অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা : তথ্যমারির শিকার?

করোনা ভাইরাস মহামারির সময় বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল যে টিকা, সেই অ্যাস্ট্রাজেনেকা এখন তথ্যমারির (কুতথ্যের মহামারি) শিকার। গোড়া থেকেই অপপ্রচারের শিকার ছিল। তবে সম্প্রতি এত বেশি তথ্যবিকৃতি হয়েছে, শেষে বাজার থেকে সব টিকা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিটিশ-সুইস কোম্পানিটি। 

এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ হিসেবে তারা বলছে, করোনার নতুন ধরনগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য বাজারে এত বেশি উপযোগী টিকা আছে যে, এখন আর ওভাবে চাহিদা না থাকায় অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অনেকেই বলছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোয় পর্যন্ত লেখা হচ্ছে, বিরল হলেও বাহু ও মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর প্রকাশ হওয়ার পর কোম্পানিটি টিকা তুলে নিচ্ছে। এ কথা সত্য নয়। 

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এমনকি মৃত্যু হয়েছে, তা মিথ্যা নয়। মামলা হয়েছে। মামলার নথিতেও অ্যাস্ট্রাজেনেকা সে কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা এই টিকার বিরুদ্ধে যা ছড়ানো হয়েছে তা হলো কু-তথ্য। 

৭ মে ২০২৪ ইউরোপীয় কমিশন ঘোষণা করে, তারা এই টিকা আর ব্যবহারের অনুমোদন করছে না। কিন্তু এরও বেশ আগে, ২৭ মার্চ অ্যাস্ট্রাজেনেকা নিজেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে ইইউ বিপণন অনুমোদন প্রত্যাহারের আবেদন করেছিল। তবে এই কথাটি কম প্রচার হয়েছে। গুজব ও কু-কথা যত দ্রুত ছড়ায়, প্রকৃত তথ্য সেভাবে ছড়িয়ে পড়ে না। 

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম টিকা রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়। ওই বছরই ২৫ লাখ ডোজ এই টিকা দেওয়া হয়। এতে প্রায় ৬৩ লাখ মানুষের জীবন বাঁচে। ভারতে যখন করোনার নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছিল এবং বিশ্বব্যাপী টিকার খুবই চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল, অ্যাস্ট্রাজেনেকাই তখন ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। কোনো টিকা উদ্ভাবনের পর দীর্ঘ বছর ধরে যাচাইকরণ ও পরীক্ষামূলক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে প্রায় শতভাগ নিরাপদ ও সফল হলেই তা সাধারণ রোগীর শরীরে ব্যবহারের অনুমতি পায়। কিন্তু করোনা মহামারির সময় যেভাবে প্রতি সেকেন্ডেই প্রাণ ঝরছিল, মৃত্যুর সেই স্রোত থামাতে যথাদ্রুত বিজ্ঞানীরা উপায় বের করেন এবং স্বাভাবিকভাবেই দরকারি দীর্ঘ নিরীক্ষার সময় তারা পাননি। 

রক্ত জমাট বাঁধার প্রশ্ন? ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের বলছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা নেওয়া এক কোটি মানুষের মধ্যে ৬৬ জনের বাহুতে ও সাত জনের মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। আর টিকা না নেওয়া করোনা আক্রান্ত এক কোটি মানুষের মধ্যে ১২ হাজার ৬১৪ জনের বাহুতে ও ২০ জনের মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধে। এই তুলনা অবশ্যই মনে রাখতে হবে।

অথচ জার্মানির মতো দেশের পত্রিকাও শুরুতেই কোনো নথি বা প্রমাণাদি হাজির না করেই ভুল তথ্য ছড়িয়েছিল এই বলে যে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে মাত্র ৮% কার্যকর। এমনকি এমন কু-তথ্যও ছড়িয়ে পড়েছিল : করোনার এই টিকা নিলে বন্ধ্যত্বের ঝুঁকি বাড়ে। প্রকৃত সত্য এই যে, তথ্যটি ডাহা মিথ্যা। করোনার নতুন নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছে। সেসবের জন্য যথোপযোগী টিকা উদ্ভাবনে সদাব্রত আছেন বিজ্ঞানীরা, যাদেরই সেরা একটা দল অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা উদ্ভাবন করেছিল। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া মানেই কিন্তু অপ্রিয় হওয়া নয়। কিন্তু পার হয়ে নৌকার মাঝিকে ভুলে যাওয়াই একটা চল হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অশোভনীয় এবং অমানব বৈশিষ্ট্য। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //