নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বাজারে ছেড়েছে ফার্মা সল্যুশনস

বিদেশ থেকে অনুমোদন ছাড়া ডায়াবেটিস স্ট্রিপ দেশে এনে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির মোড়কে (নকল) বাজারে ছাড়ছে ফার্মা সল্যুশনস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা এমন কাজ করছে কি না, তার অনুসন্ধান চলছে। কোনো প্রতিষ্ঠান দেশের মধ্যে অনুমোদন ছাড়া প্রাণ রক্ষাকারী এমন পণ্য উৎপাদন করছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মতবিনিময় সভায় বলেন বক্তারা।

রবিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বিক্রয় প্রতিরোধে এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

উল্লেখ্য, অ্যাকু-চেক ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বাংলাদেশে বাজারজাত করে শুধু রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস। সুইজারল্যান্ডের গবেষণা ভিত্তিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এফ. হফম্যান-লা রোশ এর তৈরি অ্যাকু-চেক ডায়াবেটিস স্ট্রিপ এবং গ্লুকো মিটারসহ সকল ওষুধ বাংলাদেশে অনুমোদিত একমাত্র বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লি.।

বক্তারা অ্যাকু-চেক ডায়াবেটিস স্ট্রিপ এবং গ্লুকো মিটার বাংলাদেশে অনুমোদিত একমাত্র বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লি. কিনা তা দেখে কেনার আহ্বান জানান। একই সাথে কোন ধরনের সন্দেহ হলে ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ করার অনুরোধ জানান।

মতবিনিময় সভায় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘রাজধানীর নয়াপল্টনে বহুজাতিক এক প্রতিষ্ঠানের ডায়াবেটিস স্ট্রিপের মোড়ক ছাপা হয়। এটি আমাদের উদ্ভাবনী শক্তির বড় বহিঃপ্রকাশ, অবিশ্বাস্য, লজ্জারও বিষয়। লাজ ফার্মার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আমরা ফার্মা সল্যুশনস নামে একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে অননুমোদিত ডায়াবেটিস স্ট্রিপ সরবরাহের অভিযোগ পাই। তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও বিষয়টি তারা অস্বীকার করে। এমনকি আমাদের অফিসে এসে উদ্ধত আচরণ করে। ফার্মা সল্যুশনস অস্বীকার করলেও আমরা তাদের সার্ভারে প্রবেশ করে দেখি, এটা তারাই করেছে। লাজ ফার্মার মতো অনেক ফার্মেসিতে তারা এটি সরবরাহ করেছে।’

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘পণ্যটি যে কোম্পানির নামে বাজারজাত করা হচ্ছে, অর্থাৎ সেই রোশ ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তারা ব্যাচ নম্বর দেখে জানায়, এই ব্যাচের স্ট্রিপ তারা উৎপাদন করেনি, বাজারেও ছাড়েনি। এরপর সেই নয়াপল্টনের প্রিন্ট ওয়ান নামের একটি প্রিন্টিং প্রেসে অভিযান চালানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি ফার্মা সল্যুশনসকে মোড়ক সরবরাহ করার পাশাপাশি বাজারজাত করতে সহায়তা করে। বিষয়টি নকল জেনেও তারা ছাপে। অথচ তারা আমাদের কাছে এটা স্বীকারও করেনি। আমরা তাদের ইনভয়েস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রমাণ পাওয়ার পর তারা বিস্তারিত জানায়।’

মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ফার্মা সল্যুশনসের প্রধান নির্বাহী পল্লব চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘কোম্পানির কিছু বিক্রয়কর্মীর মাধ্যমে এটি ঘটেছে। বিক্রয়কর্মীদের নানা ধরনের চাপ থাকে, চাপে পড়ে তারা এটা করেছে। তবে দায় আমাদের নিতে হবে; বাড়তি বলার কিছু নেই। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক বিষয়।’

বক্তব্য দেওয়ার সময় পল্লব চক্রবর্তী ডায়াবেটিস বিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে তার কোম্পানির অবদানের কথা তুলে ধরেন। এ ছাড়া তিনি ঘটনাটি ছোট ভুল আখ্যা দিয়ে আংশিকভাবে দায় এড়ানোর চেষ্টা করলে উপস্থিত অনেকে তার প্রতিবাদ করেন।

মোড়ক তৈরি করা প্রতিষ্ঠান ওয়ান প্রিন্টের মালিক লুৎফর রহমান বলেন, ‘ফার্মা সল্যুশনসের সঙ্গে আমাদের বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল। তাদের লেনদেন এত ভালো যে, মোড়ক ছাপাতে আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। আমরা দুটি ধাপে প্যাকেট ছেপেছি ১০ থেকে ১১ হাজার টাকার প্রিন্টিং। তবে আমি ২ লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছি। কারণ দেশের অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে, এমন ঘটনায় সহায়তা করেছি।’

ভোক্তা অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করছে। বিষয়টি উল্লেখ করে সফিকুজ্জামান বলেন, ‘অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিবেশী একটি দেশ থেকে লাগেজ পার্টির মাধ্যমে এই স্ট্রিপ আসছে। বিশেষ করে কাপড়ের লটের মধ্যে এসব দেশে আসছে। কাস্টমস পয়েন্টে তার কোনো তদারকি হচ্ছে না। তাদের উচিত হবে, এগুলো ভালোভাবে দেখভাল করা। ঔষধ প্রশাসনেরও বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান করা উচিত, আমরা তাদের সহায়তা করব।’

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, ঘটনাটি সাধারণভাবে চাল-ডালের ভেজালের সঙ্গে মেলালে চলবে না। এই পণ্য কোল্ড চেইন মেনে বাজারজাত করতে হয়। এ ধরনের পণ্য দেশের বাইরে থেকে নিয়ে আসতে গেলে ঋণপত্র না খোলার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী আমদানির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণপত্র খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে কেউ বেআইনি কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।

নকল স্ট্রিপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার মন্ডল। তিনি বলেন, ‘অভিযানকালে শুধু নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ নয়, বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ স্ট্রিপও পাওয়া গেছে। এমনও ফার্মেসি পাওয়া গেছে, যেখানে পাঁচ মিনিট অভিযান করে ৪৩ প্যাকেট মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ এখনো ফার্মেসিতে পাওয়া যাচ্ছে।’

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির বলেন, এ ধরনের আয়োজন সরকারের ঔষধ প্রশাসনের করার কথা, তারা হয়তো কিছু করে। কিন্তু ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় ভোক্তা অধিদপ্তরের এ ধরনের উদ্যোগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। ব্যবসায়ীদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান, তারা যেন কারও প্রাণহানির সহায়ক না হন, এ ধরনের অন্যায় থেকে বিরত থাকেন।

ফার্মেসি কাউন্সিলের সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুল হক বলেন, ‘ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বা অন্য কোনো ওষুধের বিষয়ে আমাদের জানানো হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনবল না থাকায় মাঠপর্যায়ে কাজ করা যায় না। তবে অভিযোগ এলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে সেই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //