মালি থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনী সরানোর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে শান্তিরক্ষা বাহিনীর মিশন সমাপ্ত ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশটিতে ২ জুলাই থেকে শান্তিরক্ষীদের প্রত্যাহার কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব শান্তিরক্ষী প্রত্যাহার করা হবে। জাতিসংঘের অনুরোধ সত্ত্বেও জুন মাসে মালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুলায়ে দিয়োপ শান্তিরক্ষী বাহিনী সরিয়ে নেওয়ার আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানান। তিনি অভিযোগ করেন, মালির নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে এই মিশন। 

অপরদিকে জাতিসংঘ অভিযোগ করেছে, ২০২২ সালের মার্চে মালির সেনাবাহিনী এবং রুশ ভাড়াটে সেনারা দেশের মধ্যাঞ্চলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ৫ শতাধিক বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে। এ ছাড়াও মালি সরকার শান্তিরক্ষী মিশনের কর্মকাণ্ডে নিয়মিতভাবে বাধা সৃষ্টি করেছে। এহেন অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ জুন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ফ্রান্সের প্রস্তাবিত এক রেজ্যুলেশনে ভোটাভুটির পর সর্বসম্মতিক্রমে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মালি থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনী সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একই দিনে জাতিসংঘের প্রশাসনিক ও আর্থিক পঞ্চম কমিটির সভায় মালির মিশনের জন্য ৫৯০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়; যা স্বাভাবিক বার্ষিক বাজেটের অর্ধেক। 

২০১৩ সালে মালির উত্তরাঞ্চলে ‘আল-কায়েদা’ সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীদের কর্মকা- নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেখানে থাকা ফরাসি বাহিনীকে সহায়তা দিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে মালিতে ১৭ হাজার ৪৩০ জন শান্তিরক্ষী মোতায়েন ছিল। শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের ১০ বছর পরও মালিতে শান্তি ফিরে আসেনি। বছরে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার খরচে এই মিশনের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে এই মিশনের সাফল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা ছিল ২০২০ সালের সামরিক অভ্যুত্থান। এরপর ২০২১ সালের মে মাসে দ্বিতীয়বার সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। তখন থেকেই মালির সরকার অভিযোগ করছে, মালিকে অশান্ত করছে সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স।  

শান্তিরক্ষী ও ফরাসি সেনাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও মালিতে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা বেড়েছে। দেশটিতে শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের তিন বছর পর ২০১৬ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের ‘ইউএন ডিসপ্যাচের’ এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের পর শান্তিরক্ষীরাই সেখানে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ২০২০ সালে প্রায় ৩ হাজার সহিংস ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালে তা কমে ২ হাজারের নিচে নেমে গেলেও ২০২২ সালে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি সহিংস ঘটনা ঘটে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো নিজেদের পক্ষে দেশটির নাগরিকদের টানতে তৎপরতা জোরদার করেছে। গত এক দশকে সেখানে তিন শতাধিক শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছে। শুধু তাই নয়, মালি থেকে এই সংঘাত আশপাশের দেশ বুরকিনা ফাসো ও নাইজারে ছড়িয়ে পড়েছে। 

রাশিয়া ও চীন মালির এই মিশনের সমালোচনা করেছে এবং ব্রিটেন ও সুইডেন সেখানে সেনা মোতায়েনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। গত বছর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন এবং সেনা প্রত্যাহারও করে নিয়েছেন। মালির সামরিক নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ম্যাক্রোঁ। কারণ মালির সামরিক সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান বারবার পিছিয়ে দিচ্ছিল এবং নিরাপত্তা দিতে তারা ভাগনার গ্রুপকে মোতায়েন করে। 

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অর্থায়ন সীমিত করতে চেয়েছিলেন। জো বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের নীতি পরিবর্তন করলেও অর্থায়নের বিষয়টি মার্কিন কংগ্রেসের ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের (সিএফআর) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের বাজেটের ২৭ শতাংশ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০০১ সাল থেকে মার্কিন কংগ্রেস বাজেটের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত দিতে রাজি হয়। এ কারণেই প্রতিবছরের বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র বড় একটা অঙ্ক বাকি রেখে দিচ্ছে। তবে ৮ বছরের মধ্যে তিনগুণ বাড়িয়ে ২০২১ সালে চীন বাজেটের ১৫ শতাংশ অর্থায়ন করে। এর পরও শান্তিরক্ষা মিশনে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলো সেনা মোতায়েন করে না। এই শূন্যস্থান পূরণ করছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ; যারা অর্থের বিনিময়ে মিশনে সেনা পাঠায়।  

ব্রিটিশ থিংকট্যাংক চ্যাটহ্যাম হাউসের গবেষক পল মেলি বলেন, শান্তিরক্ষীরা চলে যাওয়ার ফলে মালির কিছু অঞ্চলে সরকার বিভিন্ন সেবা দিতে ব্যর্থ হবে এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারের নতুন করে সংঘাত হতে পারে। কিন্তু পল মেলি এড়িয়ে গেছেন যে এক দশকেও জাতিসংঘ মালিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। মালি থেকে শান্তিরক্ষা বাহিনী সরিয়ে ফেলতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে। যা প্রমাণ করে, শক্তিশালী দেশগুলোর স্বার্থ ছিল মালি থেকে সেনা প্রত্যাহারের পিছনে; যার ঠিক উল্টোটা ছিল দেশটিতে সেনা মোতায়েনের সময়। জাতিসংঘ যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না, সেই বাস্তবতাটা এক দশক ধরেই ছিল; কিন্তু ২০২৩ সালে শক্তিশালী দেশগুলোর স্বার্থ মিলে যাওয়ায় মিশনের সমাপ্তি ঘটছে। শান্তিরক্ষা মিশনের অর্থায়ন অনেক ক্ষেত্রেই মার্কিন কংগ্রেসের মর্জির ওপর নির্ভরশীল; যা আবার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ শক্তিশালী দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের ৩ শতাধিক সেনা; যারা অর্থের বিনিময়ে মালির মরুভূমিতে শক্তিশালী দেশগুলোর স্বার্থরক্ষা করেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //