অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ রোগ বাড়ায়

প্রেসক্রিপশন ছাড়া দোকান থেকে নিজে নিজেই ওষুধ কিনে খেলে হয়তো কিছু রোগ থেকে সুস্থ হওয়া যায়। কিন্তু ওষুধগুলো বারবার অনিয়ন্ত্রিতভাবে খেলে সুস্থতার চেয়ে নতুন অসুখ বাসা বাঁধে শরীরে। কমে যেতে পারে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।

এটা যে অনিয়ন্ত্রিত ওষুধের প্রতিক্রিয়া রোগী তা হয়তো বোঝেন না; কিন্তু নতুন অসুখ সারাতে ব্যয় হয়ে যায় অনেক এবং ব্যাপক ভোগান্তির পর। একজন রেজিস্টার্ড ডাক্তারই ভালো বোঝেন কোন অসুখের জন্য কোন ওষুধটি দিতে হবে এবং কতদিন দিতে হবে। বারবার একই ধরনের ওষুধ খেলে দেখা যায় রোগটি আর আগের মতো দ্রুত ভালো হয় না।   

মাল্টিভিটামিন

মাল্টিভিটামিন অনেক উপকার করে, এতে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু মাল্টিভিটামিন বেশি ও ঘন ঘন খেলে হাইপার ভিটামিন টক্সিসিটি, নিউরোপ্যাথি হয়। নিউরোপ্যাথি স্নায়ুর সমস্যা। নিউরোপ্যাথির রোগীদের ক্রমাগত ব্যথা, কাজে অক্ষমতা, এমনকি চলাচলে অসুবিধা হয়।

নিউরোপ্যাথিতে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগের হার বেশি। ব্যথা ও অক্ষমতার তীব্রতা যত বেশি, মানসিক সমস্যা তত বেশি বাড়ে। নিয়মিত সুষম খাবার খেলে ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ হয়, ভিটামিন জাতীয় ওষুধ খেতে হয় না। 

ওজন কমানোর ওষুধ

ওজন কমাতে অনেকে অ্যান্টি ডায়াবেটিস ওষুধ খায়। এতে করে হঠাৎ করে গ্লুকোজ বা সুগার কমে ওজন কমে যেতে পারে। এই প্রবণতা স্বাস্থ্যের জন্য বিপদ ডেকে আনে। ওষুধ খেয়ে নয়, ধীরে ধীরে ওজন কমানোই শ্রেয়। ওজন কমাতে নিয়মিত ব্যায়াম ও ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস করতে হবে। বাংলাদেশের ৩০ ভাগ মানুষ অফিসে বসে কাজ করেন। এর বাইরেও অনেকে আছেন যারা খাদ্য গ্রহণের তুলনায় শারীরিক পরিশ্রম কম করেন।

ফলে তাদের ওজন বৃদ্ধি পায়। আর এদের মধ্যেই ওজন কমাতে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা বেশি। বসে বসে যারা কাজ করেন তাদের ব্যায়াম করা দরকার। দৌড়াতে না পারলে বাসায় দড়ি দিয়ে লাফানোর ব্যায়ামের অভ্যাস করা যায়। তাও না পারলে নিয়ম করে ঘাম ঝরিয়ে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। কোনোভাবেই ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো উচিত নয়।

ওমিপ্রাজল 

বাংলাদেশে মুড়ি-মুড়কির মতো খাওয়া ওষুধ প্যারাসিটামলের পর ওমিপ্রাজলের নাম আসে। পেটে গ্যাসের সমস্যার জন্য কিছুদিন আগেও রেনিটিডিন গ্রুপের ওষুধ ছিল। এখন রেনিটিডিন বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আছে ওমিপ্রাজল গ্রুপের বিভিন্ন নামের ওষুধ। চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়াই পেটে কোনো সমস্যা হলেই মানুষ এই ওষুধ কিনে খেতে শুরু করেন। এতে  তাৎক্ষণিকভাবে গ্যাসের কষ্ট হয়তো কমে, কিন্তু অনেকের ডায়রিয়া শুরু হয়ে যায়।

তখন শরীর থেকে পুষ্টি বেরিয়ে যায়, আয়রন গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায়। শরীর প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি পায় না বলে রোগীদের শরীরে রক্তশূন্যতাও তৈরি হতে পারে। সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হয়- দীর্ঘদিন ধরে এসব ওষুধ খেলে শরীরে অ্যাসিডের মাত্রা কমে যায়। প্রয়োজনীয় অ্যাসিড সৃষ্টি হওয়ায় আগে যেসব ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যেত, বেশি পরিমাণে ওমিপ্রাজল জাতীয় ওষুধ খেলে তা আর হয় না। আবার অ্যাসিডের অভাবে ক্যালসিয়াম দ্রবীভ‚ত হয় না, ফলে হাড়ের ক্ষয় বাড়ে। 

পেটের গ্যাস কমানোর ওষুধ বাংলাদেশে এখন সর্বাধিক বিক্রি ওষুধগুলোর একটি। ঢাকা শহরের কোনো জনবহুল এলাকায় মাঝারি মানের একটি ফার্মেসিতেও দৈনিক কম করে হলেও ৫ হাজার টাকার গ্যাসের নানা ধরনের ওষুধ বিক্রি হয়ে থাকে। গ্যাসের ওষুধ বেশি খাওয়ার পেছনের কারণটি হলো মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি বিরিয়ানি, জাংকফুড, পিৎজা, বার্গার ইত্যাদি খাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গ্যাসের ওষুধে ব্যক্তি সাময়িক সুস্থতা বোধ করলেও এর একটি খারাপ দিক রয়েছে। এ ধরনের ওষুধ দীর্ঘদিন খেলে ভিটামিন বি-১২-এর ঘাটতিও দেখা দেয়। 

ব্যথার ওষুধ 

সামান্য জ্বর হলেই অথবা শরীর ব্যথা করলেই নিজে থেকেই প্যারাসিটামিল খেয়ে ফেলার একটি সাধারণ প্রবণতা আমাদের দেশে রয়েছে। জ্বর ছাড়া শরীরের অন্যান্য ব্যথায় আইবুপ্রোফেন অথবা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধও কিনে খেতে শুরু করেন। জ্বরের সঙ্গে সামান্য ব্যথা হলে অনেকে প্যারাসিটামলেই খুশি থাকেন না, তারা এসিটামিনোফেন খেয়ে থাকেন।

প্যারাসিটামল একটি নিরাপদ ওষুধ হলেও নির্বিচারে ও অনেক দিন খেলে শরীরের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে অকার্যকর করে দেয়। চিকিৎসক রোগের ধরন অনুযায়ী লিখে দেন, ওষুধটি কীভাবে ও কতদিন খেতে হবে। চিকিৎসকরা বলছেন, প্যারাসিটামল বা এসিটামিনোফেন এক ধরনের অ্যাসিড।

এই অ্যাসিড জাতীয় ওষুধটি খালি পেটে খেলে পাকস্থলীর ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। এছাড়া প্যারাসিটামল বা এসিটামিনোফেন দীর্ঘদিন খেলে যকৃতের ক্ষতি হতে পারে, কিডনির কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। 

অ্যাসপিরিন

অ্যাসপিরিন খুব প্রয়োজনীয় একটি ওষুধ, আবার খুবই বিপজ্জনক। বয়স্ক মানুষ- যাদের হার্টের সমস্যা ও ডায়াবেটিসসহ বয়সজনিত অন্যান্য অসুখ আছে তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওষুধটি দিয়ে থাকেন। ওষুধটি দিয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা, তাও তারা পর্যবেক্ষণ করেন।

কিন্তু ইচ্ছামতো ওষুধটি খেলে একপর্যায়ে খাদ্যথলি ও অন্যান্য নালি ফুটো হয়ে যেতে পারে। অথবা পাকস্থলীর ভেতরের উপরের স্তরে ঘা হয়ে যেতে পারে। তখন রক্তক্ষরণও হয়ে থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন, রোগীরা নিজে নিজে ওষুধটি খেয়ে একসময় পায়খানার পথের রক্তক্ষরণে অথবা রক্তবমি নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। তাই প্যারাসিটামল ও অ্যাসপিরিন নির্বিচারে খাওয়া ঠিক নয়। চিকিৎসক যত দিন বলবেন, এর বাইরে খাওয়া উচিত নয়।

অ্যান্টিবায়োটিক

অ্যান্টিবায়োটিককে ম্যাজিক ওষুধ বলা হয়। এক সময় পেটের পীড়ায় গ্রামের পর গ্রামের মানুষের মৃত্যু হতো। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর পেটের পীড়া বা ডায়রিয়াসহ অন্যান্য জীবাণু সংক্রমিত রোগের বিরুদ্ধে এটি প্রয়োগ করা রোগীকে সুস্থ করে তোলা হয়।

এখন তো নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়েছে। এই উপকারী ওষুধটিও মানুষ নির্বিচারে খাওয়া শুরু করেছে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে জীবাণু প্রতিরোধী হচ্ছে। একেক অ্যান্টিবায়োটিকের একেক ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। নির্বিচারে খেলে অথবা সঠিক অ্যান্টিবায়োটিকটি রোগের বিরুদ্ধে না পড়লে ডায়রিয়া, র‌্যাশ, পেটব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখার মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে অন্যান্য আরও রোগের সম্পর্ক আছে। এটা চিকিৎসকরা ভালো বোঝেন। ওষুধটি কখনোই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত না। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু তা মানা হয় না। এ জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। 

মোটা হওয়ার ওষুধ

স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খেয়ে মেটা হওয়া যায়; কিন্তু এর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এই ওষুধটি খেলে মোটা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, গ্যাসট্রিক আলসার, চুল পড়া, সাইকোসিস নামক মানসিক রোগ, অস্টিওপরোসিসের মতো হাড় ক্ষয় রোগ হতে পারে। মোটা হওয়ার জন্য অনেকে এসব ওষুধ খেলে সারাজীবনের জন্য ভোগান্তিতে পড়তে পারেন। আবার এটা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে এডিসনিয়ান ক্রাইসিস তৈরি হতে পারে, যাতে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে। 

মেট্রোনিডাজল

বাংলাদেশের জনপ্রিয় আরেকটি ওষুধ হলো মেট্রোনিডাজল। এই গ্রুপের ওষুধ পেট খারাপ হলেই মানুষ কিনে খেয়ে থাকেন। এটিও এক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে শরীরে র‌্যাশ ওঠার পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। ফলে রক্তক্ষরণ, পেটে ব্যথার সমস্যা হতে পারে। আবার অনেকে পায়খানা নরম করার জন্য ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ওষুধ খেয়ে থাকেন। এটি বেশি খেয়ে ফেললে শরীরের ইলেট্রোলাইট ইমব্যালান্স হয়ে যেতে পারে। 

কী বলছেন চিকিৎসকরা

কয়েকটি কারণে ফার্মেসি থেকে নিজে নিজে ওষুধ ক্রয় করে মানুষ। এর একটি কারণ হলো জনসংখ্যার তুলনায় ডাক্তার অনেক কম, অন্যদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে চিকিৎসকের কাছে যেতে না পারা। ফলে অনেকে গুরুতর অসুস্থ না হলে ডাক্তারের কাছে যান না। ওষুধের দোকানে গিয়ে সমস্যার কথা বলে ওষুধ নিয়ে আসেন। ফার্মেসির লোকজনও তাদের একটা ওষুধ দিয়ে দেন।

এতে কিছু সমাধানের সঙ্গে অনেক ধরনের সমস্যাও হয়ে থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন, কারও অর্থনৈতিক সমস্যা থাকলে তিনি সরকারি হাসপাতালে যেতে পারেন। সেখানে রোগী দেখানোর পাশাপাশি ওষুধও ফ্রি পাওয়া যায়। কিছু পরীক্ষা খুবই স্বল্প মূল্যে করা যায়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //