দেশে ডায়াবেটিসজনিত অন্ধত্বের ঝুঁকি বাড়ছে

বর্তমানে অনেকেরই ডায়াবেটিসজনিত অন্ধত্ব দেখা দিচ্ছে। চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের রেটিনা ডিপার্টমেন্টে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা ৫০% রোগী ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথিতে ভুগছেন। এটি চোখের এমন একটি রোগ যার ফলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায় এমনকি অন্ধত্বও হতে পারে।

চিকিৎসকদের মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১.৩ কোটিরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্তদের অন্ধত্বের প্রধান কারণ হলো ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি।

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি চোখের পেছনে অবস্থিত আলো-সংবেদনশীল টিস্যু রেটিনার রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ রোগে সাধারণত দুই চোখই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং সঠিক চিকিৎসা না করা হলে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে পারে। রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির ঝুঁকি বাড়ে।

বিশ্বব্যাপী মানুষের দৃষ্টিশক্তি নিয়ে কাজ করা সংস্থা অরবিজের মতে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশ লোককে প্রভাবিত করে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। ৩৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্ধত্ব এবং দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের প্রধান কারণ এটি।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর দ্য প্রিভেনশন অফ ব্লাইন্ডনেস এর পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রায় ১.৮৫ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত।

অন্ধত্বের ঝুঁকি কমাতে ডাক্তাররা ডায়াবেটিস রোগীদেরকে বার্ষিক রেটিনাল পরীক্ষার পরামর্শ দেন।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের দীর্ঘমেয়াদী ফেলো ডা. আতিকুল হক জানান,  সাধারণত ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়ার দশ বছর পর ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি হওয়ার ঝুঁকি শুরু হয়। আর্লি স্টেজে রোগটি শনাক্ত হলে ঝুঁকি কমে।

তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালে লেজার নিতে যে রোগীরা আসে তারা সবাই অ্যাডভান্স স্টেজের রোগী। লেজার দিলেই তারা দেখতে পারবে- বিষয়টা তা নয় হবে অন্ধ হওয়ার ঝুঁকি এতে কমে। এক বছরের মধ্যে যিনি অন্ধ হয়ে যেতেন, এখন তিনি হয়তো দশ বছর মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারবেন।

আতিকুল হক বলেন, ডায়বেটিস রেটিনোপ্যাথি প্রতিরোধে ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়ার পর রোগীদের প্রতি বছর একবার করে চোখের রেটিনা পরীক্ষা করতে হবে। ডায়াবেটিস, প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখলে এর ঝুঁকি কমবে," বলেন তিনি।

দেশে ডায়বেটিস রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত রোগী কত তার নির্দিষ্ট কোন তথ্য না থাকলেও রোগের পরিসর যে বাড়ছে তা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

২০২৩ এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাদুর্ভাব ছিল ১৮.৮%। বাংলাদেশের ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বিআইএইচএস জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগের ৪৮৯ জন রোগীর ওপর এ গবেষণা চালানো হয়। এদের সবার টাইপ-২ ডায়াবেটিস ছিল।

২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, তিনটি হাসপাতালেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি প্রাদুর্ভাবের হার ছিল ৩৩%। আরও দেখা যায়, নারীদের তুলনায় পুরুষরা এর ঝুঁকিতে থাকে বেশি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চক্ষুবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (ভিট্রিও-রেটিনা) ড. মোহাম্মদ আফজাল মাহফুজুল্লাহ জানান, পৃথিবীতে যেসব কারণে অন্ধত্ব হয়, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি তার অন্যতম কারণ। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ধরা পড়লে তা একদম সারানো যায় না। তবে নিয়মিত চিকিৎসা, থেরাপি ও পরীক্ষার মাধ্যমে চোখের ক্ষতি এড়ানো যায়।

অন্ধত্ব প্রতিরোধে উপায় কী

রেটিনোপ্যাথির জন্য কিছু রিস্ক ফ্যাক্টরকে দায়ী করা হয়। এগুলো হচ্ছে দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপার লিপিডেমিয়া বা উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল। কিছু বিষয় আছে, যেগুলোর প্রতি যত্নবান হলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি অনেকাংশ ক্ষেত্রেই পরিহার করা সম্ভব।

১. খাদ্যাভ্যাসে চিনি, লবণ ও তৈলাক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ করা। সাদা ময়দা ও সাদা চাল ক্ষতিকর। আঁশসমৃদ্ধ খাবার, যেমন ফলমূল, শাকসবজি দেহের ওজন কমাতে ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আঁশযুক্ত খাবার ৫০-৭৫ শতাংশ কোলেস্টেরল মলের সঙ্গে বের করে রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সরাসরি ভূমিকা রাখে। কম আঁশযুক্ত বা আঁশহীন খাবার দ্রুত রক্তে সুগারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং এসব খাবার, যেমন চিনি, মিষ্টি, পেস্ট্রি, পেস্তা, ময়দার রুটি, ফলের রস, বেকারি ফুড ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উত্তম। আস্ত ফলে সুগার কিছুটা থাকলেও সঙ্গে যথেষ্ট আঁশ থাকে। ফলের রসের চেয়ে আস্ত ফল খাওয়া স্বাস্থ্যকর।

২. খাদ্যতালিকায় চর্বিজাতীয় খাবার থাকতে হবে মোট ক্যালরির এক-তৃতীয়াংশ। প্রায় ৬০ গ্রাম চর্বি প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অবশ্যই থাকতে হবে। আনস্যাচুরেটেড চর্বির মধ্যে ভালো হচ্ছে বাদাম, মাছের চর্বি, অলিভ অয়েল ইত্যাদি। স্যাচুরেটেড চর্বি বা খারাপ চর্বি যেমন মাংস, দুগ্ধজাত খাবার কম খাওয়া উচিত। খাবারে অর্ধেক ফলমূল ও শাকসবজি, এক-চতুর্থাংশ হলো গ্রেইন (কর্ন, ভাত, ওট, বার্লি ইত্যাদি) এবং এক-চতুর্থাংশ আমিষ জাতীয়, যেমন লেগুম (শিমের বিচি, ডাল, পেঁয়াজ, বাদাম), মাছ বা সাদা মাংস (মুরগির মাংস) খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। 

৩. দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যায়াম খুবই প্রয়োজন। মধ্যম মানের ব্যায়াম, যেমন হাঁটাহাঁটি বা সাইকেল চালানো সপ্তাহে ১৫০ মিনিট। উত্তম মানের ব্যায়াম হলো প্রতিদিন ৩০ মিনিট মডারেট এক্সারসাইজ (দ্রুত হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং বা সাঁতারকাটা ইত্যাদি)। রেজিস্ট্যান্স এক্সারসাইজ সপ্তাহে ২-৩ বার, যেমন ভারোত্তলন বা ইয়োগা কর্মক্ষম থাকতে সাহায্য করে।

৪. চাপ কমাতে হবে। চাপ কমানোর উপায় হলো নিয়মিত ব্যায়াম, ভালো ঘুম আর দিনের কাজ গুছিয়ে করা।

৫. নিয়মিত ওষুধ সেবন ও ফলোআপ জরুরি। বছরে অন্তত একবার এবং সমস্যা থাকলে আরও ঘন ঘন ফলোআপে থাকতে হবে।

৬. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি চোখে কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //