বিশ্বমঞ্চে ইরানের ভাবমূর্তির ভবিষ্যৎ

‘ইসলামি বিপ্লবের বরপুত্র’র বিদায়

রাষ্ট্র ভাঙে যুক্তরাষ্ট্র-এ অনুযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বার্লিন প্রাচীর তুলে দিলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙেছিল কে? সে দেশ বিশ্বজুড়ে এখনো গণতন্ত্রের মন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুবোধ বেচতে ব্যস্ত; অথচ গত সপ্তাহেই পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে বসে এক দলের আইনপ্রণেতা আরেক দলের আইনপ্রণেতাকে কুকথায় আক্রমণ করেছেন, ‘তোর চোখের পাপড়িই তো নকল, দৃষ্টিভঙ্গি কী করে আসল হবে?’ গণহত্যার প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীদের কীভাবে দমনপীড়ন করছে, কথিত মুক্তরাষ্ট্রের সেই চরিত্রচ্যুতির চিত্রও অনেকেই জানেন। 

আরেকটা দেশ আছে, যেটি আত্মরক্ষার অধিকার নিয়ে বেজায় সংবেদনশীল; ন্যায়ভ্রষ্ট, আগ্রাসী। ফিলিস্তিনিদের ওপর পঞ্চসপ্ততি বসন্ত অবিচার চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী নানাপক্ষের অনুরোধ, বারণ ও হুমকি সত্ত্বেও ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স গণহত্যা, মানবতাবিরোধী হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে গাজায়। এজন্য এই বাহিনীকে ইসরায়েলি ডিফ ফোর্স তথা ইসরায়েলি বধির বাহিনী বললে ভুল হবে না।

মুসলিমবিদ্বেষী যে দুটি দেশের কথা বলা হলো, এরা মধ্যপ্রাচ্যে যেটুকু তাও সমঝে চলছিল, এর কারণ ছিল শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের উত্থান ও বিকাশ। বিশেষ করে, গত তিন বছরে মার্কিন মোড়লিকে চ্যালেঞ্জ করা, মুখোশের আড়ালে থাকা পশ্চিমের পররাষ্ট্রনীতির নোংরা দিকগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা-এমন ‘কুছ পরোয়া নেহি’ নেতৃত্ব যিনি দিয়েছেন, ইরানের সেই প্রেসিডেন্ট আর নেই। ইব্রাহিম রাইসি নিহত হয়েছেন। 

পাহাড়ে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ একদল সহচারীর সঙ্গে রাইসির প্রাণহানি ঘটেছে। তার প্রাণসংহার কেউ করেছে কিনা, এ প্রশ্ন তেমন বড় হয়নি। কিন্তু কী কারণে যেন, ইসরায়েল আগেভাগেই মুখ খুলেছে, ‘এতে আমাদের কোনো হাত নেই।’ সীমান্তস্পর্শী মিত্র আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাঁধপ্রকল্প উদ্বোধন করে ফেরার পথে যে বহরে রাইসি ফিরছিলেন, এতে তিনটি কপ্টার ছিল। দুটি ঠিকমতো গন্তব্যে পৌঁছে গেল, ওটাই কেন আছড়ে পড়ল পাহাড়ে? চল্লিশ কি পঞ্চাশেক বছর আগের এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা কপ্টারেই বা কেন উড়ছিলেন রাইসি? ফলে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যারা প্রচার করেন এবং যারা গেলেন, তারা তেহরানের চিরবৈরী পক্ষ ওয়াশিংটন ও তেলআবিবের দিকে জল গড়িয়ে দিতে দেরি করেননি। সেই তর্কের সুরাহা এ লেখার গন্তব্য নয়।

বরং বিশ্বমঞ্চে ইরানের ভাবমূর্তির ভবিষ্যৎ কী হবে-এই পথে কথা হোক। প্রথমত তাদের বিদেশনীতি কি বদলে যাবে? সম্ভবত না। আন্তর্জাতিক নীতির প্রশ্নে ইরানের নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মোটাদাগে একীভূত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। [অন্তত ৫০ দিনের জন্য] অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হয়েছেন যিনি, মোহাম্মদ মোখবারের মুনশিয়ানা মূলত জাতীয় পর্যায়ে; অব্যাহত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ধকল সামলে ইরানের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রমাণপুরুষ তিনি। তবে চীন, রাশিয়া ও আফ্রিকায় রাইসির সফরসঙ্গী হিসেবে তাকে দেখা গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাগেরি কানি এর আগে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বৈশ্বিক পক্ষগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় নিজের কর্মনৈপুণ্যের ছাপ রেখেছেন। তবে আঞ্চলিক মিত্রশক্তিগুলোর সঙ্গে কতটা সখ্য সম্পর্ক আছে, তা পরীক্ষিত নয়। কিন্তু ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার অ্যান্ড পিস রিপোর্টিংয়ের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রকল্প ব্যবস্থাপক রেজা আকবরী সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছেন, ইরানের বিদেশ বিষয়ক ‘নীতিমালার আমূল পরিবর্তন হবে না। কেননা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, সর্বোচ্চ নেতা ও ইসলামিক বিপ্লবী প্রতিরক্ষা বাহিনী-এরা মিলে ইরানের বৈদেশিক নীতির এজেন্ডা নির্ধারণ করে থাকে।’ 

দ্বিতীয় প্রশ্ন, এতদিনে যে আঞ্চলিক প্রতিরোধ অক্ষ গড়ে তুলেছে ইরান, এর ভবিষ্যৎ কী হবে? যেমন-লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ, ইরাকের ইসলামিক প্রতিরোধ বাহিনী ও ইয়েমেনের সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনী হুতি। এদের সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক অনেকটা গরুর গাড়ির দুই চাকার মধ্যকার সম্পর্কের মতো-একটা বিনে অন্যটা অনগ্রযায়ী। অনতীতেই এই বন্ধনের মজবুত ছবি দেখা গেছে : গাজায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে নির্মূলের যে অধ্যাহৃত অগাকান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ইসরায়েল, তার বিরুদ্ধে হুতিকে লোহিত সাগরে ও হিজবুল্লাহকে সীমান্তে এবং ইরানকে সরাসরি ইসরায়েলি ভূভাগে আক্রমণ করতে দেখা গেছে। রাইসির প্রয়াণেও এই প্রতিরোধ বলয় বলবৎ থাকবে, এমনকি বলবর্ধন ঘটবে। কারণ প্রেসিডেন্ট রাইসি মারা গেছেন, কিন্তু সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি আছেন। বিপ্লবের বরপুত্র নেই, কিন্তু বরপ্রদ তো রয়েছেন। 

ইরান শোকাহত, স্তব্ধ; কিন্তু এতটুকু লক্ষ্যচ্যুত নয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //