গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর একের পর আওয়ামী লীগে মন্ত্রিসভার সদস্য ও দলীয় শীর্ষ নেতাদের নামে দুর্নীতির প্রমাণ মিলছে। আওয়ামী লীগ আমলের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধেও মিলছে নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ। জানা গেছে, তার নামে বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে করোনার টিকা, কিট, নকল মাস্ক বানিয়ে ও ভুয়া আমদানি দেখিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে । এমনকি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালের ক্রয়, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসা সেবা, চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইকুইপমেন্ট, ওষুধ সরবরাহসহ বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়নমূলক কাজে ভাগ বসিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
জাহিদ মালিকের নামে আভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতির এ সব টাকা দিয়ে নামে বেনামে ব্যবহার করে এক ডজনের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ঢাকার গুলশানে আলিশান বাড়ি, গ্রামের বাড়িতে মায়ের নামে বিশাল বাগান বাড়ি এবং এগ্রো ফার্ম তৈরি করেছেন। তাছাড়া বনানীতে ১৪ তলা ও মানিকগঞ্জে ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছেন। সভা সেমিনার করার জন্য মানিকগঞ্জে নিজ ছেলের নামে বিশাল মিলনায়তন শুভ্র সেন্টার তৈরি করেছেন।
সেইসঙ্গে জাহিদ মালেক বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, বিডি থাইফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেড, রাহাত রিয়েল এস্টেট এন্ড কন্সট্রাকশন লিমিটেড, বিডি সানলাইফ ব্রোকারেজ হাউজ লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠানে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছিলেন।
করোনাকালে মুন্সীগঞ্জের একটি কারখানায় এন-৯৫ নকল মাস্ক বানিয়ে ভুয়া আমদানি দেখিয়েছেন। এসব মাস্ক হাসপাতালের চিকিৎসকদের দেওয়া হতো। এই কাজটির সঙ্গে সরাসরি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালিক, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডাক্তার আবুল কালাম আজাদ মিলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেএমআই গ্রুপের মাধ্যমে করে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমন তথ্য করোনাকালে বিভিন্ন গণ্যমাধ্যমেও উঠে এসেছিল।
করোনাকালে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অযোগ্যতার কারণে করোনাভাইরাস সংকট প্রকট হচ্ছে। এই দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে ৫ থেকে ১০ গুণ বাড়তি দামে মানহীন মাস্ক, পিপিইসহ সুরক্ষা সামগ্রী সরকারিভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে। সেজন্য এসব কেনাকাটার নিয়ন্ত্রণ একটি সিন্ডিকেটের হাতে থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে সেই প্রতিবেদনে।
টিআইবি অভিযোগ করেছে যে, একটি সিন্ডিকেট বিভিন্ন ফার্মের নামে সব ধরনের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একাংশ এতে জড়িত রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে এন-৯৫ মাস্ক লেখা মোড়কে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক সরবরাহ করার বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। করোনাভাইরাস পরীক্ষার রক্ত সংগ্রহের টিউব, সিরিঞ্জ থেকে শুরু করে পিসিআর মেশিন কেনাসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রীর ক্ষেত্রে নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
লাখ লাখ গ্রাহক হয়রানির শিকার :ক্ষমতার অপব্যবহার করে সারা দেশের লাখ লাখ গ্রাহকে হয়রানি করছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। গ্রাহকের টাকা দিতে না পেরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা করা হয়। সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে কোম্পানির চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের (ডিএমডি) বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা হয়। আদালত সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ড. রুবিনা হামিদ, সিইও মোহম্মদ নূরুল ইসলাম ও ডিএমডি সুমনা পারভীনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
জানা যায়, ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা কোম্পানিটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। এটির চেয়ারম্যান মন্ত্রীর বোন অধ্যাপক রুবিনা হামিদ। পরিচালক হিসেবে রয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রী শাবানা মালেক, ছেলে রাহাত মালেক ও বোন রুবিনা হামিদের স্বামী কাজী আখতার হামিদ। রুবিনা হামিদের আগে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে (আইডিআরএ) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিরীক্ষিত হিসাব অনুসারে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ১৯২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। অর্থাৎ আইন অনুসারে কোম্পানিটি ব্যবসা পরিচালনায় যে ব্যয় করতে পারে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। অতিরিক্ত ব্যয় করা এসব টাকার ৯০ শতাংশই বিমা গ্রাহকের জমাকৃত টাকা। এ কারণে গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারেনি।
এদিকে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জাহিদ মালেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর ১৯৮৪ সালে বাবার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় কর্মজীবন শুরু করেন। রাজনীতির পাশাপাশি নতুন নতুন ব্যবসায় হাত দেন এই তরুণ যুবক। বাবা আব্দুল মালেকের দিক নির্দেশনায় গড়ে তুলেন বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, বিডি থাইফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেড, রাহাত রিয়েল এস্টেট এন্ড কন্সট্রাকশন লিমিটেড, বিডি সানলাইফ ব্রোকারেজ হাউজ লিমিটেডের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বর্তমানে তিন সন্তানের জনক জাহিদ মালেকের সহধর্মিণীর মিসেস শাবানা মালেকসহ সন্তানরা তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
এলাকাবাসী জানান, মায়ের নামে বিশাল বাগান বাড়ি এবং এগ্রো ফার্ম তৈরি করেতে গিয়ে এলাকায় সাবেক মন্ত্রীর সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে জমি জবরদখল করে নিয়েছেন। জমি নিয়ে ন্যায্য দাম দেননি। তাদের বলেছিলেন স্কুল করবেন, করেছেন বাগান বাড়ি ও কৃষি খামার।
এ ব্যাপারে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও ছেলে রাহাত মালেক শুভ্রর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন এবং তার ছেলে-মেয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়েছে।
মানিকগঞ্জ-৩ (সদর ও সাটুরিয়া) আসনের প্রার্থী জাহিদ মালেকের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রথমবারের মতো জয় লাভ করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত তার আয় ও সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে আসেন এবং ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দায়িত্ব পান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh