ফিরে দেখা বিশ্বসাহিত্য

কথায় আছে, একজন আশাবাদী মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকেন নতুন বছরকে দেখার জন্য। একজন হতাশাবাদী জেগে থাকেন পুরনো বছরের বিদায় নিশ্চিত করতে। দুই পক্ষই জেগে থাকেন বটে; তবে পরের ৩৬৫ দিনেও স্বনামে সেই একই বার-সপ্তাহই তো ঘুরেফিরে আসবে! অবশ্য প্রতিটি দিনই নতুন, সম্ভাবনাময়। চোখের পলকেই সময় চলে যায়।

উনিশ শতকের ইংরেজ কবি রাল্ফ হজসন (Ralph Hodgson) সেই কবেই তো লিখেছিলেন,‘Time, you old gipsy man’। আমি তার প্রথম পঙ্ক্তি বাংলায়ন করেছি এভাবে, ‘সময় তুমি বৃদ্ধ ভবঘুরে।’ সময় বুড়ো ঘোড়া, ছুটছে তো ছুটছেই। দেখতে দেখতে আরেকটি নতুন বছরের সামনে আমরা। সবাই হিসেব-নিকেশ করতে বসেছে, নতুন বছরকে নিয়ে। পুরনোকে বিদায় দেওয়ার আগে একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো কেমন কেটেছে এই বছরখানা। কেমন ছিল ২০২২ সালের বিশ্বসাহিত্য? 

বিশ্বসাহিত্যের কথা এলে শুরুতেই আমাদের মনে পড়তে বাধ্য, নোবেলজয়ীর কথা। গত ২০২২ সালের ৬ অক্টোবর সাহিত্যে নোবেল ঘোষণা দেয় সুইডিশ একাডেমি। এমনিতে অন্যান্য ক্ষেত্রে নোবেলের বিষয়ে চাপা উত্তেজনা কম থাকলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেটি ভিন্ন। বাংলাদেশের মানুষ সাহিত্যের বই পড়ুক বা না পড়ুক- কে নোবেল পেয়েছে তা জানতে বেশ উদ্গ্রীব থাকে।

এবার নোবেলজয়ী আনি এরনোর নামের উচ্চারণ নিয়েই মহা মুশকিলে পড়ে গিয়েছিল সাংবাদিককুল। ফরাসি নাম বলে কথা! যেখানে উচ্চারণে কত কী যে উহ্য রাখতে হয়! এমনটা হয়েছিল এমানুয়েল মাখোঁ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর। সে যাক, ‘ধান ভানতে আর শিবের গীত’ না গাওয়াই ভালো। এরনো প্রথম ফরাসি নারী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। সাহিত্যে নোবেল পাওয়া ১৭তম নারীও।

অশীতিপর এরনো তার সাহিত্যে লিঙ্গ, ভাষা, শ্রেণিবৈষম্যকে দ্ব্যর্থহীনভাবে তুলে ধরেছেন। এই আপসহীনতাই তাকে এনে দিয়েছে সাহিত্যের সবচেয়ে বড় সম্মাননা। এরনোর ২০০৮ সালে প্রকাশিত জীবনীভিত্তিক উপন্যাস ‘দ্য ইয়ার্স’কে বলা হয় ফরাসি জীবনের স্মৃতিচারণার মাস্টারপিস। বইটি ২০১৯ সালে ম্যান বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও ছিল। 

বেশ কয়েক বছরের মতো এবারও সাহিত্যে সম্ভাব্য নোবেলের অন্যতম ক্যান্ডিডেট ছিলেন জাপানের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি এবং ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি। গত ১২ আগস্ট নিউইউর্কে এক ভাষণ দেওয়ার সময় আততায়ীর ছুরিকাঘাতে আহত হন তিনি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরা রুশদিকে নোবেল দিতে বেশ কয়েকটি সংগঠন ও ব্যক্তি সুইডিশ একাডেমিকে সুপারিশ করেছিলেন। ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ দিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়ার পাশাপাশি অসংখ্য মানুষের ঘৃণাও কুড়ান রুশদি। যার কারণে প্রায় জীবনই দিতে বসেছিলেন তিনি। 

সাহিত্যের আরেক মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার বুকার নিয়েও অবশ্য এবার বেশ  হৈচৈ হয়েছে। ২০২২ সালের সাহিত্যে অবশ্য নারী ও উপমহাদেশেরই জয়জয়কার। হিন্দি ভাষায় লেখা ‘রেত সামাধি’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ ‘টুম্ অব সেন্ড’ দিয়ে প্রথম ভারতীয় হিসেবে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতেছেন গীতাঞ্জলী শ্রী। বইটি অনুবাদ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অনুবাদক ডেইজি রকওয়েল। এই প্রথম হিন্দি সাহিত্য বুকারের মুখ দেখল। ম্যান বুকারও এসেছে উপমহাদেশে।

শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে হত্যাকাণ্ড নিয়ে লিখিত অতিপ্রাকৃত বিদ্রুপাত্মক উপন্যাস ‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেইদা’ দিয়ে বুকার পুরস্কার জিতেছেন দেশটির লেখক শেহান করুনাতিলাকা। এমনিতে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে খুব বাজে অবস্থার মধ্যে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। আর এই সময়ে তাদের ঘরে এলো ম্যান বুকার।

এ তো গেল দুই মূল্যবান পুরস্কারের কথা। এবার দৃষ্টিপাত করা যাক, বিদায় নিতে বসা বছরে প্রকাশিত সব আলোচিত বইসমূহের দিকে। তার থেকে বছর শেষ হওয়ার  আগে আগে বিখ্যাত ‘টাইম ম্যাগাজিন’ আলোচিত ও পাঠকপ্রিয় ১০টি ফিকশনের তালিকা প্রকাশ করেছে। তাতে স্থান পেয়েছে আমেরিকান লেখক দানি শাপিরোর উপন্যাস ‘সিগন্যাল ফায়ার্স’। হার্নান দিয়াজের হিস্টরিক্যাল ফিকশন ‘ট্রাস্ট’।

কানাডার লেখক কিম ফুর ম্যাজিক রিয়ালিজম ও ডিস্টোপিয়ান জনরার ফিকশন ‘লেজার নোন মনস্টারস অব দ্য টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি’। এই তালিকার প্রথম বইটির নাম ‘টুমোরো, অ্যান্ড টুমোরো, অ্যান্ড টুমোরো’। লেখক গ্যাব্রিয়েল জেভিন। এর পরের স্থানে আছে এলিজাবেথ ম্যাকক্রাকেনের ‘দ্য হিরো অব দিজ বুক’, ইউন লির ‘দ্য বুক অব গুজ’, সারাহ থানকাম ম্যাথিউজের ‘অল দিজ কুড বি ডিফারেন্ট’, জুলিয়া মে জোনাসের ‘ভ্লাদিমির’, জোনাথন এসকোফেরির ‘ইফ আই সারভাইভ ইউ’ এবং ডগলাস স্টুয়ার্টের ‘ইয়ং মুঙ্গো’। 

বর্তমানের পাঠকদের দারুণ এক প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে গুডরিডস (goodreads)। তারাও ২০২২ সালে প্রকাশিত ২০০ জনপ্রিয় বইয়ের তালিকা করেছে। যার অধিকাংশ মিস্ট্রি ও থ্রিলারধর্মী উপন্যাস, ফিকশন বা নভেলা। কেবল আমাদের দেশে নয়, বাইরের পৃথিবীতেও বর্তমানে এসব জনরার লেখা ও চলচ্চিত্র জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। যার প্রধান ভোক্তা কিশোর ও তরুণ বয়সীরা।

এসব পপ সাহিত্যের বাইরেও এখনো বছরব্যাপী পৃথিবীজুড়ে অহরহ নন-ফিকশন ও কবিতার বই, নাটক প্রকাশিত হচ্ছে। উপন্যাস-ফিকশনের তুলনায় যেসবের  জনপ্রিয়তা তেমন নেই বললেই চলে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বছরের প্রকাশিত কবিতার বইয়ের খবর প্রকাশ করেছে। তাদের প্রারম্ভটা এমন, ‘বছরটা শুরু হয়েছে জোলি টেলরের ‘সি+এনটু অ্যান্ড আদার্ড পোয়েমস’ দিয়ে।

কবিতার বইয়ের এমন নাম দেখেই লাইনখানা জুড়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। বলা চলে, পৃথিবীজুড়ে কবিরাই সবচেয়ে বেশি শব্দ ও বাক্য নিয়ে ভাঙচুর চালায়। এ তার প্রকৃত উদাহরণ। লোভজনিত কারণে আরেকটি বইয়ের নামও জানাতে চাই। ‘ও’ নামের কবিতার বই প্রকাশ করেছেন জেইনা হাশেম বেক। ২১ মার্চ বিশ্বকবিতা দিবস গেল। যেখানে এখনো এসব তরুণ কবি নন, পুরনো কবিরাই আসন দখল করে বসে আছেন। 

‘থ্রিপল টু’ বছরে বিশ্বব্যাপী যাদের জনপ্রিয় লেখক ভাবা হয় তাদের বই তেমন প্রকাশ হয়নি। মুরাকামির ৭ বছর আগে প্রকাশিত ১২টি গদ্যের সংকলন  ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে ‘নভেলিস্ট অ্যাজ এ ভোকেশন’ নামে। আসেনি ‘অ্যালকেমিস্ট’ খ্যাত পাওলো কোয়েলহোর কোনো বইও। সামনের বছর আবারও সাহিত্যে নোবেলের আগে আগে চাপা উত্তেজনা দেখা দেবে সাহিত্যিকদের মধ্যে।

আলোচনা হবে মুরাকামি, রুশদিসহ অনেককে নিয়ে। তবে গত কয়েক বছর ধরে স্ইুডিশ একাডেমি যে পথে হাঁটছে তাতে এই দেশের লোকদিগের কাছে অখ্যাত বা অপরিচিত কোনো সাহিত্যিককে যদি তারা মর্যাদার এই পুরস্কার দিয়ে দেন তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না। কেবল নামের উচ্চারণজনিত সমস্যায় না পড়লেই হলো। 

সূত্র: লেখাটি তৈরির জন্য টাইমস, গুডরিডস, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, গুগল- মাধ্যমগুলোর সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //