মুসলিম-বিদ্বেষের পথেই বিজেপি

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি। তবে ডানপন্থি এনডিএ জোটের মদদে মোদি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এতে অবশ্য বিজেপি বা সংঘ পরিবারের কর্মকাণ্ড বদলায়নি। এখনো মুসলিম-বিদ্বেষ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতাই তাদের মূল হাতিয়ার। গত কয়েক বছরে গো-মাংসকে কেন্দ্র করে উত্তরপ্রদেশে যে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, একে হাতিয়ার করে ‘হিন্দুধর্ম রক্ষার’ নামে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরি করে ভোট করা সহজ হয়েছিল। এবার উত্তরপ্রদেশের মানুষ কার্যত বিজেপির সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে অস্বীকার করেছেন। তা সত্ত্বেও মোদির রাজনীতি একই পথে প্রবাহিত হচ্ছে।

নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একের পর এক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে ভারতে। প্রথমে স্টক মার্কেট কেলেঙ্কারি, এরপর ডাক্তারি পরীক্ষা কেলেঙ্কারি, পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা, অরুন্ধতী রায়কে বিচারিক আক্রমণ, শেখ সওকাত হোসেনের ওপর ইউএপিএ ধারায় মামলা দায়ের, এরপর মধ্যপ্রদেশে ১১ জনের ঘর ভেঙে দেওয়া হলো ফ্রিজে গরুর মাংস থাকার অভিযোগ তুলে। 

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোদি সরকার গো-মাংস খাওয়া আটকাতে বহুবার রাস্তায় নেমেছে। গো-রক্ষা সমিতি, বজরং দলের মতো একাধিক সংগঠনের তৎপরতা তুঙ্গে ওঠে। তারা মুসলিমদের বাড়ির ফ্রিজ খুলে দেখা শুরু করেছিল। এবার ক্ষমতায় এসে সেদিকেই এগিয়েছে বিজেপি সরকার। সংবাদমাধ্যম মিন্ট জানায়, ‘বেআইনি গো-মাংসের ব্যবসা’ আটকাতে মধ্যপ্রদেশের ১১ মুসলিমের ঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। মান্দলা জেলার পুলিশ সুপার রজত সাকলেচা পিটিআইকে জানান, তাদের কাছে খবর আসে যে, ওই সব বাড়িতে বেশ কিছু গরু ‘আটক’ করে রাখা হয়েছে। তাই তারা এসব বাড়িতে বুলডোজার চালিয়েছেন। বাড়িগুলো থেকে মোট ১৫০টি গরু ‘উদ্ধার’ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ঘরগুলোতে তল্লাশির পর ফ্রিজে গো-মাংস পাওয়া যায় বলে দাবি পুলিশের। রজত বলেন, ‘১৫০টি গরুকে উদ্ধার করা হয়েছে। ভাঁইসওয়াহি অঞ্চল এই মুহূর্তে গো-পাচারের কেন্দ্রতে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে গো-হত্যার জন্য সাত বছরের সাজা দেওয়া হয়। যারা এই কাজ করেছে তাদের ক্রিমিনাল রেকর্ড দেখা হচ্ছে। তারা সবাই মুসলমান।’

এ ঘটনা ২০১৫ সালে উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে আখলাককে হত্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। হত্যাকারীরা ধারণা করেছিল, আখলাক ও তার পরিবার গো-মাংস খেয়েছিল ঈদ উপলক্ষে এবং ফ্রিজে তারা মাংস পায়; যা দেখে তাদের গো-মাংস বলে সন্দেহ হয়। পরে জানা যায়, তা ছিল খাসির মাংস। স্রেফ তাদের সেই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে, ভিড় জমিয়ে আখলাককে হত্যা করা হয়।

অপরদিকে মণিপুরের জাতিগত দাঙ্গা বাধানোর জন্য কুখ্যাত মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং ২০১৭ সালে উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগরিকদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বলেন, ‘গো-মাংস এ প্রান্তের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের একটি অত্যন্ত জরুরি অঙ্গ। এখানে খ্রিষ্টানরা মূলত আদিবাসী মানুষেরা গো-মাংস খান। তাদের পরবর্তী প্রজন্মও খাচ্ছে। বিজেপি গো-মাংস খাওয়ায় কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করছে না। বেআইনি গো-হত্যা বন্ধ করার চেষ্টা করছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস, মানুষ যা দীর্ঘদিন ধরে খেয়ে আসছেন, বিজেপি কোনোভাবেই তাতে কোনো আপত্তি করছে না।’ একদিকে দেশের একপ্রান্তে গো-হত্যার নাম করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর লাগাতার আক্রমণ চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের মতো অঞ্চলে, গো-মাংস খাওয়াকে ‘খাদ্যাভ্যাস’ বলে চোখ সরানো হচ্ছে। দুটিই আসলে অঞ্চল ধরে রাখবার ফন্দি, ভোট আদায়ের মাধ্যম। 

নির্বাচনকালে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল নির্বাচনী দলগুলোর অর্থ লেনদেনের তথ্য। তখন একটি খবর সামনে আসে। জানা যায়, দেশের অন্যতম বৃহৎ গো-মাংস রপ্তানিকারী সংস্থা ‘অ্যালানা গ্রুপ’ বিজেপিকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে দুই কোটি রুপি অনুদান নেয়। 

ধর্ম এবং ধর্মীয় উসকানি মোদি সরকারের জন্য রক্ষাকবচের মতো কাজ করেছে। যখনই তাদের অবস্থা দুর্বল হয়েছে, তখনই ধর্মীয় উসকানির আশ্রয় নিতে হয়েছে তাদের। মধ্যপ্রদেশে তারা ২৯টা আসনের সবগুলোতেই জয়লাভ করেছে। তাই মধ্যপ্রদেশকেই ‘হিন্দুত্ব’ ফেরানোর জন্য এক্সপেরিমেন্টের মাটি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, এবার আর বজরং দলের মতো ‘প্রাইভেট বাহিনী’ নয়, রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীকেই হিন্দুত্ববাদী বাহিনীতে পরিণত করে আক্রমণ চালানো হয়। এতে হিন্দুত্ববাদের রাষ্ট্রীয়করণ যে শক্তিশালী ভিত পেয়েছে, তা প্রমাণ হয়। বিজেপি মানুষের সমর্থন যখন হারাচ্ছে; তখন হারানো জমি উদ্ধারের চেষ্টায় তাদের হাতিয়ার সাম্প্রদায়িকতার বাহন বুলডোজার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //