ভেরিকোস ভেইনে পায়ে পচন

ত্বকের নিচের শিরাগুলো যখন মোটা হয়ে ফুলে ওঠে এঁকেবেঁকে সর্পিলভাবে অগ্রসর হয়, তখন তাকে ভেরিকোস ভেইন বলা হয়। এটি সাধারণত পায়ে হলেও শরীরের অন্য স্থানেও হতে পারে। ভেরিকোস ভেইন সমস্যায় শেষ পর্যন্ত পায়ে পচন ধরতে পারে। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে রোগটি থেকে মুক্তি মেলে। 

ভেরিকোস ভেইন আঁকাবাঁকা শিরার রোগ নামেও পরিচিত। এটাকে রক্তনালির রোগও বলা হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্কদের ৩০ শতাংশ এই রোগে ভোগেন। বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ শিরার বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছেন। এদের মধ্যে এক শতাংশ বা ৩ লাখ মানুুষ ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সি বা সিভিআইতে ভুগছে। 

প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অনেক মানুষ এই রোগে ভুগলেও দেশে এই রোগের চিকিৎসা খুবই অপ্রতুল। দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চারটি হাসপাতালে ১৩৮টি শয্যা রয়েছে এবং রোগটির চিকিৎসায় মাত্র ৫০ জনের কিছু বেশি চিকিৎসক আছেন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে একজন এবং বেসরকারি হাসপাতালে তিনজন পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক রোগটির চিকিৎসা করে থাকেন। যারা এর চিকিৎসা করেন তারা ভাস্কোলার সার্জন হিসেবে পরিচিত। ভাস্কোলার সার্জনদের সংখ্যা কম বলে ঢাকার বাইরে এই রোগটির চিকিৎসা হয় না বললেই চলে। 

ভেরিকোস ভেইন কী
মানবদেহের পায়ের শিরাগুলো দুটি সারিতে বিভক্ত থাকে। এই দুটি সারির সংযোগকারী অংশে থাকে আন্তঃশিরা। এই শিরার মধ্যে কিছু একমুখী ভাল্ব (কপাটিকা) থাকে। এই ভাল্বের কারণেই শিরার মধ্য দিয়ে রক্ত একদিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে। রক্তপ্রবাহের সময় কোনো কারণে যদি ভাল্ব ঠিকমতো কাজ না করে অথবা দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন রক্ত বিপরীত দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে এবং একই সঙ্গে শিরার ধীরে ধীরে প্রসারণ ঘটে। ফলে রক্তনালি ফুলে ত্বকের ওপরের দিকে ঠেলে যেন বেরিয়ে যেতে থাকে। এতে পায়ে ব্যথা অনুভূত হয়ে থাকে। এমন অবস্থাকে ভেরিকোস ভেইন হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। 

প্রতিদিন যাদের পায়ে অত্যন্ত চাপ পড়ে, তাদের পায়ের শিরায় এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে পায়ের শিরা ফুলে গাঢ় নীলচে রঙের রেখা ত্বকের ওপর ফুটে ওঠে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ভেরিকোস ভেইন হলে পায়ে রক্ত চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। এর ফলে হাঁটতে কষ্ট হয় এবং রোগী পায়ে ব্যথা অনুভব করেন। ভাস্কোলার সার্জন কম হলেও দেশে এখন ভেরিকোস ভেইনের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হচ্ছে। এখন পা না কেটে লেজার, আরএফএ’র মাধ্যমে আঁকাবাঁকা শিরা ঠিক করে দেওয়া হয়। আগে ওপেন সার্জারি করে আঁকাবাঁকা শিরা ঠিক করা হতো। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে রাজধানীর কল্যাণপুরের ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগটির চিকিৎসা হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি), জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেও (এনআইসিভিডি) এর চিকিৎসা হয়।

চিকিৎসা এবং খরচ
লাইট এমপ্লিফিকেনবাই স্টিমুলেটেড এমিশান অব রেডিওয়েশন বা লেজার এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন বা আরএফএ পদ্ধতিতে ভেরিকোস ভেইনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। ভাস্কোলার সার্জন জিয়াউর রহমান বলেন, এই দুই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হলে ব্যথা কম হয়, এতে পায়ে কোনো দাগ থাকে না, দ্রুত কাজ-কর্মে ফিরে যাওয়া যায় এবং একসঙ্গে দুই পায়ের আঁকাবাঁকা শিরার চিকিৎসা করা যায়। এছাড়া ভেনাসিল বা সুপার গ্লু এডহেসিভ ক্লোজার পদ্ধতিতেও চিকিৎসা হচ্ছে। উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসা করতে হবে। এক সময়ে সার্জারি ও থার্মো অ্যাবলেশন পদ্ধতিতে ভেরিকোজ ভেইনের চিকিৎসা করা হতো। এই দুই চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু এসব পদ্ধতিতে চিকিৎসার পর অনেক সময় রোগী আবার একই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে রোগটি আবার ফিরে আসে। অনেক খরচ করার পরও আবার একই চিকিৎসা নিতে হতো। ভাস্কোলার সার্জনরা বলছেন, বাংলাদেশে ৭৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় এই চিকিৎসাটি করা যায়। ভারতে এর তিনগুণ অর্থ খরচ হয়। 

ভাস্কোলার সার্জনরা রোগীর ভেরিকোস ভেইনের অবস্থা পর্যালোচনা করে এক ধরনের বিশেষ আঠা (গ্লু) আক্রান্ত শিরাগুলোর মধ্যে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। কিছুদিনের মধ্যেই ত্বকের ওপর সেই শিরাগুলোতে গাঢ় চিহ্ন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ভাস্কোলার সার্জন জিয়া উদ্দিন জানান, অল্প সময়েই এই অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিটি জনপ্রিয় হয়েছে, এই পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ যন্ত্রণাহীন এবং রোগটির আবার ফিরে আসার আশঙ্কা কম। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসায় কোনো জটিলতা নেই, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হয় না। 

ভাস্কোলার সার্জন অধ্যাপক ডা. জি এম মকবুল হোসেন বলেন, তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালেই বরং অনেক জটিলতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন রোগীরা। ফলে আক্রান্ত স্থানে আলসার (ঘা) হতে পারে, গ্যাংগ্রিন বা পায়ে পচন ধরতে পারে, পায়ের ত্বক শক্ত হয়ে যেতে পারে, হঠাৎ করে আক্রান্ত স্থান থেকে রক্তপাত হতে পারে অথবা রক্তনালি বন্ধ হওয়ার সমস্যা বা থ্রম্বোসিস হতে পারে। 

যারা রোগটিতে ঝুঁকিপূর্ণ
৪০ বছরের বেশি বয়সীদের যারা ধূমপান করেন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, রক্তে উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল ও অতিরিক্ত হোমোসিস্টাইন আছে, স্থূলতা, দীর্ঘদিন প্রদাহ নিয়ে বেঁচে থাকা রোগী, যারা খুব বেশি শারীরিক পরিশ্রম করেন এবং যাদের জন্মগত সি রি-অ্যাক্টিভ এবং ফাইব্রিনোজেন সাইটোকাইনেস রয়েছে তাদের হতে পারে এই রোগটি। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, ভ্যারিকোস ভেইন থেকে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা অপেক্ষাকৃত কম। ক্ষেত্রবিশেষে আক্রান্ত শিরাগুলো থেকে বারবার রক্তক্ষরণ হতে পারে। 

ভ্যারিকোস ভেইন থেকে সৃষ্ট চুলকানি ও ত্বকের নিচে জমা হতে থাকা রক্তের লৌহজাত উপাদান থেকে ত্বকের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। আক্রান্ত শিরাগুলোর ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে কখনো কখনো হঠাৎ তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। শিরার ভেতরে জমাট বাঁধা এ রক্ত ছুটে গিয়ে ফুসফুসে আটকাতে পারে, ফলে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। যদিও এ আশঙ্কা খুব কম। ভ্যারিকোস ভেইন থেকে সৃষ্ট ঘা ক্ষেত্রবিশেষে ক্যানসারেও রূপ নিতে পারে।

ভেরিকোস ভেইনের লক্ষণ
যারা বেশি স্থূল তাদের এ রোগের ঝুঁকি বেশি। স্থূলকায়দের একনাগাড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে নিষেধ করেছেন চিকিৎসকরা। আবার অনেকক্ষণ বসে থাকাও যাবে না। এই রোগের বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ রয়েছে- পা ফুলে যাওয়া, পায়ে ব্যথা, ক্রমাগত অস্বস্তি, পা ভারী হয়ে যাওয়া, গোড়ালি ফুলে যাওয়া, ত্বকে বাদামি দাগ হওয়া ইত্যাদি। পরবর্তীকালে পায়ের মাংসপেশিতে টান অনুভব হতে থাকে। এমনকি পায়ের পাতায় শক্ত পিণ্ড ও ইনফেকশন দেখা দেয়। স্বল্প সময় হাঁটা-চলাতেও সমস্যা হয়। এই লক্ষণগুলোর কোনো একটি দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। 

প্রাথমিকভাবে করণীয়
রোগটি দেখা দিলে প্রাথমিক পর্যায়ে অপারেশন ছাড়াই ভ্যারিকোস ভেইনের চিকিৎসা বা কমপক্ষে এর লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। চিকিৎসকরা বলেন, লক্ষণ দেখা দিলে সময় পেলেই পা উঁচুতে রাখা, একটানা দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে বা বসে না থাকা, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিশেষ ধরনের মোজা পরে থাকা ও বিশেষ কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হলে রোগটিকে কিছুদিন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //