গাজা গণহত্যা: মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে নজিরবিহীন বিক্ষোভ

গাজা যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এখন ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল। ঘটনার শুরু গত সপ্তাহে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাস থেকে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি দেয় কর্তৃপক্ষ। এ সিদ্ধান্ত যেন শিক্ষার্থীদের জ্বলন্ত আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেয়।

দেশব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস যেন একেকটা বিক্ষোভ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এতে যোগ দেয় নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), এমারসন কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ‘প্রকৃত আমেরিকানরা গাজার পাশে আছে’, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সেনাবাহিনী সরাও’, ‘গাজায় আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব নেই’, ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন’-এসব স্লোগানে মার্কিন ক্যাম্পাসগুলো এখন মুখর।

প্রতিবাদের সূত্রপাত ১৭ এপ্রিল; যখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট নেমাত ‘মিনোচে’ শফিক রিপাবলিকান-নেতৃত্বাধীন হাউসে শিক্ষা ও কর্মশক্তি কমিটির সামনে শুনানিতে ক্যাম্পাসে ইহুদি-বিদ্বেষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হন। এরপর আন্দোলনকারীদের দমন করতে শক্ত পদক্ষেপ নেন শফিক। ছাত্রত্ব বাতিলসহ গণগ্রেপ্তারের আদেশ দিয়ে তিনি আন্দোলন আরও উসকে দেন বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মারিয়েন হিরশ বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, উন্মুক্ত বিতর্ক দমন করা হয়েছে। ছাত্রদের মতামত প্রকাশ করতে এবং তাদের মতামত নিয়ে বিতর্ক করার অনুমতি না দেওয়ায় কার্যত বিক্ষোভের আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।’

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সাংবাদিকদের রেকর্ড করা এক ভিডিওতে দেখা গেছে, আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ চলার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা এক বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীকে মাটিতে ফেলে জোরজবরদস্তি গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে। সে সময় ওই শিক্ষার্থীকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি নিয়ে সেদিকে এগিয়ে যান অধ্যাপক ক্যারোলাইন ফলিন। তিনি পুলিশ সদস্যদের ওই শিক্ষার্থীকে ‘ছেড়ে দিতে’ বলতে থাকলে পাশ থেকে আরেক পুলিশ কর্মকর্তা এসে তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। আরও এক পুলিশ কর্মকর্তা এতে যোগ দিয়ে ফলিনকে মাটিতে ঠেসে ধরতে সহকর্মীকে সাহায্য করেন। দুই পুলিশ কর্মকর্তা অধ্যাপক ফলিনের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেন। এ সময় ফলিন বারবার বলছিলেন, ‘আমি একজন অধ্যাপক।’ এই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ক্যাম্পাসের বিক্ষোভে পুলিশি বলপ্রয়োগ মার্কিন গণতন্ত্রের মেকি চিত্রটি প্রকাশ্যে এনেছে। এদিকে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিক্ষোভের অধিকার সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অধ্যাপক নোয়েলে ম্যাকাফিকে ২৫ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয়। সেদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি সংবাদমাধ্যম ডেমোক্র্যাসি নাউকে বলেন, ‘আচমকাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলে পড়েছিল পুলিশ। টিজার ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহারের পাশাপাশি তারা রাবার বুলেটও ছুড়েছে।’ বলপ্রয়োগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে চলছে নির্বিচার গ্রেপ্তার। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তর ৫৫০ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারের কথা জানা গেছে। তার পরও বিক্ষোভ থামছে না। 

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী, ধর্মচর্চা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করতে হবে। এই সংশোধনী অনুযায়ী, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার হরণ কিংবা বাকস্বাধীনতা হরণের কোনো সুযোগ নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশি সহিংসতা প্রমাণ করেছে, ইসরায়েলি গণহত্যাকে মদদ দেওয়ার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র তাদের গণতন্ত্রও ত্যাগ করতে পারে। কলেজ ক্যাম্পাসে গণগ্রেপ্তার কার্যত মার্কিন গণতন্ত্রের মুখোশের উন্মোচন করে দিয়েছে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী এমান আবদেলহাদির মতে, ‘আমি মনে করি, পুরনো প্রজন্মের ব্যাপারে তাদের সত্যিকার অসন্তোষ রয়েছে। তবে যা আরও গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি নতুন প্রজন্মের অসন্তোষের বিষয়টি। সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বড় ছাত্র বিক্ষোভ চলাকালে জনমতে এক বড় পরিবর্তন আসতে দেখা গেছে। দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে ক্যাম্পাসের এ বিক্ষোভ। কমবেশি এমন একটা ধারণা আছে, এ বিক্ষোভই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে।’

আন্দোলনে যুক্ত হয়ে তরুণদের মধ্যে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আসতেও দেখা যাচ্ছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যুক্ত হন স্থানীয় অধিবাসী মিশেল। ২৩ বছর বয়সী নম্র স্বভাবের এই মেয়েটিকে কেউ উচ্চস্বরে কথা বলতেও শোনেনি। এমনটাই জানান সহপাঠীরা। অথচ সম্প্রতি গাজা গণহত্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরোধী কয়েকটি সমাবেশে যুক্ত হন মিশেল। এ আন্দোলন যখন তার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত পৌঁছে গেল, তখন মিশেল দেখলেন, তার মতো আরও অনেকেই এতে যুক্ত হচ্ছেন। এখন বন্ধুদের সঙ্গে মিশেলও দৃঢ় কণ্ঠে স্লোগান দেন। এ প্রসঙ্গে মিশেল বলেন, ‘আগে গাজা বা মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। নারী-শিশুসহ গাজাবাসীকে যেভাবে গণহত্যা করা হচ্ছে, তা আমাকে ভেতর থেকে নাড়া দিয়েছে। মানুষ হিসেবে এ গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আমার দায়িত্ব বলে মনে করি।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //