দেশে কর্মক্ষম ২৫ লাখ মানুষ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত

বাংলাদেশে কর্মক্ষম ২৫ লাখ মানুষ হেপাটাইটিসের জীবাণু নিয়ে ঘুরছে। এদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। কোনো দেশের এই বয়সের জনসংখ্যাই সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম। আবার এদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাটাই বেশি। অর্থনৈতিকভাবে খুবই সম্ভাব্য এই আক্রান্তদের বেশির ভাগই হেপাটাইটিস ‘বি’ ও হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গবেষণা অনুযায়ী, এই ২৫ লাখসহ বাংলাদেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে প্রায় ৮৫ লাখ এবং অবশিষ্টরা ‘সি’, ‘ই’, ‘এ’ দ্বারা আক্রান্ত।

হেপাটোলজিস্টরা বলছেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫.১ শতাংশ বি ভাইরাসে ও ০.২ শতাংশ সি ভাইরাসে আক্রান্ত। আক্রান্তদের ৯৫ শতাংশই জানেন না যে, তারা ঘাতকব্যাধি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। সময়মতো এবং সঠিক চিকিৎসা না করাতে পারলে এদের শেষ পরিণতি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া। লিভার সিরোসিস হলে বেশির ভাগেরই মৃত্যু প্রায় অনিবার্য, কারণ লিভার সিরোসিস হলে তা থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব থাকে না। চিকিৎসকরা বলছেন, শেষ মুহূর্তে কাবু হয়ে গেলে কেবল তখনই তারা চিকিৎসকের কাছে যান এবং জানতে পারেন। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) লিভার বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. শাহীনুল আলমের নেতৃত্বে ২০১৭ সালে পরিচালিত

গবেষণা থেকে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে জানা যায়। তিনি এ ব্যাপারে জানান, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত মোট ৮৫ লাখ মানুষের মধ্যে ৫৭ লাখ পুরুষ এবং অবশিষ্ট ২৮ লাখ নারী। সন্তান দানে সক্ষম ১৮ থেকে ৪৫ বছরের নারীর সংখ্যা ১৮ লাখ। গবেষণা অনুসারে, দেশে প্রতি ৫০০ জনে একজন হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত। ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বি ভাইরাসে আক্রান্তদের হার সবচেয়ে বেশি। আক্রান্তদের মধ্যে গ্রামের কৃষকের সংখ্যাও কম নয়। কৃষকদের মধ্যে আক্রান্তের হার ৮.৯ শতাংশ। 

অধ্যাপক ডা. শাহীনুল আলম বলেন, বাংলাদেশে একিউট হেপাটাইটিসের (জন্ডিস) জন্য ৪৩ শতাংশ ‘ই’ ভাইরাস দায়ী, ১৫ শতাংশের জন্য ‘বি’ ভাইরাস, ৮ শতাংশের জন্য হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাস দায়ী। লিভার সিরোসিসের জন্য ‘বি’ ভাইরাস দায়ী ৬০ শতাংশ, ‘সি’ ভাইরাস দায়ী ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে। লিভার ক্যানসারের জন্য ৬৫ শতাংশ দায়ী ‘বি’ ভাইরাস এবং ‘সি’ ভাইরাস দায়ী ১৭ শতাংশ। 

অন্যদিকে গর্ভাবস্থায় শিশুদের হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৯০ শতাংশ। গর্ভাবস্থা থেকেই যদি শিশু হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়, তাহলে শিশুদের শেষ পর্যন্ত লিভার সিরোসিস ও ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বার্থ অ্যাটেনডেন্ট (দাই) ছাড়া বাড়িতে অনভিজ্ঞ দাইয়ের হাতে সন্তান প্রসব হলেও হেপাটাইটিসের ঝুঁকি থাকতে পারে। 

লিভার সার্জন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী বলছেন, গর্ভাবস্থায় মা হেপাটাইটিস ‘বি’ কিংবা ‘সি’তে আক্রান্ত হলে ছয় সপ্তাহের মধ্যে গর্ভস্থ সন্তানের দেহে জীবাণুটি প্রবেশ করে। গর্ভাবস্থায় পরীক্ষা করা হলে অনাগত শিশুর হেপাটাইটিস এড়ানো সম্ভব। পরীক্ষা করে জেনে নবজাতককে জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা দিতে পারলে ওই শিশুকে হেপাটাইটিস থেকে রক্ষা করা যায়। বিষয়টি আমরা সরকারকে অবহিত করেছি। এখন সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পালা। দেশ প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান প্রসবের হারের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখনো বাড়িতে ৫০ শতাংশের বেশি প্রসব হচ্ছে। কিন্তু গ্রামের মা ও দাই এদের কেউই এ ব্যাপারে সচেতন নন। এতে করে মায়ের মাধ্যমে সন্তান সংক্রমিত হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারের মানুষও শঙ্কার কারণ। কারণ রোহিঙ্গাদের অনেকের সঙ্গে কক্সবাজারের স্থানীয়দের মধ্যে যোগাযোগ আছে। আত্মীয়তার সম্পর্কও আছে। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ১৮ শতাংশই হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘বাংলাদেশে বি ও সি ভাইরাস ১ শতাংশেরও নিচে থাকলেও রোহিঙ্গাদের আক্রান্তের হার অনেক বেশি। এ জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং চিকিৎসা ব্যয় কমাতে হবে। হেপাটাইটিসের একটা টিকার দাম ৩০০-৪০০ টাকা, মাসে অন্যান্য চিকিৎসা বাবদ খরচ হয় ১০-১২ হাজার টাকা।’

চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসার চেয়ে যে কোনো রোগ প্রতিরোধ সবচেয়ে উত্তম। হেপাটাইটিসের চিকিৎসায় সরকার শেখ রাসেল, বারডেম ও শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে কয়েক কোটি টাকা দিয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে যদি চিকিৎসা ও প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা দেওয়াও সম্ভব হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা দেওয়া সম্ভব নয়।

হেপাটোলজির চিকিৎসকরা বলছেন, মারাত্মক ভাইরাসের মধ্যে হেপাটাইটিস ই ও হেপাটাইটিস এ ভাইরাস পানিবাহিত। সি ভাইরাস রক্তবাহিত। অন্যদিকে বি ভাইরাস মায়ের কাছ থেকে শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে থাকে। আবার অনিরাপদ যৌন কর্ম ও রক্ত নেওয়ার মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে। হেপাটাইটিস দ্বারা লিভার ক্যানসার হয়ে গেলে বায়োপসি ছাড়াও বিদেশে রক্ত পরীক্ষা করে জানা যায়। 

বাংলাদেশ সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি অর্জন অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্যে পৌঁছতে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃব্যবস্থাপনা করতে হবে দেশের প্রতিটি পরিবারের জন্য। বর্তমানে সরকার একটি জায়গায় পয়ঃবর্জ্য ফেলার ব্যবস্থা করেছে কিন্তু তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃব্যবস্থাপনার অভাবেও হেপাটাইটিস এ ও সি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়ের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মৃত্যু হয়ে থাকে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হওয়ায়। গর্ভাবস্থায় ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলে লিভার অকেজো (যকৃৎ বা কলিজা) হয়ে যায়। গর্ভাবস্থায় মাকে হেপাটাইটিসের টিকা দেওয়া হলে বি ভাইরাস মা থেকে সন্তানের মধ্যে আসা রোধ করা যায়। আবার সন্তান জন্মের ১২ ঘণ্টার মধ্যেও টিকা দেওয়া হলে সন্তান হেপাটাইটিস মুক্ত থাকতে পারে। 

এছাড়া চিকিৎসা যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করে একাধিকবার ব্যবহার হয় বলে আমাদের দেশের অনেক মানুষ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। চিকিৎসকদের অসাবধানতায় একজন সুস্থ মানুষ জীবনঘাতী ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন যন্ত্রপাতির বহু ব্যবহারের কারণে। আমাদের দেশে এখনো একই চিকিৎসা যন্ত্র পানিতে সামান্য ধুয়ে রোগীদের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। একই যন্ত্র দিয়ে একাধিক মানুষকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হলে যন্ত্রটিকে জীবাণুমুক্ত করে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেকটা অবহেলা আবার সামর্থ্যহীনতার কারণে অনেকে চিকিৎসক তা করেন না। দাঁতের চিকিৎসা ছাড়াও সার্জারির ছোরা-কাঁচি ইত্যাদি, কলোরেক্টাল চিকিৎসকদের প্রক্টোস্কোপি যন্ত্রপাতি, এন্ডোস্কপির যন্ত্রপাতির মাধ্যমে হেপাটাইটিস একজন থেকে আরেকজনে ছড়াতে পারে। অন্যদিকে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারদের কাটাছেঁড়া করার যন্ত্রপাতি থেকে প্রতিনিয়তই হেপাটাইটিস ভাইরাসটি ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। কারণ তারা কখনোই স্বাস্থ্য সম্মতভাবে যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করতে পারেন না। 

এসব ছাড়াও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ভাইরাস নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। টিকা দেওয়া হলে বি ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকা যায় কিন্তু সি ভাইরাসের টিকা নেই। তবে সঠিক চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যাওয়া সম্ভব যদি শুরুতে চিকিৎসা করানো হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, হেপাটাইটিসের চিকিৎসা এখন অনেক সহজ। আগের মতো এত খরচ হয় না। ৩০ বছর আগে বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অনেক টাকার ইনজেকশন নিতে হতো। কিন্তু এখন স্বল্প খরচের ট্যাবলেট দিয়েই তা চিকিৎসা করা যায়। আমাদের দেশেই সব ওষুধ তৈরি হয়ে থাকে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //