ধুলোবালিজনিত অ্যালার্জিতে লাখো মানুষ

দেশের লাখো মানুষের কাছে এক অসহনীয় রোগের নাম অ্যালার্জি। এর অন্যতম কারণ ধুলোবালি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া অথবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আত্মঘাতী প্রবণতার কারণে হয়ে থাকে।

রোগটিতে কেউ আক্রান্ত হলে হাঁচি, চুলকানি, শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে অ্যালার্জি খুব কমই সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। কারও কারও খাবার ও ওষুধে ভীষণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে থাকে।

আবার ধুলোবালিতে সর্দি-হাঁচি-কাশি শুরু হয়ে যায়। অনেকের ফুলের গন্ধ নাকে গেলেও হাঁচি চলে আসে। অ্যালার্জি হলে ত্বকের লাল রং হয়, ত্বকে লাল চাকা চাকা হয়ে যায় বা শরীরের কোনো কোনো অঙ্গ ফুলে ওঠে। অ্যালার্জি সংক্রমণ বেশি হলে বমি, ডায়রিয়াও হতে পারে। এমনকি রোগী অচেতনও হয়ে পড়তে পারেন।

ধুলোবালি অন্যতম শত্রু

শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে শহরগুলোতে ধুলোবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। ধুলোবালি অ্যালার্জির অন্যতম শত্রু। বিশেষ করে ঢাকা শহর বিশ্বের অন্যতম ধুলোবালির শহর। ঢাকায় চলতে থাকা সব নির্মাণ কাজ এবং নির্মাণ কাজের জন্য মাটি কাটা, সরানো ও মোটাবালি পরিবহনের সময় রাস্তায় পড়ে যাওয়া এবং সেগুলোর উপর দিয়ে দ্রুতগতিতে যানবাহন চলার ফলে রাস্তার ধুলোবালি বসতবাড়ি পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে।

আবার ঢাকার মধ্যে ও ঢাকার বাইরে রয়েছে অনেক কলকারখানা ও ইটের ভাটা। বিশেষ করে ইটের ভাটা থেকে ধুলোবালি ও ধোঁয়া বাতাসে ভর করে অনেক দূর গিয়ে পড়ে। শহরগুলো, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহর এভাবে ধুলো ও ধোঁয়ায় পরিণত হয়েছে দূষিত নগরীতে। আর ধুলোবালি ও ধোঁয়ার কারণে শহর, বিশেষ করে ঢাকার মানুষ ডাস্ট অ্যালার্জিতে বেশি ভোগেন।  

অ্যালার্জি কেন হয়?

প্রত্যেক মানুষের শরীরে এক একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম থাকে; কোনো কারণে এ ইমিউন সিস্টেমে গোলযোগ দেখা দিলে তখনই তা অ্যালার্জি আকারে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। পরজীবী, ছত্রাক, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার মতো ক্ষতিকর বস্তু আমাদের শরীর সবসময়ই প্রতিরোধ করে থাকে। এ প্রচেষ্টাকে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বলে।

তবে এই ইমিউন সিস্টেমই কখনো কখনো আমাদের শরীরে ক্ষতিকর নয় এমন অনেক ধরনের বস্তুকেও ক্ষতিকর ভেবে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এমন সব উপাদানের প্রতি শরীরের এ অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াকে অ্যালার্জি বলা হয়। 

এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের শিশুদের মধ্যে খাবারের মাধ্যমে অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার হার আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ায় ছয় বছরের এক মেয়ে দুগ্ধজাত খাবারের অ্যালার্জিতে মারা যায়।

এ ছাড়া সম্প্রতি তিল ও চীনাবাদাম খাওয়ার কারণে দুই ব্রিটিশ শিশুর মৃত্যুর খবর বিষয়টিকে নতুন করে সামনে আনে। গত কয়েক দশকে পশ্চিমা দেশগুলোতে এই অ্যালার্জি প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশেও এই অ্যালার্জির হার চোখে পড়ার মতো। একটি জরিপে দেখা গেছে, গ্রামের চেয়ে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি।

অ্যালার্জি কেন বেড়ে গেছে?

কেন কিছু কিছু খাবার খেলে অ্যালার্জি হয় তার কোনো একক ব্যাখ্যা নেই। তবে এ নিয়ে বিজ্ঞানের কিছু তত্ত্ব রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো, বর্তমানের উন্নত স্বাস্থ্যবিধি এবং পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান। অন্যদিকে এখনকার শিশুরা আগের মতো সংক্রমণ রোগের শিকার হয় না বললেই চলে।

কারণ তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে মাটির সংস্পর্শে আসে না। মাটিতে যেমন প্রচুর ক্ষতিকর রোগ-জীবাণু আছে তেমনি উপকারী জীবাণুও রয়েছে। মাটির সংস্পর্শে আসে না বলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। দেখা যায় গ্রামের মানুষ রোগ-জীবাণুর সংস্পর্শে বেশি আসায় তাদের রোগবালাই শহরের মানুষের তুলনায় কম। 

এ ছাড়া অ্যালার্জি থেকে মুক্ত থাকার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, যে বস্তুতে অ্যালার্জি রয়েছে, তা এড়িয়ে চলা। এ ক্ষেত্রে রোগীর যেসব বস্তুতে অ্যালার্জি হয়, সেগুলোর একটি তালিকা করা যায়। স্কিন টেস্ট করে এটা বোঝা যায়। কোনো ওষুধে অ্যালার্জি হলে অবশ্যই তার নাম লিখে রাখতে হবে। প্রসাধন সামগ্রীতে অ্যালার্জি থাকলে রাসায়নিকযুক্ত প্রসাধনী ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে।

অ্যালার্জির লক্ষণ

সিজনাল অ্যালার্জি রাইনাইটিস হলে ঘন ঘন হাঁচি, নাক দিয়ে পানি পড়া, নাসারন্ধ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়ার লক্ষণ থাকে। অ্যালার্জির কারণে হাঁপানি হলে কাশি, ঘন ঘন শ্বাসের সঙ্গে বাঁশির মতো শব্দ হওয়া বা বুকে চাপ চাপ লাগে। শিশুদের ক্ষেত্রে অ্যালার্জির কারণে মাঝেমাঝেই ঠান্ডা লাগে। এছাড়া শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট, দম খাটো অর্থাৎ ফুসফুস ভরে দম নিতে না পারা, ঘন ঘন কাশি হয়ে থাকে। 

প্রতিরোধের উপায় 

আমাদের শরীর ঠিক যে প্রক্রিয়ায় অ্যালার্জির সঙ্গে মোকাবিলা করে ঠিক একইভাবে এটি পরজীবী সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি বাড়ানোর প্রতি নজর দিতে হবে। ভিটামিন ডি আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। যার কারণে শরীরের অ্যালার্জি প্রতিরোধের ক্ষমতা বেড়ে যায়। বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ডি পায় না। এর প্রধান কারণ হলো তারা সূর্যের তাপে কম সময় ব্যয় করে।

অ্যালার্জি দ্রব্যাদি এড়িয়ে চলা ও ওষুধের পাশাপাশি ভ্যাকসিনও অ্যালার্জিজনিত রোগীদের সুস্থ থাকার অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি। এ পদ্ধতি ব্যবহারে কর্টিকোস্টেরয়েডের বহুল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ভ্যাকসিন পদ্ধতির চিকিৎসাকে অ্যালার্জিজনিত রোগের অন্যতম চিকিৎসা বলে অবহিত করেন। 

শিশুদের ক্ষেত্রে

শিশুকে দুধ পান করানোর সময় মা যদি নিজে সব ধরনের খাবার খেয়ে থাকেন তাহলে শিশুর অ্যালার্জি সংক্রমণের হার কমে যায়। এ সময় অন্ত্রের ইমিউন সিস্টেম যে কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া বা নতুন খাবারের নানা অপরিচিত উপাদানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত থাকে। এ ছাড়া শিশুদের একদম অল্প বয়স থেকেই অ্যালার্জি সংবেদনশীল খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করলে তাদের অ্যালার্জিতে ভোগার আশঙ্কা কম থাকে। 

লন্ডন কিংস কলেজের গবেষকরা এ নিয়ে পাঁচ বছরের শিশুদের উপর একটি জরিপ পরিচালানা করেন। সেখানে দেখা গেছে, যারা ছোট থেকেই নিয়মিত চীনাবাদাম খায় তাদের এই বাদামে অ্যালার্জির হার ৮০ শতাংশ কমে যায়। 

খাবার নির্বাচনে সচেতনতা প্রয়োজন

খাদ্য অ্যালার্জির কোনো প্রতিকার নেই। এটি পুরোপুরি নির্ভর করে খাদ্যাভ্যাসের নিয়ন্ত্রণের উপরে। যার অন্যতম শর্ত হলো সংবেদনশীল খাবারগুলো এড়িয়ে যাওয়া। কেউ যদি এরপরও অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হয়েই যান তাহলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা নেওয়াকেও তারা গুরুত্ব দিয়েছেন। কোন ধরনের খাবারে অ্যালার্জি হয় তা বুঝতে পারলে সে খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো।

এ ছাড়া প্রচলিত মেডিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাচাই করা যায় ঠিকই। এতে অনেক সময় ভুল তথ্য পাওয়া যায়। দেখা গেছে যে, পরীক্ষায় একটি খাবারে শিশুর অ্যালার্জি সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে। অথচ ওই শিশুর এমন কোনো সমস্যাই নেই।

অ্যালার্জি সংক্রমণ আছে কিনা তা বুঝতে কিংস কলেজের গবেষকরা রক্ত পরীক্ষার কথা বলেছেন। অ্যালার্জি ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে অ্যালার্জিক পদার্থের সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি হঠাৎ আক্রান্ত হওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ায়।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা

বিছানার চাদর, বালিশের কভার, মশারি ইত্যাদি প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়া ঘরের চারপাশ ভালো করে পানি ও ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। তাছাড়াও প্রতিদিন রোদে লেপ-কম্বল ইত্যাদি ভালোভাবে শুকিয়ে নেওয়া ভালো। কারণ রোদের আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মিতে হাউস ডাস্ট মাইট (এক প্রকার জীবাণু) মরে যায়।

তাছাড়া প্রতি সপ্তাহে ভেজা কাপড় দিয়ে দরজা-জানালা পরিষ্কার করা উচিত। গোসলখানার জানালা খোলা রাখতে হবে যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ঢুকতে পারে। বাসায় পশুপাখি থাকলে সেগুলোকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //