দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত

বাংলাদেশে তিন কোটির বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। আক্রান্তদের ৫৯ শতাংশই জানেন না, তারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা ছাড়া বয়ে বেড়ালে ‘হার্ট অ্যাটাক’ হয়ে যেতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোকও হয়ে যেতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ চোখ ও কিডনির ক্ষতি করে।

সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি ভুগছেন এ রোগে। আক্রান্তদের ৫৯ শতাংশ না জানলেও উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা নিয়ে থাকেন ৩৬ শতাংশ। আবার এদের ১২ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। অর্থাৎ আড়াই কোটির বেশি মানুষ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকারি কিছু পদক্ষেপ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, গ্রাম পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপ মাপানো হচ্ছে। একজন রোগী উপজেলা হাসপাতালে এলে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লে, তাদের প্রতিবারে এক মাসের ওষুধ দেওয়া হয়। আগে এক সপ্তাহের ওষুধ দেওয়া হতো। এ বিষয়ে আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী আলিয়া নাহিদ বলেন, উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের সারা জীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। রোগী যেন কম ব্যয়ে ওষুধ পেতে পারেন, সে বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। এ ক্ষেত্রে সরকার বিনা মূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ হাসপাতালে সরবরাহ করতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ কী : হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন, কারও অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করার প্রবণতা থাকলে হয়তো সেটিকে হাইপারটেনশন বলে। কেউ মনে করেন কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হয়তো উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার সময় যে বুক ধড়ফড় করে সেটাই হাইপারটেনশন। হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে রক্ত প্রবাহের চাপ বেশি থাকলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার বলা হয়। একজন সুস্থ মানুষের রক্তচাপ থাকার কথা ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি; কিন্তু কারও পর পর দুদিন ১৪০/৯০-এর বেশি থাকলে তখন সে পরিমাণকে উচ্চ রক্তচাপ বলে চিহ্নিত করা হয়।

কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, উচ্চ রক্তচাপেরই আরেক নাম হাইপারটেনশন। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা এনএইচএস বলছে, হাইপারটেনশনকেই হাই ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ বলে। 

বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। বাংলাদেশে এক-চতুর্থাংশ মানুষের হাইপারটেনশন। এক সময় ধরে নেওয়া হতো ৪০ বছরের বেশি হলেই কারও উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা তৈরি হয়। এই চল্লিশ বছর হলেই বয়স্ক বলা হয়ে থাকে; কিন্তু এখন চিকিৎসকরা বলছেন, অল্প বয়সীদেরও হাইপারটেনশন হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. মনোয়ারুল কাদির বিটু জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ জানেন না যে, তারা হাইপারটেনশনে ভুগছেন। ফলে হার্ট অ্যাটাকের মতো অসুখ বাধিয়ে হাসপাতালে আসেন। এ ধরনের রোগীদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাঁচানোও সম্ভব হয় না। এ সমস্যাটা এড়ানো যায় যদি ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে হলেই নিয়মিত ব্লাড প্রেশার মাপানো হয়। তখন উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন করলেই সারা জীবন সুস্থ থাকা যায়। 

উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ : মাথাব্যথা, ঘাড় ব্যথা, অস্বস্তি বোধ, বুক ধড়ফড় করা এবং বমি বমি ভাব হলে এবং কারও বয়স ৩০-এর বেশি হলে তিনি ধরে নিতে পারেন যে তার হয়তো উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। ঘাড় ও মাথাব্যথার পাশাপাশি মাথা ঘোরা, অল্পে রেগে যাওয়া, রাতে ভালো ঘুম না হওয়ার মতো প্রবণতা থাকতে পারে।

এ সময় বিলম্ব না করে ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপটা মেপে নেওয়া উচিত। শরীরে অস্বস্তি অথবা মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা অথবা বমি বমি ভাব হলেই নিজে নিজে প্যারাসিটামল খেয়ে ফেলা অথবা বমির ওষুধ খেয়ে ফেলা উচিত নয়। এমন হলে হয়তো ব্লাড প্রেশার বেড়ে গিয়ে কোনো এক সময় হার্ট অ্যাটাক অথবা স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসকরা বলেছেন, বাংলাদেশে হাইপারটেনশনের যে রোগীরা আসেন, তাদের মধ্যে তিন ভাগের একভাগ রোগী জানেনই না যে তারা হাইপারটেনশনে ভুগছেন। এক ভাগ রোগী আসেন ঘাড়ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি ভাব বা বমি হওয়া, শরীর খারাপ এমন ধরনের উপসর্গ নিয়ে। এক ভাগ রোগী আসেন উচ্চ রক্তচাপের ফলে সৃষ্ট জটিলতা যেমন ‘হার্ট ফেইলিওর বা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক’ নিয়ে।

কীভাবে বাড়ে রক্তচাপ : চিকিৎসকরা বলেছেন, নির্দিষ্ট করে জানা যায় না যে, ঠিক কী কারণে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের প্রাথমিক কারণের সঙ্গে বংশগতির সম্পর্ক থাকে। যাদের অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হয়, তাদের কিছু কারণে তা হয়। তাদের  কিডনিতে সমস্যা হতে পারে, তাদের রক্তনালি সরু হয়ে যেতে পারে, হরমোন সমস্যা থাকতে পারে, হতে পারে থাইরয়েড সমস্যা, পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের সমস্যা দেখা দিতে পারে, মস্তিষ্কে কোনো সমস্যা থাকলেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। আবার স্টেরয়েড গ্রহণের ধারাবাহিকতা থাকলেও হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলেও উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকতে পারে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, উচ্চ রক্তচাপের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৯৪ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ উচ্চ রক্তচাপের কারণে নানা জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন। উচ্চ রক্তচাপ পৃথিবীতে অসুখে ভুগে মারা যাওয়ার প্রধান কারণ। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মানুষ মাথা থেকে পা পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারেন। এ থেকে হার্ট অ্যাটাক এবং হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।

চিকিৎসকরা বলছেন, এ ব্যাপারে অবশ্যই মানুষ সতর্ক থাকতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ থেকে বেঁচে থাকার উপায়গুলো হলো- খাবারে আলগা লবণ বাদ দিতে হবে; ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে; শাক-সবজি, ফলমূল বেশি করে খেতে হবে; নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করতে হবে;  নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করতে হবে; রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, এটাাকে অন্য ভাষায় বলা যায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ ছাড়া তামাক ও তামাক জাতীয় বস্তু ত্যাগ করতে হবে; পরিমিত ঘুমাতে হবে; স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমাতে হবে; চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবে না। বাংলাদেশের সরকারের উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক একটি গাইডলাইন আছে, যাতে কম ওষুধ সেবন করে এবং জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টাকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

বস্তিবাসীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ : ঢাকার বস্তিবাসীদের স্থূল হওয়ার হার জাতীয় গড় স্থূল হারের চেয়েও বেশি। ‘ঢাকার বস্তি বাসিন্দাদের মধ্যে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকির প্রাদুর্ভাব : জনগোষ্ঠীর সব স্তর ভিত্তিক জরিপ’। এতে বলা হয়, বস্তির নারীদের স্থূলতার হার ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ এবং পুরুষদের ১৯ শতাংশ।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশি পরিমাণে ভাত খাওয়া, ভ্রাম্যমাণ ভ্যান বা দোকানে তৈরি নানা পদের মসলাদার খাবার এবং অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি, লবণ খাওয়াও বস্তিবাসীর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য দায়ী। কাজের ও জীবনধারায় পরিবর্তন বস্তিবাসীদের স্থূল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। বস্তির পুরুষের তুলনায় নারীরা কায়িক পরিশ্রম কম করে থাকেন। তাই নারীদের মোটা হওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।

এমনকি শহরের বস্তির নারীরা গ্রামের নারীদের তুলনায়ও কম পরিশ্রম করে থাকেন। বস্তিবাসী এনার্জি ড্রিংকস, ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত চিনি, তেলেভাজা খাবার এসব বেশি পরিমাণে খেয়ে থাকে। এ কারণে এদের হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসারের মতো বিভিন্ন অসংক্রামক রোগও হচ্ছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //