হার্টে ব্লক: অ্যাসপিরিন কতদিন খাবেন?

হাসপাতাল থেকে কর্মক্লান্ত হয়ে কেবল বাসায় পা রেখেছি। রাত ১১ টা বাজে। শরীর মন চাইছে একটা নিরুপদ্রব দীর্ঘ ঘুম। এমন সময় একটা ফোন কল বেজে উঠল। অনুজপ্রতিম প্রফেসর এম জি আজম দেশের সনামধন্য একজন কার্ডিওলজিস্ট। তিনি বললেন বারডেম হাসপাতালে কর্মরত একজন চিকিৎসকের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, আমি যেন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। সঙ্গে সঙ্গে ইসিজিও পাঠিয়ে দিলেন। ইসিজি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ম্যাসিভ অ্যাটাক! সবচেয়ে বড় অ্যাটাক।

শরীর ও মনের দাবী উপেক্ষা করে পেশাগত দায়িত্বকে কর্তব্য বলে মেনে নিলাম। আমার কর্মরত কনসালটেন্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. মহসিনকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলে আমি বেরিয়ে পড়লাম।

হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানান ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকে অ্যাটাককে স্ট্রোক বলে থাকেন। আসলে স্ট্রোক হলো মস্তিষ্ক বা ব্রেন এর রোগ। যার জন্য প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগের প্রকাশ ঘটে থাকে।

মোদ্দা কথা হার্ট অ্যাটাক মানে হলো হার্টের কোনো না কোনো রক্তনালী হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া। ফলে হার্টের মাংসপেশির যে অংশ ওই রক্তনালীর মাধ্যমে অক্সিজেন পেত তা দ্রুত ধ্বংস হতে শুরু করে। রক্তনালীর ব্লকটি অপসারণ করতে না পারলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হার্টের ঐ অংশটির মৃত্যু ঘটে। এতে দুটো ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে।

এক. রোগীর আশু মৃত্যু ঘটতে পারে, ফুসফুসে পানি জমে তীব্র শ্বাসকষ্ট বা প্রকট হার্ট ফেইল্যুর হতে পারে।

দুই. হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা ক্রমাণ্বয়ে হ্রাস পেয়ে দীর্ঘমেয়াদী বা ক্রনিক হার্ট ফেইল্যুর এর জন্ম দিতে পারে। বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যাবে, আর যতদিন রোগী বেঁচে থাকবেন ততদিন এক যন্ত্রণাকাতর জীবনযাপন করতে হবে।

যাই হোক বাসা কাছে থাকায় সাত মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। ইতিমধ্যে রোগীকে জরুরি বিভাগ থেকে সরাসরি এনজিওগ্রাম করবার জন্য ওটি বা ক্যাথল্যাবে নিয়ে আসা হয়েছে। আমাদের প্রাইমারী এনজিওপ্লাস্টি বা জরুরি রিং পরাবার টিম পুরোপুরি প্রস্তুত (যা কিনা একটি আধুনিক কার্ডিয়াক হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত থাকা বাধ্যতামূলক)।

রোগী ওটিতে ঢুকবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে কোনরকম কাটাছেঁড়া বা বুক না কেটে হাতের রক্তনালীর (রেডিয়াল আর্টারি) ক্যানুলার মাধ্যমে এনজিওগ্রাম সম্পন্ন হলো। রোগীর হার্টের সবচেয়ে বড় রক্তনালী (LAD) ১০০% বন্ধ! রক্তের দলা (clots) দিয়ে পুরোপুরি বন্ধ। আমরা আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে রক্তের দলা অপসারণ করে একটি রিং (Stent) পরিয়ে দিলাম। মুহূর্তে বন্ধ রক্তনালী খুলে গিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে গেল। রোগীর বুকের ব্যথা চলে গেল। প্রেসার স্বাভাবিক হলো। আমরা রোগীকে ৪৮ ঘণ্টা নিবিড় পর্যবেক্ষণ করবার জন্য করোনারী কেয়ার ইউনিটে (CCU) পাঠিয়ে দিলাম।

একটু পরে ইতিহাস নিয়ে জানতে পারলাম যে, রোগীর ২০১৩ সালে আরো একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল এবং তখন অন্য একটি হাসপাতালে রিং পরানো হয়েছিল। আরো জানতে পারলাম যে, তিনি দীর্ঘকাল ধরে অ্যাসপিরিনসহ হার্টের কোন ওষুধ খেতেন না। উপরন্তু ধূমপান করতেন!

এটা জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ একজন চিকিৎসক হয়ে যদি এই দায়িত্বহীন জীবনযাপন করেন তাহলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কীইবা আশা করা যায়। মানুষকে সচেতন করবার আগে চিকিৎসককে সচেতন হতে হবে। কারণ সাধারণ মানুষ একজন চিকিৎসকের জীবনযাপন বা লাইফস্টাইল পর্যবেক্ষণ এবং অনুসরণ করেন।

এবারে আসি হার্টের কী কী ওষুধ অবিরামভাবে খেয়ে যেতে হবে এবং কেন খেতে হবে সে সম্পর্কে কিছু বলি। হার্টের রক্তনালীর দেয়ালে বিভিন্ন কারণে চর্বি জমে নালী সরু হতে থাকে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ধূমপান সহ তামাকজাত দ্রব্য , নিয়মিত ব্যায়াম না করা, অতিরিক্ত ওজন, চর্বিযুক্ত প্রাণিজ মাংস ভক্ষণ, রাত জাগা, অতিরিক্ত টেনশন করা ইত্যাদি কারণে রক্তনালীর চর্বি ফেটে যেতে পারে। চর্বির দলা ফেটে গেলে সেখানে রক্তের অনুচক্রিকা (Platelets) এসে রক্ত জমাট বাঁধতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে চর্বির দলা একটি রক্তের দলায় পরিণত হয়ে পুরো রক্তনালী বন্ধ করে দেয়। তখনই রোগী বুকে চাপ, ব্যথা, শ্বাসকষ্ট , ঘাম, আতঙ্ক ইত্যাদি উপসর্গে আক্রান্ত হয়।

প্রতিরোধের উপায়
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে হলে উপরে বর্ণিত রোগ এবং ঝুঁকির প্রবণতাগুলো দূর করতে হবে। আর যদি ওষুধ এর প্রশ্ন আসে তাহলে হার্ট অ্যাটাক, রিং লাগানো বা বাইপাস সার্জারির পর দুটো ওষুধ অবিরামভাবে, প্রয়োজনে সারাজীবন খেয়ে যেতে হবে । একটি হল চর্বির  দলা প্রতিরোধ, আরেকটি হলো অনুচক্রিকা প্রতিরোধ,  যাতে রক্তকে জমাট করতে না পারে। চর্বির দলা প্রতিরোধে স্ট্যাটিন জাতীয়  ওষুধ (যেমন Atorvastatin, Rosuvastatin ইত্যাদি ) এবং রক্তজমাট প্রতিরোধে রক্ত পাতলা করার ওষুধ  যেমন Aspirin, Clopidogrel, Ticagrelor ইত্যাদি ডাক্তারের পরামর্শ মত অবিরামভাবে খেয়ে যেতে হবে।

লেখক: ডা. মাহবুবর রহমান

সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট এবং সিসিইউ ইনচার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //