবং ক্যান্সারের গতি রুদ্ধ করতে পারে না। এছাড়া এ টিকা গ্রহণকারীকেও নিয়মিত পেপস স্মেয়ার পরীক্ষায় যেতে হবে।

ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়

- বাল্যবিবাহ বন্ধ করা। বাল্যবিবাহ জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি, এ বিষয়টি বেশি বেশি প্রচার করা।

- নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো ও স্বাস্থ্যশিক্ষার ব্যবস্থা করা যাতে, এ রোগ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।

- নিয়মিত জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিং বা পেপস টেস্টে অংশ নিতে হবে।

- ধূমপান ও পানের সঙ্গে জর্দা, সাদা পাতা খাওয়ার অভ্যাস চিরতরে পরিত্যাগ করা। অন্যের ধূমপানে যাতে নিজের ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অর্থাৎ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার না হওয়া।

- দেহের পুষ্টি ঘাটতি পূরণে সুষম খাবার খাওয়ার অভ্যাস করা।

- নিয়ম অনুযায়ী এইচপিভির প্রতিষেধক টিকা নেয়া। 


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //