পুষ্টিহীনতায় দুই কোটি ১০ লাখ মানুষ

বাংলাদেশে এখনো দুই কোটি ১০ লাখ (১৩ শতাংশ) মানুষ পুষ্টিকর খাবার খেতে পায় না। এই হিসাবে প্রতি আটজনের একজন পুষ্টির অভাবে ভুগছে। খাবার যে নেই একেবারে তাও বলা যাবে না। মূলত অসচেতনতার কারণে অসংখ্য মানুষ খাবার খেয়েও প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না।

পুষ্টিকর খাবার খেতে না পেয়ে এখনো ৩৩ শতাংশ শিশুর শারীরিক বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে না। ফলে উচ্চতার তুলনায় কম ওজন এবং ওজনের তুলনায় উচ্চতা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বাংলাদেশের শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতির এমন তথ্য বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে। 

সুষম পুষ্টিকর খাবারের তালিকায় রয়েছে ভাত, রুটি, সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও তেলজাতীয় খাবার। একটি পরিবারকে এই খাবার কিনে খেতে গেলে দিনে কমপক্ষে ১৭৪ টাকা খরচ করতে হবে। কিন্তু তাদের দৈনিক আয় এত কম যে, খাবার কেনার পেছনে এই টাকাটা খরচ করার সামর্থ্য নেই। তারা প্রতিদিন খাদ্যশক্তি পায় ভাত, আলু, রুটি ও সবজি থেকে। যার পেছনে দিনে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা ব্যয় করতে পারে। 

১৯৯৭ সালে যেখানে দেশে ৬০ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির ছিল, ২০১৮ সালে তা কমে ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে খর্বাকৃতির শিশুর সংখ্যা এখনো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে অনেক বেশি। একটি দেশের সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার দিক থেকে এই সমস্যা একটি বড় বাধা। অন্যদিকে দেশে নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতি এখনো বেশ উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে। ১০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রতি তিনজনের একজন নারী প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পায় না। দারিদ্র্য ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এমন পরিবারগুলোকে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেয়াও জরুরি।

প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ, পানি ও চর্বি থাকলে তাকে পুষ্টিকর খাবার বোঝায়। কিন্তু বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ অতিরিক্ত পরিমাণে ভাত ও অপর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান সংবলিত খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। পুষ্টিকর খাবার যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধের মতো পুষ্টিকর খাবারের পরিমাণ খাদ্য তালিকায় কম থাকে। এটা হয়, এসব খাবারের উচ্চ মূল্যের কারণে। দিন দিন এসব খাবারের দাম শুধু বেড়েই চলেছে। ফলে কম আয়ের মানুষ এসব খেতে পারে না। 

দারিদ্র্যের পাশাপাশি সঠিক খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে মানুষের সচেতনতার অভাবও এর জন্য দায়ী। গবেষণা বলছে, নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্যতার অভাব এই পুষ্টিহীনতার প্রধান কারণ। মাছ, মাংস, শাকসবজি, ফলমূলের মতো পুষ্টিকর খাবার টাকার অভাবে কিনতে পারছেন না। আবার অনেকের এসব খাবার কেনার ক্ষমতা আছে ঠিকই, কিন্তু তারা জানেন না কোন খাবারগুলো কী পরিমাণে খেতে হবে।

দেখা যাচ্ছে, মানুষ তিন-চার বেলা পেট ভরে খাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু শরীর প্রয়োজনীয় ক্যালরি পাচ্ছে না বলে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। কারণ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে দিনে গড়ে ২১০০ কিলোক্যালোরির প্রয়োজন হয়। 

পুষ্টিবিদরা বলছেন, পেট পুরে শর্করা (যেমন ভাত) খেলেও সেখানে যদি অন্যান্য পুষ্টি উপাদান না থাকে তাহলে সেটাও পুষ্টিহীনতা। এখন তো খাদ্যে ভেজালের আতঙ্কে অনেকে জেনে বুঝেও পুষ্টিকর খাবার এড়িয়ে চলেন। জাতীয় পুষ্টি পরিষদের ডাক্তার নুসরাত জাহান বলেন, বাংলাদেশে যে উপায়ে রান্না করা হয়, সে কারণেও খাবারের পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়ে যায়। কারণ রান্না ও সবজি কাটার ভুলে পুষ্টিমান কমে যায়। সবজি অথবা অন্যান্য কিছু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রান্না করতে হয়। এর বেশি হলে সবজি অথবা আমিষের পুষ্টিমান কমে যায়। শাক-সবজি উত্তমরূপে ধুয়ে পরিষ্কার করে কাটতে হবে। কাটার পর আর এগুলো ধোয়া যাবে না। তাহলে পুষ্টিমান পানিতে ধুয়ে চলে যাবে।

ডা. নুসরাত জাহান বলেন, মানুষের জন্য ভিটামিন ‘ডি’ খুবই প্রয়োজন। কিন্তু ভিটামিন পাওয়ার ব্যাপারে মানুষের রয়েছে ভুল ধারণা। অনেকেই মনে করেন সূর্যের আলোতে ভিটামিন পাওয়া যায়। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়, ভিটামিন ‘ডি’ সূর্যের আলোতে থাকে না। বরং মানুষের ত্বকের নিচে রয়েছে ভিটামিন ‘ডি’র একটি স্তর। সূর্যের আলো ত্বকে লাগলে ভিটামিন ‘ডি’র স্তর অ্যাক্টিভ হয়। আমাদের অধিকাংশ সময় ঘরে থাকার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। সূর্যের আলোতে থাকার অভ্যাস গড়তে হবে। ভিটামিন ‘ডি’র অভাবে হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে। 

সরকারি হিসেবে বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে যে ১১.৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠী রয়েছে তারাই মূলত পুষ্টিহীনতায় ভোগেন বেশি। তবে ক্রয়ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সচেতনতার অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন একটি বড় জনগোষ্ঠী। পুষ্টিবিদদের মতে, একেক বয়সে পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজনীয়তা একেক রকম থাকে।

বয়ঃসন্ধিকালে এবং গর্ভধারণের সময় নারীদের পুষ্টির চাহিদা তুলনামূলক বেশি থাকে। প্রচারের কারণে মা ও শিশুর পুষ্টির দিকটি যেভাবে নজরে রাখা হয়, বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলে-মেয়ের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব পায় না। এছাড়া প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টির দিকটিও বাংলাদেশে অবহেলিত। 

নিউট্রিশন অ্যান্ড অটিজম রিসার্চ সেন্টারের (নার্ক) নির্বাহী পরিচালক পুষ্টিবিদ তনিমা শারমিন বলছেন, দেশের ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ (১৩ শতাংশ) অপুষ্টির শিকার, এই সংখ্যাটি খুব বেশি উদ্বেগের নয়। তার মতে, উদ্বেগের বিষয় হলো অবশিষ্ট যে ৮৭ শতাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রয়েছে, তাদেরও একটি বড় অংশ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। সেটা হচ্ছে শুধু সচেতনতা ও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্যতার অভাবে।

পুষ্টিবিদ তামান্না শারমিন বলছেন, খাদ্যরীতি, খাদ্যের পরিবেশ এবং পুষ্টিকর খাদ্য কিনতে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বিষয়ে নতুন কিছু দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। পুষ্টিহীনতা দূর করতে গবেষকরা তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে বলেছেন। প্রথমত নানাবিধ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পাওয়ার সুযোগ বাড়ানো। আমিষের ঘাটতি পূরণে বড় মাছের উৎপাদন বাড়ানো হলেও এর চেয়ে বেশি পুষ্টিকর ছোট মাছের উৎপাদন বাড়ানো হয়নি। এ ধরনের সহজলভ্য পুষ্টিকর খাবার সব শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা প্রয়োজন।

সমাজের সকল স্তরে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গঠনের জন্য এমনভাবে প্রচারণা চালানো দরকার যেন বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়। এ জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে অভ্যাস পরিবর্তনের পাশাপাশি সামাজিকভাবে মানসিকতা পরিবর্তন দরকার।

তামান্না শারমিন বলেন, পুষ্টিহীনতা দূর করতে এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত সমন্বিত উপায়ে কাজ করা। বাংলাদেশের খাদ্যনীতি, কৃষিনীতিতে খাদ্য উৎপাদনে যত জোর দেওয়া হয়েছে, সে তুলনায় খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে গেছে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যক্তিপর্যায়ে অভ্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তনও দরকার আছে।

বাংলাদেশ পুষ্টি সমিতির সভাপতি ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. এস কে রায়ের মতে, বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ অর্থনৈতিক নয়। পুষ্টি ও খাদ্য নিয়ে জ্ঞানের অভাবের কারণেও অপুষ্টিকর খাবার খাচ্ছে মানুষ। একই কারণে মানুষ বেশি দাম দিয়ে কম পুষ্টিকর খাবার কিনছে। পুষ্টিকর খাবার সম্পর্কে মানুষের ধারণা বাড়ানোর জন্য সরকারের আরও উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //