মাঙ্কিপক্স কি গুটিবসন্তের মতোই সংক্রামক

করোনা যেতে না যেতেই মাঙ্কিপক্সের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মধ্যে। এখন ইউরোপ ও আমেরিকায় রোগটি ছড়ালেও এশিয়া অথবা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এখনো কোনো রোগী আক্রান্ত হয়নি। আফ্রিকা মহাদেশের কিছু দেশ রোগটির আদি নিবাস।

১৯৫৮ সালে এক গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়, পোষা বানরের মধ্যে প্রথম এ রোগের সংক্রমণের লক্ষণ নজরে আসে। তবে ১৯৫৮ সালে রোগটি শনাক্ত হলেও মানুষের মধ্যে প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৭০ সালে। গুটি বসন্ত বা পানি বসন্ত হলে যে রকম লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দেয় শরীরে, মাঙ্কিপক্স হলেও প্রায় একই রকম লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দেয়। রোগটির নাম মাঙ্কিপক্স হলেও এর জীবাণুর উৎস বানর নয়, ইঁদুর জাতীয় কিছু প্রাণী, এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা তা-ই বলছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিজিজ এজেন্সির প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তের তালিকায় রয়েছে-আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালিসহ মোট ২১৯টি দেশ। ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে দিয়েছে। কারণ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পৃথিবী এখন বৈশ্বিক গ্রামে (গ্লোবাল ভিলেজ) পরিণত হয়েছে। যে কোনো সময় রোগটি বাংলাদেশে আসতে পারে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের পরীক্ষা করে ছাড়ার ওপর জোর দিয়েছে। আগামী দিনে এই রোগ আরো ছড়াবে বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

ইউরোপের দেশ পর্তুগালে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৪ জন। দেশটির স্বাস্থ্য দপ্তর বলছে, আক্রান্ত সকলেই পুরুষ। তাদের গড় বয়স চল্লিশের নিচে। মের প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে প্রথম আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়। এরপর থেকে বিভিন্ন দেশ জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এর সংক্রমণ। এ কয়েক দিনে ইংল্যান্ডে আক্রান্তের সংখ্যা ৯০ পেরিয়ে গেছে। স্পেনে এখন পর্যন্ত ৯৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। বলা হয়ে থাকে, মাঙ্কিপক্স দেখা দেওয়ার কিছু দিন আগে স্পেনে সমকামী, উভকামীদের একটি সম্মেলন হয়েছে। সেখানে ফ্রি মিক্সিং থেকে অনেকে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। কারণ রোগটি এখন পর্যন্ত সমকামী, উভকামীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। 

মাঙ্কিপক্স সম্বন্ধে যেমন এখন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই, তেমনি এর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। তবে ভাইরোলজিস্টরা তথা মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্র্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশান বলছে, এর বিরুদ্ধে নতুন করে ওষুধ আবিষ্কার না হলেও গুটি বসন্তের (স্মল পক্স) টিকা দিয়ে নতুন এই ভাইরাসটি প্রতিরোধ করা যাবে। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশে গুটিবসন্তের টিকা মজুদ রাখা হয়েছে। জার্মানি বলছে, তারা ৪০ হাজার বাভারিয়ান নর্ডিক ভ্যাকসিনের মজুদ করেছে। সংক্রমণ বাড়লে আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের এই টিকা দেওয়া হবে। 

মাঙ্কিপক্স কি গুটিবসন্তের মতোই সংক্রামক : এখন যাদের বয়স ৫০ বছরের বেশি তারা গুটিবসন্তের সাথে কম-বেশি পরিচিত। আর পানি বসন্ত বা চিকেন পক্স তো এখনো হয়ে থাকে বাংলাদেশে। মাঙ্কিপক্স হলে এর লক্ষণ-উপসর্গ প্রায় একই রকম। কেউ মাঙ্কিপক্সে অক্রান্ত হলে তার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা, মাথাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, গায়ে ও হাত-পায়ে ব্যথা ইত্যাদি এর প্রাথমিক কিছু উপসর্গ। এছাড়া মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে শরীরের বিভিন্ন লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠে। শরীরে ছোট ছোট অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন দেখা দেয়। ধীরে ধীরে সেই ক্ষত আরো গভীর হয়ে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। গুটি পানি বসন্তের সাথে মাঙ্কিপক্সের উপসর্গে মিল আছে বলে অনেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগকে বসন্ত বা চিকেন পক্স বলে ভুল করছেন। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে পারে। শ্বাসনালি, শরীরে তৈরি হওয়া কোনো ক্ষত, নাক কিংবা চোখের মাধ্যমেও অন্যের শরীরের প্রবেশ করতে পারে মাঙ্কি ভাইরাস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌনক্রিয়ার মাধ্যমেও একে অপরের শরীরে ছড়াতে পারে মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস।

চিকেন পক্স ও মাঙ্কিপক্সের মধ্যে পার্থক্য কোথায় : মাঙ্কিপক্সকে অনেকেই চিকেন পক্স বলে ভুল করছেন। চিকেন পক্সের মতো মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেও শরীরে ছোট ছোট ফুসকুড়ি দেখা দিচ্ছে। চিকেন পক্সের ক্ষেত্রে শরীরে লালচে রঙের ঘামাচি বা র‌্যাশের সাথে গুটি হতে পারে। মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। শরীরে ব্যথা, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর ইত্যাদি লক্ষণে চিকেন পক্সের সাথে মাঙ্কিপক্সের মিল আছে। চিকেন পক্সের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে শরীরে ফোস্কা বাড়তে পারে। পরে ফোস্কার ভেতরের রস ঘন হয়ে পুঁজের মতো হয়। ৭ থেকে ১০ দিন পর থেকে ফোস্কা শুকাতে শুরু করে। অন্যদিকে মাঙ্কিপক্সের ইনকিউবেশন পিরিয়ড (সুপ্ত অবস্থা) ৫ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত। জ্বর দেখা দেওয়ার এক থেকে তিন দিনের মধ্যে (কখনো কখনো আরো বেশি দিন) রোগীর শরীরে ফোস্কা বের হতে শুরু করে। ফোস্কা কোনো কোনো সময় মুখে শুরু হয়, তারপর শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে তা থেকে সুস্থ হতে সর্বোচ্চ চার সপ্তাহ লাগতে পারে। ফোস্কার ভেতর পানি এবং পরে ঘন হয়ে ত্বকের দাগ হয়। উপসর্গে সাদৃশ্য থাকলেও পানি বসন্ত ও মাঙ্কিপক্সের লক্ষণগুলোর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, মাঙ্কিপক্সের কারণে লিম্ফনডগুলো (লসিকানালি) ফুলে যায়। পানি বসন্ত হলে এসব লক্ষণ দেখা যায় না। মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস শরীরে ঢুকলে লিম্ফনডগুলো ফুলে যায়। পানি বসন্ত এমনিই সুস্থ হয়ে যায়, কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। একবার কারও শরীরে পানি বসন্ত হলে তা পরবর্তী প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একবার পানি বসন্ত হলে একই ব্যক্তি আর দ্বিতীয়বার পানি বসন্তে আক্রান্ত হন না। প্রতিকার থাকলেও মাঙ্কিপক্স নিরাময়ের এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি নেই। আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া, কঙ্গোতে মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস বিরাজমান। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী বলছে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মাঙ্কিপক্স বিষয়ক শীর্ষ বিশেষজ্ঞ ড. রোসামুন্ড লুইস বলেছেন, এখন পর্যন্ত শত শত রোগী আক্রান্ত হলেও মাঙ্কিপক্সে ভবিষ্যতে মহামারিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তিনি এটাও স্বীকার করেন যে, রোগটি সম্পর্কে এখনো অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। এর মধ্যে রোগটি আসলে ঠিক কীভাবে ছড়ায় এবং কয়েক দশক ধরে গুটিবসন্তের গণটিকা কার্যক্রম বন্ধ রাখায় কোনোভাবে মাঙ্কিপক্সের বিস্তার বৃদ্ধি পেয়েছে কি-না সে বিষয়গুলো জানা দরকার এবং এ জন্য গবেষণা করতে হবে।

মাঙ্কিপক্স বিষয়ে ডব্লিউএইচওর কারিগরি প্রধান ড. রোসামুন্ড লুইস সম্প্রতি বলেন, দেশে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত যে কয়েক ডজন রোগী পাওয়া গেছে, তাদের বেশিরভাগই সমকামী, উভকামী বা এমন পুরুষ যারা অন্য পুরুষদের সাথে একপক্ষীয় যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। বিষয়টিতে জোর দিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন বলে ড. লুইস মনে করেন। 

তিনি আরো বলেন, এটি ব্যাখ্যা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, সংক্রমণের মাধ্যম বৃদ্ধি পেয়েছে, যে বিষয়টা এর আগে পুরোপুরি লক্ষ করা হয়নি। তিনি এটাও বলেন, যে কারও যৌনচাহিদা যা-ই হোক না কেন, যে কেউই সম্ভাব্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, এটা একটা কাকতালীয় বিষয়ও হতে পারে যে, রোগটি শুরুতে সমকামী ও উভকামী পুরুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে তারা বলেন, দ্রুত রোধ করা না হলে রোগটি অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ডব্লিউএইচও গত ৩০ মে জানিয়েছে, আগে মাঙ্কিপক্সের রোগী ছিল না এমন ২৩টি দেশে ২৫০ জন রোগীর খবর পাওয়া গেছে। এটা এখনো অজানা যে, মাঙ্কিপক্স যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে ছড়াচ্ছে, না-কি যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু সংস্পর্শের মাধ্যমেই ছড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষদের জন্য এর ঝুঁকিকে ‘নিম্ন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //