অবহেলিত সেপসিস রোগ

অবহেলিত পচনশীল ক্ষত রোগে (সেপসিস) দেশে বছরে ২ লাখ মানুষ মারা যায়। সঠিক সময়ে রোগটি চিহ্নিত করতে না পারায় মানুষ ভোগে বেশি। রোগটিতে সেপসিসও বলা হয়ে থাকে। ফুসফুস, কিডনি, খাদ্যনালি বা অন্য যে কোনো অঙ্গের সংক্রমণ (জীবাণু) রক্তে প্রবেশ করলে সেপসিস হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন বয়সী প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মানুষ সিপসিসে আক্রান্ত হলেও সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে বছরে প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। ক্যান্সারে মৃত্যুর প্রায় সমান অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি মৃত্যু হয়ে থাকে এই রোগে। 

আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্নাল লেনসেট বলছে, ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী ৪ কোটি ৮৯ লাখ মানুষের সেপসিস হয়েছে। একই বছরে বিশ্বে এক কোটি ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শরীরের কোনো অঙ্গে তীব্র সংক্রমণ দেখা দিলে এবং অন্য কোনো অঙ্গ নতুন করে অকার্যকর হয়ে গেলে তা সেপসিস হিসেবে অভিহিত করেন চিকিৎসকরা।

এটাকে পচনশীল ক্ষতের রোগও বলা হয়ে থাকে। রোগটিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় দরিদ্ররা। ধনী দেশের মানুষ যারা উন্নত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত, তাদেরও রোগটি হচ্ছে। 

সেপসিস কী

সেপসিস গুপ্ত ঘাতক হিসেবে পরিচিত মারাত্মক একটি রোগ, কারণ এটি শনাক্ত করা কঠিন। মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অতিরিক্ত হয়ে গেলে তা সংক্রমণের (ইনফেকশান) বিরুদ্ধে লড়াই করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে আক্রমণ করতে শুরু করে। তখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেবল জীবাণুর বিরুদ্ধেই কাজ করে না, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও শত্রু মনে করে আক্রমণ করতে থাকে।

এমনটি চলতে থাকলে এক পর্যায়ে মানুষের কিছু অঙ্গ অকার্যকর হয়ে যায়। ওই মানুষের নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয় এবং অকার্যকর হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংক্রমিত হয়। সংক্রমণের স্থান থেকে সেপসিস রক্তের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থা হলে অনেক সময় সুস্থ করার জন্য কোনো কোনো অঙ্গ কেটে ফেলে দেন চিকিৎসকরা। তারা বলেন, এ ক্ষেত্রে ফুসফুসের সংক্রমণের কথা বলা যেতে পারে। 

ফুসফুসের সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে কয়েক দিনের মধ্যে ওই সংক্রমণ থেকে রোগী সুস্থ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ঝুঁকিতে থাকা রোগীদের অবস্থা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারাত্মক হয়ে পড়তে পারে। প্রাথমিক স্থান থেকে জীবাণু শরীরের অন্য জায়গায় চলে যায়। যেমন পায়ের বুড়ো আঙুলের সংক্রমণ থেকে জীবাণু রক্তপ্রবাহে ঢুকে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রমণ করে সেগুলো বিকল করে দিতে পারে।

এমতাবস্থায় প্রায়ই সঠিক রোগটি ধরা পড়ে না। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক না হলে প্রায় রোগটি শনাক্তের বাইরে রয়ে যায়। সেপসিসে যত আক্রান্ত হন এর মধ্যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের সংখ্যা ৮৫ শতাংশ। এর মানে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে। পাঁচ বছরের কম বয়সী ১০ শিশুর মধ্যে প্রতি চারটি শিশু সেপসিসের ঝুঁকিতে থাকে।

 ১৯৫টি দেশের মেডিক্যাল রেকর্ডের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় আন্তর্জাতিক জার্নাল ল্যানসেটে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। বিশ্বজুড়ে বছরে যত মানুষ মারা যান, তাদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের মৃত্যুর কারণ সেপসিস। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষের মধ্যে রোগটি বেশি দেখা যায়। লেনেসেটের ওই বিশ্লেষণধর্মী গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯০ সালের পর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার ক্রমান্বয়ে কমছে।

লক্ষণ 

সেপসিস আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক হলে কথা-বার্তা অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। চরম কাঁপুনি বা পেশিতে ব্যথা হতে পারে। এমনও হতে পারে সারাদিনে একবারও প্রস্রাব হবে না, অনেকের মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হতে পারে, একই সঙ্গে রোগীর  দ্রুত হৃদস্পন্দন এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে যেতে পারে।  এছাড়া ত্বকের রঙ একেক জায়গায় একেক রকম বা ত্বকে ছোপ ছোপ দাগ দেখা দিতে পারে। 

শিশুদের সেপসিস হলে এদের চেহারা নীলচে বা ফ্যাকাসে হয়ে যেতে পারে। ত্বকের রঙ একেক জায়গায় একেক রকম হতে পারে। অনেক সময় শিশুর মধ্যে খুব অলস ভাব আসতে পারে বা শিশুকে ঘুম থেকে জাগানো কঠিন হতে পারে। শিশুর শরীর স্পর্শ করলে অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা অনুভূত হতে পারে। সেপসিসে আক্রান্ত হলে খুব দ্রুত শ্বাস নিতে পারে। ত্বকে ফুসকুড়ি হতে পারে। এই ফুসকুড়িগুলো হাতে চাপ দিলে মুছে যায় না। শিশু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে বা খিঁচুনি হতে পারে। 

প্রতিরোধের উপায় 

সংক্রমণের সংখ্যা কমিয়ে আনার মাধ্যমে সেপসিসে আক্রান্তের সংখ্যা কমানো যেতে পারে। সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি এবং সঠিক সময় সঠিক টিকা দেওয়া হলে শিশুদের ক্ষেত্রে সেপসিস প্রতিরোধ করা যায়। দেরি হওয়ার আগেই সেপসিস আক্রান্ত রোগীদের চিহ্নিত করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টি-ভাইরাসের (টিকা) মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সেপসিসের রোগীদের মানসিক সমস্যা 

উন্নত বিশ্বে নিবিড় পর্যবেক্ষণ বিভাগে (আইসিইউ) সেপসিস রোগীকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃত্রিমভাবে ‘কোমায়’ রাখা হয়। কোমা থেকে জাগানো হলে প্রায়ই রোগীর মধ্যে প্যানিক অ্যাটাক হয়। তারা ভোগেন ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’-এ। দেখা দিতে পারে পেশি ও স্নায়ুর দুর্বলতা। তখন স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায় বলেও চিকিৎসকরা বলছেন।

সেপসিস থেকে সেরে ওঠা রোগীদের কোনো বাক্যের অর্থ বুঝতে হলে বাক্যটিকে বেশ কয়েকবার পড়তে হয়। মস্তিষ্কও আগের মতো কাজ করে না। চরম মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত থাকেন তারা।

অধিকাংশ সেপসিস হয় হাসপাতাল থেকে

গবেষণা থেকে দেখা যায়, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সেপসিস হয়ে থাকে হাসপাতালে অবস্থানকালে। বড় অপারেশনের পর ক্ষত সারতে অনেক দিন লেগে যায় বলে রোগীকে হাসপাতালে দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়। আর হাসপাতালে রয়েছে নানা ধরনের জীবাণু। এই জীবাণু গুলোর বেশির ভাগই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক। 

ফলে এদের ধ্বংস করতে পারে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালে দুর্বল ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার রোগী এলে তাদের মধ্যে দ্রুত জীবাণু সংক্রমিত হয়ে শেষ পর্যন্ত সেপসিসে আক্রান্ত হয়ে যায় এবং তাদের রক্তদূষণের পথ খুলে যায়। 

গবেষণায় বলা হয়েছে, হাসপাতাল সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে এবং শুরু থেকেই জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে রাখলে ২০ শতাংশ সেপসিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ওপর হাসপাতালের কর্মীদের ভালো প্রশিক্ষিত করা উচিত। 

এছাড়া সবাইকে প্রয়োজনীয় টিকা দেওয়ার ওপর জোর দিতে হবে যাতে ফ্লু ও ফুসফুসের সংক্রমণের মতো রোগব্যাধি না হতে পারে। 

সংক্রমণ কমানোর উদ্দেশ্যে হাসপাতালে ইনফেকশন প্রিভেনশন টিম থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে বড় কিছু হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও এ ধরনের টিম নেই। অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি হাসপাতালে একটি পর্যবেক্ষক টিমও থাকা উচিত।

যুক্তিসঙ্গতভাবে একজন রোগীর যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার উচিত বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম মোজাহেরুল হক।

তিনি বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক যেমন উপকারী তেমনি এর ব্যবহার সঠিক না হলে তা ক্ষতির কারণ হয়। এ জন্য অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন, বিপণন, সংরক্ষণ নজরদারির মধ্যে রাখতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। তা করতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা নিরাপদ বিশ্ব রেখে যেতে পারবো না।

মনে রাখতে হবে, কোয়ালিফায়েড (নিবন্ধিত) চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক কেনা-বেচা উচিত নয়। আমাদের দেশে এখনো ফার্মেসির দোকানদার থেকে মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাচ্ছেন, এটা বন্ধ করতে হবে আইন করে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটা নীতিমালা করা ও সেই নীতিমালা প্রয়োগ করতে হবে কঠোরভাবে।’

তিনি বলেন, ‘একজন জ্বরের রোগীকে রক্ত, প্রস্রাব পরীক্ষা করে রোগের প্রকৃত কারণ বের করে ওষুধ দেওয়া উচিত। তা আমাদের দেশে চালু হয়নি। এটা করা উচিত, না করলে মানুষ সেপসিসের মতো অনেক রোগ বয়ে বেড়াবে ভুল ওষুধের কারণে। কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক লেখার আগে মাইক্রোবায়োলজিস্টের অনুমোদন লাগে, সে সংস্কৃতিই আমাদের দেশে চালু হয়নি। এই কথাটি অনেক চিকিৎসক জানেনই না।’ 

২০৩০ সালের মধ্যে সেপসিস লক্ষ্যমাত্রা 

২০৩০ সালের মধ্যে সেপসিস নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যমাত্রা বিশ্ব সেপসিস নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ সেটি পূরণ করতে পারবে কি না তা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। এর প্রথম পর্যায়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো গবেষণা। বাংলাদেশে সেপসিস নিয়ে এখনো বড় ধরনের কোনো গবেষণা হয়নি।

সাম্প্রতিক কালের কোভিড মহামারিতে প্রায় ২০ হাজার চিকিৎসক ও নার্সকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে কোন রোগে কোন কোন অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে, সে নীতিমালা সব হাসপাতালে, এমনকি প্রাইভেট চেম্বারের চিকিৎসককেও দিতে হবে। 

সেপসিসের চিকিৎসায় চুম্বকের ব্যবহার পরীক্ষা

সেপসিসে আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা থাকে মাত্র ৫০ শতাংশ। এই রোগটি হলে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকসহ অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়ে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রমণ করে অকার্যকর করে দেয়।

বিজ্ঞানীরা রক্ত থেকে এসব ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও বিষাক্ত পদার্থ বের করতে চুম্বকের ব্যবহার নিয়ে কাজ করছেন। ইঁদুরের ওপর করা এই পরীক্ষায় তারা সফলও হয়েছেন। গবেষণাটি সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’ মেডিসিনে প্রকাশিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //