করোনার নতুন উপ-ধরন

ইনফ্লুয়েঞ্জার উপসর্গ ঘরে ঘরে

আবারও বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। তবে একই সঙ্গে দেশে চলছে ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের মৌসুম। করোনা, ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ ও উপসর্গ প্রায় একই রকমের হওয়ায় সাধারণ মানুষ আছে বিভ্রান্তিতে। সর্দি, কাশিতে সারা দেশের মানুষ ভুগলেও এবার করোনা ঢাকা মহানগরীতেই বেশি। 

সারা দেশের মোট সংক্রমণের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই ঢাকা মহানগরীতে শনাক্ত হচ্ছে। এবার সংক্রমণ বাড়লেও হাসপাতালে রোগী ভর্তি অথবা মৃত্যু দুটিই তুলনামূলক কম। আগের মতো দেশে আর আতঙ্ক নেই। হাসপাতালে নানা ধরনের চিকিৎসা সামগ্রীর সরবরাহে ঘাটতি নেই। বিশেষ করে অক্সিজেনের যথেষ্ট পরিমাণ সরবরাহ আছে। নতুন করে করোনা সংক্রমণের পেছনে দায়ী ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের নতুন দুটি উপ-ধরন। এই দুটি উপ-ধরনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত করছে বি এ দশমিক ৫ নামক উপ-ধরনটি। আরেকটি উপ-ধরন আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা, তা হচ্ছে বি এ দশমিক ৪। 

যা-ই হোক করোনা সংক্রমণের বিশাল একটা অংশ ঢাকা মহানগরীতেই হচ্ছে। এটা হচ্ছে ঘন বসতি এলাকা হওয়ায়। তাছাড়া নতুন উপ-ধরনগুলোও আসছে প্রথমে ঢাকা মহানগরীতে। কারণ আন্তর্জাতিক হচ্ছে ঘন বসতি এলাকা হওয়ায়। তাছাড়া নতুন উপ-ধরনগুলোও আসছে প্রথমে ঢাকা মহানগরীতে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় এমনটা ঘটছে। বাইরে থেকে কেউ ঢাকায় প্রবেশ করলে তার সঙ্গে জীবাণু এ শহরের লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ঢাকা মহানগরই হয়ে উঠেছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের নতুন হটস্পট।

মহাখালীর আইসিডিডিআরবি গত ১৪ মে থেকে গত ২৪ জুন কোভিড পজিটিভ এমন ৫২টি নমুনা জিনোম সিকোয়েন্স পরীক্ষা করে। এ সময়ের মধ্যে ৫১টি নমুনায় তারা বি এ দশমিক ৫ অতিক্রনের উপ-ধরনটি পেয়েছে। অপর একটি নমুনায় তখন বি এ দশমিক ৪ উপ-ধরনটি পেয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে বি এ দশমিক ৫ উপ-ধরনেই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এসব সাব-ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তির হার কম বলে জানিয়েছে গবেষণা কেন্দ্রটি। 

গত ৬ জুলাই আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে, কোভিড-২ ভাইরাসটি ধীরে ধীরে একটির পর একটি উপ-ধরনের মাধ্যমে দুর্বল হয়ে আসছে। সর্বশেষ ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট ছিল ওমিক্রন, যা প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হয়েছে। করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনের বি এ দশমিক ৫ উপ-ধরনের শনাক্ত ৪০ জনের মধ্যে ৩৮ জনই কমপক্ষে এক ডোজ টিকা পেয়েছে। এদের মধ্যে আবার ১৬ জন বুস্টার ডোজও পেয়েছে, ২১ জন দুই ডোজ টিকা পেয়েছে এবং একজন মাত্র এক ডোজ টিকা পেয়েছে।

শনাক্তকৃত করোনা আক্রান্তদের ৩৯ জনের মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের লক্ষণ ছিল এবং একজনের মধ্যে কোনো লক্ষণ ছিল না। এদের মধ্যে শুধু একজন এক দিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আইসিডিডিআরবি বলছে, এর মানে এই দাঁড়ায় যে, নতুন উপ-ধরনের তীব্রতা একেবারেই কম। গবেষকরা তবু সবার প্রতি অনুরোধ করেছেন যে, সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন এবং প্রয়োজনীয়সংখ্যক টিকা নিয়ে নেন।

ওমিক্রনের উপ-ধরন বি এ দশমিক ৫-এর প্রথম সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত হয় গত ১৯ মে। তবে বাংলাদেশে প্রথম ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায় ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর।

গত কয়েক দিনে দেশে করোনার শনাক্ত ও মৃত্যু দুটিই কমেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারণা করা হয়েছিল ঈদের বন্ধের পর কয়েক দিন লাফিয়ে লাফিয়ে করোনা সংক্রমণ বাড়বে; কিন্তু এখনো সে রকম কিছু দেখা যায়নি। বরং ঈদের আগের চেয়ে ঈদের পর মোট করোনা সংক্রমণ বেশ কম রয়েছে।  তারা এ কারণে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন যে, ঈদের বন্ধের মধ্যে অনেকেই বাড়ি যাবে। গাড়িতে গাদাগাদি করে বাড়ি যেতে বাধ্য হবে। বাস্তবে এমনটাই হয়েছে। আবার ঈদের নামাজের পর কোরবানি করা এবং ঈদের খুশি ভাগাভাগি করতে আত্মীয়ের বাড়িতে মানুষ গিয়েছে। মোট কথা ঈদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যথেচ্ছ মেলামেশার কারণে ঈদের মধ্যে এখনকার চেয়ে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা ছিল। গত ঈদের মধ্যে সবই হয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস সংক্রমণ আগের চেয়ে কমই রয়েছে।  

তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা এখনো কমেনি। এখনো আগের মতোই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ জুলাই সকাল ৮টার আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১০ হাজার ৯৭৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তা থেকে দেশে করোনা পজিটিভ হয়েছিল এক হাজার ৭২ জন। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ। একই সময়ে করোনার কারণে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ৪ জন পুরুষ। অবশিষ্টরা নারী। তাদের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগে ২ জন করে ৬ জন এবং বাকি একজন সিলেট বিভাগের।

বর্তমানে দেশে ঘরে ঘরে জ্বর সর্দি কাশি :  দেশে এখন ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দি-কাশি। বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের মধ্যে রোগটির প্রাদুর্ভাব বেশি। শুরুতে সর্দি হয়ে থাকে। তার পর আসে জ্বর এবং জ্বরের মধ্যে অথবা জ্বর কেটে গেলেই শুরু হয় কাশি। অনেকে অসহ্য কাশিতে ভুগছেন। এমনও অনেকে রয়েছেন, কাশি কমানোর জন্য কফ সিরাপ সেবন শুরু করলেও তাতে কাজ হয়নি। 

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর জানিয়েছেন, ‘এটি ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের মৌসুম। সাধারণত এপ্রিল থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের মৌসুম শুরু হয় বাংলাদেশে; কিন্তু এ বছর জুন থেকে এ মৌসুমটি শুরু হয়েছে। করোনা ও ইনফ্লুয়েঞ্জা একসঙ্গে দেখা দেওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। করোনা অথবা ইনফ্লুয়েঞ্জা কোনটি হয়েছে, তা বুঝতে না পারায় অনেকেই করোনা পরীক্ষা করাতে চান না।’ 

এবারের জ্বরটা একটু ব্যতিক্রম। ঈদের আগের সাত দিন জ্বরে ভুগেছেন এমন একজন ভুক্তভোগী জানান, এবারের জ্বরে প্রচণ্ড ঘাম হয়েছে। নাকে ছিল সর্দি। কিছুক্ষণ পরপরই হাঁচি হয়েছে। এমন চলেছে তিন দিন। তিন দিন পরই শুরু হয়ে গেছে কাশি। গলায় কফ না থাকলেও কাশতে কাশতে পেটে ও বুকে ব্যথা ধরে গেছে। জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি প্যারাসিটামল সেবন করেছেন। একই সঙ্গে লেবু ও আদামিশ্রিত চা পান করেছেন ঘন ঘন। বেশি করে লেবু খেয়েছেন। ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাবার খাদ্য তালিকায় রাখার কারণে তিনি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েননি। তবে জ্বর সারেনি সাত দিনের আগে। ‘আপনার করোনা হয়েছে বলে মনে হয়নি?’ 

এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘মনে হয়েছে কিন্তু খুব বেশি ক্লান্তি লাগেনি বলে ভেবেছেন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস হতে পারে। সে কারণে তিনি আর টেস্ট করাতে যাননি। তবে তিনি বলেছেন, প্রথম দিন জ্বর শুরু হওয়ার পর সকালে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। বিশেষ করে পিঠে প্রচণ্ড অস্বস্তি ছিল। হাড়ে কিছুটা ব্যথা ছিল।’

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তারা এখন আগের চেয়ে অনেকে বেশি সর্দি-কাশি ও জ্বরের রোগী পাচ্ছেন। করোনা পরীক্ষার ব্যাপারে রোগীদের বেশ অনীহা রয়েছে। চিকিৎসকরা সাধারণত পরীক্ষা করা ছাড়া এখন সর্দি অথবা জ্বরের রোগী দেখতে চান না; কিন্তু তার পরও রোগীরা জ্বর নিয়েই চেম্বারে চলে আসছে। মাস্ক পরায় তো আমাদের দেশের মানুষের খুবই অনীহা রয়েছে। জ্বর হলেও তারা মুখে মাস্ক না নিয়েই ডাক্তারের চেম্বারে চলে আসছেন। করোনা হতে পারে তারা মানতেই চান না।

এই ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের মৌসুমে করোনা হোক অথবা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস হোক, সবাইকে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে। এ সময়ে জ্বর হোক বা না হোক সবার উচিত লেবুর শরবত পান করা। লেবুতে আছে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’।

এই ভিটামিন রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। লেবু ছাড়াও মাল্টা, জাম্বুরা, লটকন প্রভৃতি বেশি করে খাওয়া উচিত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //