রোগী নিরাপত্তা দিবস

রোগীর সুরক্ষায় সকলের সম্মিলিত সহযোগিতা প্রয়োজন

প্রায়ই গণমাধ্যমের পাতায় খবর আসে, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু। দেশের সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল উভয় স্থান থেকেই রোগীর স্বজনদের পক্ষে এই অভিযোগ করা হয়। তবে, এই সমস্যা যে শুধু বাংলাদেশের তা নয়, বরং এটা বিশ্বব্যাপী।

এই সমস্যাকে চিহ্নিত করে এর সমাধানে কাজ করতে প্রতিবছর পেশেন্ট সেফটি ডে বা রোগী নিরাপত্তা দিবস পালন করে আসছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১৭ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালিত হচ্ছে। রোগীর সুরক্ষা এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে রোগী, পরিবারের সদস্য, সমাজ, স্বাস্থ্যকর্মী, স্বাস্থ্যনেতৃবৃন্দ, নীতিনির্ধারকমহল সকলে মিলেই রোগীর সুরক্ষায় কাজ করে।

হু’র তথ্য মতে, শুধু রোগীর চিকিৎসা ক্ষতি কমাতে পারলে একবছরে দশমিক সাত শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষতি কমানো সম্ভব। যা প্রতিবছর ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার খরচ বাঁচাবে। যদি রোগীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে, সেবা দিয়ে চিকিৎসা সম্ভব হয় তাহলে তা চিকিৎসা ব্যয় কমাবে ১৫ শতাংশ। 

সংস্থাটি এ লক্ষ্যে প্যাসেন্টস ফর প্যাসেন্ট সেফটি (পিএফপিএস) প্রোগ্রাম চালু করেছে। ২০২১ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ২০৩০ সাল পর্যন্ত চলবে। এতে রোগী, তার পরিবারের সদস্য, সমাজ, চিকিৎসক, নার্স সকলে মিলে রোগীর সুরক্ষায় কাজ করার কথা বলা হয়েছে।

হু’র তথ্যানুযায়ী, প্রতি দশ জন রোগীর মধ্যে একজন চিকিৎসা নিতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রতিবছর ৩০ লাখ মানুষ অযত্নে মৃত্যুবরণ করে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে প্রতি ১০০ জনে চারজন অযত্নে মৃত্যুবরণ করে। এইসব রোগীদের প্রতি ২০ জন রোগীর একজনের ক্ষতি প্রতিরোধযোগ্য। এরমধ্যে অর্ধেকের ক্ষতি শুধুই মেডিটেশন করার মাধ্যমে কাটিয়ে নেওয়া সম্ভব।

প্রতি ১০ জনের একজন রোগীর ক্ষতিটা প্রাথমিক পর্যায়ের। এরমধ্যে ৮০ শতাংশ ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। অস্বাস্থ্যকর অপারেশন, স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে ছড়ানো ইনফেকশন, পরীক্ষার ভুল রিপোর্ট, রোগীর পড়ে যাওয়া, প্রেসার কমে যাওয়া, সঠিক রোগ শনাক্ত না হওয়া, অনিরাপদ রক্তদান রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।

তবে, বাংলাদেশে রোগীর সেবায় পরিবার, সমাজ পাশে থাকলেও চিকিৎসাখাতের অপ্রতুলতা বিপদ বাড়ায় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোগী সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন এবং হাসপাতালগুলোয় সঠিক তদারকির প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ড. রশীদ-ই-মাহবুব।

তিনি বলেন, রোগীর চিকিৎসা হতে হবে মানসম্পন্ন। এটাই রোগীর সুরক্ষা। এর মধ্যে কয়েকটি উপাদান থাকবে, পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টর। রোগীর চিকিৎসার জন্য উপাদানগুলো কী? জনশক্তি, অর্থ, লজিস্টিক সাপোর্ট। চিকিৎসা একটা উপাদান, যেখানে অন্যান্য আরো উপাদান আছে। নার্সসহ অন্যান্য স্টাফ কাজ না করলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে পারে। বিছানা, আনুসঙ্গিক বিষয় সরকার দেয়, আনুসঙ্গিক খাবারও দেয়। এটার সাধারণ ব্যবস্থাপনা হাসপাতালের করার কথা। পাবলিক সেক্টরে লজিস্টিক রয়েছে। কিন্তু রোগীর পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে থাকলেও রোগীর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা সেখানে হয় না। যারা বাড়তি সুযোগ নিতে চায় তারা মেশিনগুলো নষ্ট করে রাখে। ফলে হাসপাতালের পরিবেশ রোগীকে সেভাবে সুরক্ষা দেয় না।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেখার কথা, কিন্তু জনবল ও আর্থিক সমস্যার জন্য এই সেবাটা হাসপাতাল দেয় না। হাসপাতালের ঔষধপত্রও অপ্রতুল। সরবরাহ নেই। জীবনরক্ষাকারী ঔষধ পাওয়া যায় না। ফলে এসবের জন্য রোগীকে অতিরিক্ত খরচ করতে হয়। সুতরাং পাবলিক সেক্টরে রোগী চিকিৎসা নিতে গেলে ভর্তির কাগজ এবং হাসপাতালে হয়ত জায়গা পায়। কিন্তু আনুসঙ্গিক সুরক্ষা পাওয়া দুর্লভ। এখানে ক্ষমতাবানরা হয়ত সুবিধা নিতে পারে, যেটা সাধারণ মানুষ পারেনা। সুতরাং পাবলিক সেক্টরের সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং সরকারের।

তিনি বলেন, এবার প্রাইভেট সেক্টর সম্পর্কে বলি। এটা মূলত ব্যবসায়িক কেন্দ্র। যদিও সরকারের বিভিন্ন বিধি ও শর্ত সেখানে আছে, কিন্তু এর তদারকি খুবই দুর্বল। ফলে এখানে অর্থের প্রচুর অপব্যবহার এবং খরচ হয়। নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা এখানে খুবই দুর্বল। সেখানে ডাক্তার চিকিৎসাখাতের শ্রমিক অন্যদিকে মালিক থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও লাভটা মালিকের ঘরেই যায়। এরমধ্যে আরো দুর্বলতা আছে আমাদের। যে চিকিৎসকরা সরকারি চাকরি করে, মনে হয় তারা যেন সেখানে পার্টটাইম কাজ করেন। সুতরাং এখানে তদারকিটা সম্পূর্ণভাবে দুর্বল। রোগী সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমরা দেখি, সরকারি হাসপাতালে রোগী যেমন অবহেলার শিকার হন, অন্যদিকে প্রাইভেট সেক্টরে তাদের আর্থিক হয়রানি করা হয়। রোগীর সুরক্ষা কোথাও হয়না। এই অবস্থার পরিবর্তনে প্রথমত, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। রোগীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই চিকিৎসাখাতে আইন-কানুন তৈরি এবং তদারকিটা বিশেষভাবে প্রয়োজন। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //