লোক সাহিত্য

চারণ কবি: কামাল উদ্দিন পাশা

ভৌগোলিক অবস্থান, বিচিত্র আবহাওয়া, পরিবেশ-প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত সামগ্রীনির্ভর যাপনে, বসনে-নিবাসে-নিদানে, সংকটে, মানুষের জগৎচেতনায় এবং জীবনভাবনায় থাকে বৈচিত্র্য। সাহিত্য, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, কৃষি, প্রাকৃতিক সম্পদ, ঐতিহাসিক ঘটনায় সমৃদ্ধ সুনামগঞ্জ তথা হাওরাঞ্চল। এ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি, বাউলগান বাঙালির গর্বের ধন। তাৎপর্যময় শব্দে, বিস্ময়কর চেতনায় এখানকার কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকরা শব্দযোগেই করেছেন প্রেমময়ের সন্ধান। রাধারমণ (১৮৩৩-১৯১৫), হাসন রাজার (১৮৫৪-১৯২২) পরে যার নামটি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল হয়ে আছে, তিনি হলেন বাংলা লোকসাহিত্যের নিষ্ঠাবান কবি কামাল পাশা (১৯০১-১৯৮৫)। তিনি ভাটি অঞ্চলেরই সন্তান। 

১. ‘দীন দুনিয়ার মালিক খোদা/দিলে কি দয়া হয় না?, ২. সাজিয়ে গুজিয়ে দে মোরে সজনি তোরা, ৩. আমার কাঙ্খের কলসি জলে গিয়াছে ভাসি, ৪. প্রেমের মরা জলে ডুবে না’ -এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের এই পদকর্তা মেধা, শ্রম, অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাসের জোরে অজস্র বাধা-বিপত্তির মধ্য থেকেও নিজেকে অজেয় করে তুলেছেন প্রান্তিক জনপদে বাস করে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছেন, শহর তাকে টানেনি। যৌবনকালে নিজের রচিত গান গেয়ে মাতিয়েছেন কলকাতা। গ্রামোফোনের মাধ্যমে তার গান ছড়িয়ে পড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কলকাতায় কিংবা ঢাকায় স্থায়ী হননি। 

সাহিত্য-জীবনের সূত্রপাত এবং উত্তরাধিকারসূত্রে কামেল পিতার যোগ্য উত্তরসূরি। শৈশবে পিতার কাছে সংগীত শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। বাংলা লোকসাহিত্যের তীর্থভূমি তথা বৃহত্তর সিলেটের লৌকিক ঐতিহ্যের মধ্যেই তিনি লালিত। এর বিস্তর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় রচনায় ও জীবনদর্শনে। ধর্মীয় উন্মাদনার আড়ালে, বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রাখার জন্য যে সকল ষড়যন্ত্র হয়েছে এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করেছেন প্রতিবাদী গান গেয়ে। আমৃত্যু ভাটিপাড়ার মাটিকে বুকে আগলে রেখেছেন পরম মমতায়।

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ। মানুষের জীবন সমৃদ্ধকারী এক শক্তির নাম ‘শিল্পকলা’। মানবজাতির জন্য সুন্দর জীবন নির্মাণ করাই হচ্ছে ‘শিল্পকলা’র মূল উদ্দেশ্য। আর জীবনের অন্যতম একটি অংশ ‘শিল্প’। যেহেতু জীবন থেকে কখনোই ‘শিল্প’কে বাদ দিতে পারি না, তাই বলা যায় জীবনের জন্যই ‘শিল্প’। যিনি সৃষ্টি করেন অর্থাৎ চিন্তা, চেতনা, আবেগ, অনুভূতির মিশ্রণে সত্যকে শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেন তিনিই শিল্পী। যে কোনো শিল্পকে বোধের আয়ত্তে নিয়ে আসা শিল্পীর প্রধান কাজ। আর বাণী, সুরে, কণ্ঠের মাধুর্যতায় দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে পৌঁছানোই একজন কণ্ঠশিল্পীর সার্থকতা। জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতাসমূহকে অস্ত্র বানিয়ে ভাব-ভাবনার গহিন হতে মুক্তা আহরণ করতে পারেন কেবল একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। জ্ঞানীর নিরন্তর সাধনা, শিল্প-চেতনা, শিল্প আন্দোলন মানুষের জীবনকে নিয়ে যায় সত্য, সুন্দরের দিকে। অর্থাৎ ‘শিল্পকলা’ মানুষকে সুন্দর জগৎ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। তাই ‘শিল্পকলার’ সঙ্গে একাকার হয়ে বাঁচতে চায় ‘শিল্পমনা’, ‘শিল্পবোধ’ সম্পন্ন কিছু মানুষ। যুগে যুগে এরাই নমস্য। 

হাসন রাজা, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিমের নাম দেশ-বিদেশে যেভাবে পরিচিত সেভাবে পৌঁছায়নি কামালের নামটি। অথচ তার অসংখ্য জনপ্রিয় গান মানুষের মুখে মুখে। আমাদের উদাসীনতার কারণে তার প্রাণের খোরাক আজ অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো- ব্যক্তি কামাল বা তার গান নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা-সমালোচনা, গবেষণা কিংবা পত্র-পত্রিকায় বিশদভাবে লেখা হয়নি। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা এবং তার গানের যথার্থ মূল্যায়ন অতীব জরুরি।

পারিবারিকভাবে এবং বিশিষ্ট আলেম জ্ঞানীদের সাহায্যে বিশেষ জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সংস্কৃত সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন ভাটিপুত্র কামাল। তার সঙ্গে চলেছেন, তাকে দেখেছেন এমন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বক্তব্য- “মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজে পড়ুয়া কামাল ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তার অমায়িক ব্যবহার, গরিব-দুঃখীর প্রতি মমত্ববোধ, চলন, বলন, জ্ঞান, পাণ্ডিত্য ছিল উচ্চমার্গের। আত্মসম্মানবোধ, নম্রতা-ভদ্রতায় ছিল ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। তবে কিছুটা রাগী ও অভিমানী স্বভাবের ছিলেন। যে কোনো বিষয়ে উপস্থিত গান রচনা করে গাওয়া ছিল তার অন্যতম গুণ। আড্ডায়, আসরে, হাটে-ঘাটে কথা বললেই যেন গান হয়ে যেত। কখনো দেখিনি গান রচনার জন্য প্রস্তুতি কিংবা খাতা কলমের প্রয়োজন হতো। মনোহরা সুরে যে কোনো মানুষকে তাৎক্ষণিক আনন্দ দিতে তিনি ছিলেন পারদর্শী। পালাগানের মঞ্চে কখনো তাকে কেউ হারাতে পারেনি। অশেষ গুণের অধিকারী কামালের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। সুন্দর বাচনভঙ্গিতে বক্তব্য এবং সুরেলা গানে কিছু সময়ের জন্য হলেও শত দুঃখ-কষ্টে থাকা মানুষগুলোকে আনন্দের সাগরে ভাসাতে পারতেন। এর বহু নিদর্শন রয়েছে গ্রামোফোন, সিনেমা, রেডিওসহ দুই বাংলায় খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পীদের কল্যাণে জনপ্রিয় গানগুলোতে। হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ছিল না তার কাছে। হিন্দু ধর্ম এবং দেব-দেবী সম্পর্কে তার যত জ্ঞান ছিল অনেক 

ব্রাহ্মণ-পুরোহিতেরও এসব বিষয়ে এত জ্ঞান নেই।” এই বক্তব্যের সত্যতা মেলে রচনায়-
হরি নামের মর্ম ভাই সকলে বুঝে না
পাইছে যারা ভবে তারা যমের ভয় রাখে না।
হরি নামের আসল মর্ম প্রহ্লাদে পাইল
হরিরূপ ধারণ করিয়া নিজের প্রাণ বাঁচাইল॥

গীতিকবি হিসেবে যেমন বেহিসেবি ছিলেন, তেমনি আবেগেও বেহিসেবি। আজীবন সহজ পথে চলেছেন, জীবনটাকে সহজভাবে দেখেছেন, আর মানবিক ব্যক্তিত্বের উদাহরণ রেখেছেন আচরণে, জীবনদর্শনে। মানুষের ক্ষুদ্রতা, জীবনদর্শনে অসম্পূর্ণতা দেখে তিনি ছিলেন বিচলিত, হতাশ। অবলীলায় নিঃসংকোচ সত্য উচ্চারণ করতেন, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। এর ফলে জীবদ্দশায় নিন্দুকের সমালোচনার শিকার হয়েছেন বারংবার। জীবনাভিজ্ঞতায় তিক্ততাও কম ছিল না! অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত রূঢ় ভাষায়ও গান লিখেছেন। স্বার্থপরতা, ব্যক্তিগত অহমিকা, মিথ্যাচার পীড়া দিত অকুতোভয়, স্পষ্টবাদী এই কবিকে। 

প্রকৃতি এবং পিতার কাছে পাওয়া শিক্ষায় কর্তব্যনিষ্ঠা, উদারতা, মানব কল্যাণের উজ্জ্বল প্রতীক কামাল ব্যক্তি জীবনে ছিলেন পরোপকারী, সদালাপী, নিরহংকার এক অসাধারণ মানুষ। এ কারণেই তিনি তার কালের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সংস্পর্শে যেমন আসতে পেরেছিলেন তেমনি অতি সাধারণ মানুষের সঙ্গেও ছিল মধুময় সম্পর্ক। আমৃত্যু চেয়েছেন মানবতা ও গণমুক্তি। 

সাহিত্যের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে- সুস্থ, সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সর্বসাধারণের বোধকে শানিত করা। এই ‘বোধশক্তি’ যখন থেকে শুরু ঠিক তখন থেকেই মানুষের ভাবনা-চেতনার উদয়। অর্থাৎ চেতনা থেকেই মানুষ পেয়েছে নব নব সৃষ্টির তাগিদ। সমাজ, দেশ, রাষ্ট্রকে সুন্দর করে গড়ে তোলার প্রেরণাও এসেছে এই চেতনা থেকে। সভ্যতার বিকাশ, সমাজের প্রয়োজনে সুফি, মরমি, ফকির, দরবেশ, মহৎ ব্যক্তিদের মতো মনের ভাব, চিন্তা-চেতনাকে কামালও প্রকাশ করছেন বাণী, সুরের মাধ্যমে-
ভাটিপাড়া জন্মস্থান পিয়াইন নদীর বাঁকে
জীর্ণ কুটিরে তোমার কামাল কবি থাকে
যদি তোমার দয়া হয় দেখে যেও দয়াময়
যে পথে আসা-যাওয়া সদাই তোমার।

জীবনের গভীর থেকে গভীরতর আঁধারে দাঁড়িয়ে কবির অনন্ত জিজ্ঞাসা ফুরায় না। নির্বাক মৃত্যুর স্মৃতি রচনায়, গভীর মর্মস্পর্শী আবেদনে তার কলম স্রষ্টার কাছে লিখে চলে দুর্বার গতিতে। প্রেমময়ের নিকট অনন্ত হয়ে ওঠে ভক্তের প্রার্থনা, আরাধনা। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে অনবরত কবিমন হিসেব কষেন, খুঁজে চলেন জীবনের অর্থ। প্রবহমান জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অগ্নিশিখায় কত স্বপ্ন, ইচ্ছে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়। তবু কবি বাঁচেন আশা নিয়ে, প্রহর গোনেন দয়াময়ের দর্শন প্রত্যাশায়। অন্তহীন জিজ্ঞাসাজালে আমাদের জীবন আবর্তিত। এর শুরু আছে, বিস্তার আছে, কিন্তু শেষ নেই। এক সময় হিসাবের খাতা পূর্ণ হয়, অতি কষ্টে স্বজন হারানোর বেদনা লুকালেও মৃত্যুচিন্তা কি লুকাতে পেরেছেন? না, পারেননি! অবশেষে যন্ত্রণার পাহাড় ডিঙিয়ে, জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কবি কামাল পৌঁছেছেন সেই প্রেমময়ের একান্ত সান্নিধ্যে।

কামালের দীক্ষাগুরু বা মুর্শিদ ছিলেন মরমি কবি আজিম উদ্দিন। তিনি ধার্মিক ছিলেন কিন্তু পারিবারিক পরিবেশের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। ফলে আদর্শ পিতার শিক্ষা-দীক্ষায় বেড়ে উঠেছেন। ভারতের দেওবন্দ উলুম মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে বিশিষ্ট আলেম জ্ঞানীদের সাহচর্যে আরবি, ইংরেজি, ফার্সি, সংস্কৃত, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। এর প্রভাব লক্ষ করা যায় তার রচনাকীর্তিতে। জাত-পাতের দেয়াল ভেঙে গানের বাণীতে বলেছেন প্রেমের কথা, মুক্তির কথা মানবতার কথা, সাম্যের কথা। তার সামগ্রিক জীবনাচরণ, মন-মননে, চিন্তা, কর্মে-ধর্মে প্রবল আকারে রয়েছে মানবতাবাদী এবং মুক্তির চেতনা।

যৌবনে পিতার সঙ্গে কলকাতা ভ্রমণের ফলস্বরূপ গ্রামোফোনসহ কলকাতার বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানিতে অসংখ্য গান রেকর্ড করেছেন নিজের কণ্ঠে। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, মঞ্চে, ঘরোয়া আয়োজনে গেয়েছেন নিজের গান। উল্লেখ্য, তিনি অন্যের রচিত গান গাইতেন না। ফলে দুই বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে সহজেই পৌঁছে গেছে তার মরমি, ভাব গানের আবেদন। মানুষের সুখ-দুঃখের অনুভূতিমিশ্রিত গানগুলো শিল্পীর কণ্ঠে যেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তেমনি জায়গা করে নিয়েছে বাংলা সিনেমায়। ১৯৬৪ সালে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ‘কামাল পাশা’ সম্মানসূচক উপাধি পেয়েছিলেন। বাউল কামাল, কাঙাল কামাল, কামাল উদ্দিন, কবি কামাল, কামাল শাহ, কামাল মিয়া, কবিয়াল কামাল, কামাল পাগল ইত্যাদি ভণিতায় গান রচনা করেছেন। তবে অধিকাংশ গানে ‘কাঙাল কামাল’, ‘কবি কামাল’ এবং ‘কামাল পাশা’ ভণিতা ব্যবহার করেছেন। তার অন্যতম কৃতিত্ব হলোসুনামগঞ্জের সন্তান হয়েও সিলেট বা সুনামগঞ্জের আঞ্চলিকতা থেকে গানকে মুক্তি দিয়েছেন। লোককবিদের গানে নিজ অঞ্চলের আঞ্চলিকতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন রাধারমণ, আরকুম শাহ, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমের গানে সিলেটের আঞ্চলিকতা প্রাধান্য পেয়েছে। সেই তুলনায় দুর্বিন শাহ এবং কামাল পাশার গানে আঞ্চলিকতার আংশিক উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও তারা ভিন্ন আমেজে আঞ্চলিকতাকে উপস্থাপন করেছেন।

বাংলার লোকায়ত সাধনাকে অন্তরে লালন করে, ধারণ করে বাউল, বৈষ্ণব, মরমি এবং সুফিবাদ-মিশ্রিত গানগুলোতে প্রতীক, উপমা, রূপক, ভাব-ভাষা-বিষয়-উপমা, উৎপ্রেক্ষা, শব্দচয়ন প্রভৃতি ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ রচনাসম্ভার বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করেছে, রয়েছে মুন্সিয়ানার ছাপ। ফলে বাঙালির ভাবুক মনে তার বাণী, সুর ভক্তি-রসের জোগান দেয়। ধর্মীয় শিক্ষা, কলেজে অধ্যয়নসহ সংগীত জীবনের আদ্যোপান্ত পাওয়া যায় তার রচনায়, আকুল করা সুরে। শৈশব থেকেই জীবন-জগৎ সম্পর্কে বিচিত্র চিন্তা, 

ভাব-বিহ্বলতায় আচ্ছন্ন থেকেছেন। সামাজিক লোকনিন্দা, নানারকম অপমান, অপবাদ, লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। নানকার আন্দোলনে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দায়ে তার গানের খাতা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কণ্ঠরোধ করতে পারেনি বরং কবিকণ্ঠে জ্বলে উঠেছিল প্রতিবাদের দাবানল। 

কবি-সাহিত্যিকের কখনো ‘জাত’ হয় না। তারা জীবনবাদী, তাদের সাধনায় মিলিত হয় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র। তারা একই সুরে গেয়ে ওঠেন, ‘জাত গেল জাত গেল বলে’। লালন সাঁইকে কেউ মুসলমান, কেউ বা হিন্দু হিসেবে প্রতিপন্ন করায় প্রতিশ্রুত। আমরা ভুলে যাই যে, হিন্দু-মুসলিম বড় কথা নয়; বাউল গানই হলো সকল জাতি-গোত্রের মিলনস্থল। বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের পাশাপাশি বসবাস চিরকালই অম্লমধুর। ফলে কামালও সম্প্রদায়ভিত্তিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছিলেন। মূলত তার গানের আবেদন মানবিক। ইসলামের গভীর সত্যোপলব্ধি, হিন্দু ধর্মের ভক্তি-বিশ্বাস, দেব-দেবীসহ মানুষের হৃদয়কে একান্ত সত্যভাবে, সত্যস্বরূপে আবিষ্কার করেছেন প্রেমময় আবেদনে। অর্থাৎ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই বার্তাই বহন করে তার বাণী। হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধক কবিরা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে আদর্শ করে রূপকের আবরণে গান লিখেছেন। তদ্রুপ মুসলমান সাধক কবিরাও রাধা-কৃষ্ণ রূপকের আড়ালে বহু গান রচনা করেছেন। যেমন সুফি কবি আরকুম শাহ লিখেছেন ‘কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে, ফুলে পাইলা ভ্রমরা’। কামালও এর ব্যতিক্রম নন, তিনি লিখেছেন-
ধর্ম নিয়ে (একটা) গুল বেধেছে, মীমাংসা নেই আজ পর্যাপ্ত
চেষ্টা করে কেউ পারে না দিতে, সেই সঠিক সিদ্ধান্ত ॥
হরি বলে কেউ করে পূজা
কেউ পড়ে নামাজ, কেউ রাখে রোজা
সে জন হয় সঠিক সোজা, গুছিয়ে মনের ভ্রান্ত ॥
শত নামে ডাকলে তারে, শুনে সেই জগৎ গোসাঁই
যত মত আর ততই পথ, তাতে ভিন্নতা নাই

তার গানে যেমন হিন্দুধর্মের রাধা-কৃষ্ণ, নিমাই সন্ন্যাস, বেহুলা-লক্ষীন্দর, রাম-সীতা, পুরাণ প্রসঙ্গ রয়েছে, তেমনি কোরআন-হাদিসের আলোকে নামাজ, রোজা, কেয়ামত, কারবালা, মহরম, আল্লাহ-নবীসহ ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়াদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ছলে তত্ত্ব-তথ্যে ভরপুর। বাউল, সুফি ও বৈষ্ণব দর্শনের আলোকে জীবাত্মা-পরমাত্মা সন্ধানের চেষ্টা করেছেন প্রেমিক হয়ে। মাশুকের সঙ্গে মিলন কামনায় হয়েছেন আশেক, উন্মাদ, দেওয়ানা। সামনের সবকিছুকে গভীরতায় পর্যবেক্ষণ করতেন, ফলে তার অন্তর্দৃষ্টির গভীরতার উপর সৃষ্টি হয় নতুন ভাষাশৈলী। 

নানকার আন্দোলনে প্রতিবাদ করার ফলে কামাল পাশার গানের পা-ুলিপি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে ক্ষোভে-অভিমানে তিনি কলম ধরেননি, কিন্তু অস্ত্র বানিয়েছিলেন কণ্ঠকে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাদীপ্ত হয়ে রক্ষণশীল সমাজ এবং সমাজপতিদের অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করে মানব মুক্তির গান গেয়েছেন। সমাজ সংস্কারকের মতো গ্রামের সাধারণ মানুষদেরকে শিখিয়েছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ কীভাবে করতে হয়। ধর্ম ব্যবসায়ীদের কটাক্ষ করেছেন তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে। বৈষম্যের বেড়াজাল ডিঙিয়ে মানুষে মানুষে ঐক্য প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে তার বাণী। সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে উদার সম্প্রীতির ধারক-বাহক কামালের জীবনাচরণে, মন-মননে, চিন্তা-কর্মে, মানবতাবাদী চেতনায় অন্তরপ্রেরণার উৎসমূল হলো মানবপ্রেম। মানবতাই তার ধর্ম। সমাজপতিদের জাঁতাকলে পিষ্ট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মুক্তির গান গেয়েছেন এই সংগঠক। সমাজের অসংগতি, ধর্মে-ধর্মে হানাহানি, মনুষ্যত্বের অবমাননা, জাতিতে-জাতিতে বিভেদ তাকে পীড়িত করে তুলেছে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজবাদী, মানবতাবাদী ভাবনাগুলো সুরে প্রকাশ করেছেন। দৃঢ়চেতা, আত্মপ্রত্যয়ী এই সাহসী পুরুষ ছিলেন মুক্ত প্রাণ, স্বচ্ছ দৃষ্টির অধিকারী এক সাধক।

আমাদের লৌকিক সমাজ জীবনের স্বচ্ছ দর্পণ হলো ‘গান’। ইতিহাস এবং সময়কেও ধারণ করে ‘গান’। অর্থাৎ মানব সমাজে বেদনা-মধুর এক ইতিবৃত্তের নামই ‘গান’। সমাজ, কাল, প্রেক্ষাপট, সময় পরিবর্তনশীল, কিন্তু ‘গান’ সর্বকালে, সর্বযুগেই আমাদের অন্তর্লোককে গভীরভাবে স্পর্শ করে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ বিভেদের দেওয়াল টপকিয়ে সমকালীন, উত্তরকালীন জনমানস একাত্ম হতে পারে কেবল গানের সঙ্গে। অর্থাৎ ‘গান’ হচ্ছে শব্দের শিল্প। যে উপকরণে গানের সৃষ্টি হয়, এর আবেদন যথার্থরূপে ব্যবহার করার মধ্যে ‘গান’ রচনার সার্থকতা। ‘গান’ প্রসঙ্গে কামালের উদ্ধৃতি দেখে নেওয়া যাক, তারই রচিত উল্লেখযোগ্য একটি গানে-
গান শুনিয়া কী লাভ হবে অর্থ না বুঝিলে
সুরে তালে মগ্ন হইয়া আহা উহু করিলে॥
ভাবুকের ভাবের কথা গানেতে আছে গাঁথা
ছুটে যাবে অজ্ঞানতা বুঝ করিয়া শুনিলে।
যে না গানের অর্থ বুঝ গুরুদেবের কাছে খোঁজ
অজ্ঞানতা কর ত্যাজ্য চৈতন্য হও সকালে॥
গানেতে ফুটে হৃদয় গানেতে জ্ঞান লাভ হয়
আছে বটে তার পরিচয় লিখা আছে দিলে।
ভগবানকে পাওয়ার রাস্তা গানের মাঝে সেই ব্যবস্থা
গান কভু বিকে না সস্তা ভাবিয়া দেখ দিলে॥
গান হইল আয়না তারে না দেখিলে যায় না
আছে সবার জানাশোনা বুঝ করিয়া শুনিলে।
যদি গানের মাঝে গ-গোল হয়
বুঝবেন না ভাই গানের বিষয়
রাগ করবেন না মহাশয় বলে কবি কামালে॥

বাংলার ক্ষণজন্মা এই কবি বিবিধ রূপকে, বিষয়ের অন্তরালে, কখনো বা ভাবগভীরে আত্মগোপন করে নিজ সাধনা শক্তির অনুকূলে ভাষা-বর্ণনায় মনের রঙে রাঙিয়েছেন বাণীকে। মানব মুক্তির মর্মবাণী, প্রেমাকাক্সক্ষা, না পাওয়ার বেদনা, ধর্মের মর্মবাণীসহ মরমি চেতনাবলে বলীয়ান হয়ে সত্যের সন্ধান করেছেন প্রাণের তৃষ্ণা মেটাতে। বাংলাদেশের লোকায়ত সাধনা তথা- নাথ, শাক্ত, যোগী, বাউল, বৈষ্ণব, মরমি, সুফিবাদী ভাবনার সম্মিলনে কল্যাণময় এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন। ফলে উদারতায়, মানবতাবাদী চেতনায় রচনা করেছেন বাঙালির হাজার বছরের প্রাণের ঐশ্বর্য বাউল গান। হিন্দু সাধক, কবিরা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমমূলক লীলা-খেলাকে আদর্শ করে রূপকের আবরণে কখনো বা সরাসরি গান রচনা করেছেন। পিছিয়ে নেই মুসলমান সুফি সাধকরাও, যুগে যুগে রাধা-কৃষ্ণ রূপকের আশ্রয়ে গান রচনা করেছেন। এই ধারাবাহিকতায় কামাল পাশার অধিকাংশ রচনায় রাধা-কৃষ্ণ, দেব-দেবীর প্রভাব লক্ষণীয়। বাউল, সুফি, বৈষ্ণব দর্শনের আলোকে জীবাত্মা-পরমাত্মার সন্ধান করেছেন রূপকের আড়ালে। সৃষ্টিকর্মের মাধুর্যতা, প্রাসঙ্গিকতা, 

বৈষ্ণববাদ-প্রেমবাদ, সুফিবাদের প্রভাবসহ বিষয়বৈচিত্র্যে, তাল-সুর-লয়ে কামালের অনন্য কীর্তিমাখা কালোত্তীর্ণ পদগুলো গবেষণার উপজীব্য হিসেবে বিবেচিত।

কামালের গানের মর্মস্থলে বিষয়বস্তু, ভাবসম্পদ, গঠন কাঠামো, অবয়ব, প্রকৃতি, আঞ্চলিককতাসহ ইহজাগতিকতা, পারলৌকিকতা, বৈরাগ্যবোধ, অন্তরঙ্গ উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কখনো গানগুলো হয়েছে সুরাশ্রয়ী, কখনো বা ভাবাশ্রয়ী। বহু বর্ণিল কথামালায়, আবেগে সুরারোপিত উজ্জ্বলতামণ্ডিত ভাব, প্রেম, বিরহকে কেন্দ্র করেই সুষমামণ্ডিত হয়েছে। সমাজ, জীবন, প্রকৃতি ছাড়াও ‘তত্ত্ব’ প্রাধান্য পেয়েছে কোনো কোনো গানে। স্পর্শকাতর, সচেতন অন্তর্লোকের সন্ধান পাওয়া যায় স্রষ্টা এবং সৃষ্টির উৎস হিসেবে অবতীর্ণ এই কবির রচনায়। নিরন্তর সাধনায়, ভাব-ভাষায়, সামগ্রিক শিল্পশৈলী সমকালীন দর্শক-শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গ্রামের নিরক্ষর, অশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, সহায়সম্বলহীন মানুষের মনের কথাগুলো সহজ ভাষায় বিচিত্রমুখী সুরের সমন্বয়ে, বৈচিত্র্যে মানুষের স্পর্শকাতর হৃদয়ে সমর্পিত। গানকে তিনি গেঁথেছেন কর্ম, প্রেম এবং আনন্দ-বেদনার অমর কথকতায়-
আসলে যখন যাইতে হবে, সব গিয়াছে চলে
যেমন আইজ তুমি, কাইল আমি, সকালে বিকালে।
রঙ্গরসে ভুলে রইলে, চিনলে না তোর মূল সাকিন॥

স্বভাবসুলভ বাচনে তার আত্মজিজ্ঞাসা, কাব্যজিজ্ঞাসা, ঐতিহ্যপ্রীতি, বিজ্ঞান চেতনা, জীবনবোধ, বাস্তবতা মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে বিকশিত করে। ব্যক্তি কামাল থেকে গানকে আলাদা করা যায় না। সাধনার ক্ষেত্রে তার অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, জিজ্ঞাসা শিক্ষিত বাঙালি পাঠকের কাছে নিরন্তর চেতনাপ্রবাহের বার্তা দেয়। সেই বৈদগ্ধ্য গুণে তিনি এক ব্যতিক্রমধর্মী বাঙালি প্রতিভা। মালজোড়ার আসরে এমনকি অনেক ঘরোয়া আড্ডাতেও দর্শক-শ্রোতাকে আবিষ্ট করে তোলেন প্রশ্নবাণে। একসময় দর্শক-শ্রোতা নিজের অজান্তেই তার চেতনা ও যুক্তিগ্রাহ্য উপস্থাপনে জিজ্ঞাসাজালে জড়িয়ে পড়েন জাদুময় আবেশে। নিজস্ব চিন্তার জগৎ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরিপূর্ণ সঞ্চয়ে যাপিত জীবনে প্রতিদিনের রক্তক্ষরণের যন্ত্রণায় কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসত একেকটি মুগ্ধতা। আরবি, হিন্দি, ইংরেজির মিশ্রণে সর্বপ্রথম তিনিই গান রচনা করেছেন। এমন একটি গানের কয়েক ছত্র- 
ট্রেনিং মাস্টার খুঁজে নিয়া শিখো রোল রেগুলেশন
কামিনীর ম্যাচ খেলাতে উইনার যদি হবে মন॥
প্লেগ্রাউন্ড হয় মনিপুরে প্লেয়ার যত খেলা করে
নারী পুরুষ একাধারে সর্বদা কম্পিটিশন।
মিস্টার বলেন হ্যালো মিসেস, গিভ মি ডানিং গোল্ডেন কেইছ
থাসিং মাত্র পুরুষ দিসেস গেটো ম্যান প্রেজেন্টেশন॥

গ্রামবাংলার মানুষের জীবনযাত্রার চিন্তা-চেতনা, সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন, আশা-নিরাশার ইতিবৃত্ত, প্রাণকাড়া সুরের আকর্ষণেই গ্রামীণ লোকজীবনের প্রাত্যহিক অনুষঙ্গগুলো তার বাণীর মাধ্যমে হয়ে উঠেছে আমাদের লোকসাহিত্যের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ধর্মসাধনা ও ভাবসংগীত সৃষ্টির মাধ্যমে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের বার্তায় স্রষ্টা-সৃষ্টি, ইহকাল-পরকাল, জীবন-জগৎ, জন্ম-মৃত্যু, অধ্যাত্মবাদ, ধর্মীয় অনুভূতি এবং প্রেম- তার রচনায় যেন অন্যতম সুমহান ঐতিহ্যে বাঙালির অস্তিত্বের শ্রেষ্ঠ চিত্রকল্প। গানের বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গিতে রয়েছে সম্মোহনী শক্তি, আধ্যাত্মিক ভাব-ভাবনার প্রতিচ্ছবি, জীবাত্মা-পরমাত্মার পারস্পরিক সম্পর্ক। স্রষ্টার প্রতি সমর্পণ, আকুলতা-ব্যাকুলতা, মুক্তচিন্তা, জীবনাভিজ্ঞতাসহ নিজস্ব জীবনদর্শন প্রতিফলিত তার রচনায়। অন্তরাত্মাকে নির্মল, পরিশুদ্ধ করার রসদে জীবাত্মা-পরমাত্মার পারস্পরিক সম্পর্ক, লোকজীবন ও সাধন জীবনের সহজিয়া মত-পথকে আঁকড়ে ধরেছেন।
বাজনার ভেতরে আছে এবাদত আর বন্দেগি
গানের বিচার করে মানুষ হইয়া যায় সংসার ত্যাগী॥
চলিয়া পাহাড়ের গুহায় দমের বৈঠা বাইছে সবায়
বাকি রইল দেহের খাজনা চিন্তায় হইলাম রোগী॥

স্রষ্টাপ্রেমের আকুলতায় মর্মস্পর্শী ডাকে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের তীব্র হাহাকার পরিলক্ষিত হয় আকুল করা সুরে। সততা, আদর্শ, বিশ্বাসের প্রতি অবিচল থেকে সমকালীন, উত্তরকালীন জনমানসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশেছেন ব্যক্তিজীবনে। বৈরাগ্যবোধ, ইহজাগতিক, পারলৌকিক চেতনায় হৃদয়ের আর্তনাদে পরিপূর্ণ বেদনাগাথাগুলো কখনো সুরাশ্রয়ী, কখনো বা ভাবাশ্রয়ী। বিরহ-বেদনা, কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা রাধার আকুলতা, চাওয়া-পাওয়ার অফুরন্ত বাসনা, মুর্শিদের প্রতি নিবেদন, অনুগত্য, বিলাপ, রোদন, আর্তিসহ কঠিন বাস্তবতাকে সঞ্চয় করেছেন বাণীর ভা-ারে। হাওরের জীবন ঘনিষ্ঠ বাস্তবতাকে সহজ-সরল মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছেন দরাজ কণ্ঠের সুরমাধুর্যে। বাউল দর্শনে, সুরের আধিপত্যে প্রেমের জয়গান গেয়েছেন নিজে প্রেমিক হয়ে। বাঙালির জীবন প্রবাহের ছবি এঁকেছেন সূক্ষ্মদৃষ্টিতে। ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে ব্যাপক পাণ্ডিত্য ছিল এই শক্তিমান কবির। ফলে অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচনের মাধ্যমে প্রেমের সাধনায় স্রষ্টার আরাধনা, অনুসন্ধান তথা অধরাকে ধরার নিরন্তর প্রচেষ্টা করেছেন উপলব্ধিকে জাগ্রত রেখে। ধর্মীয় অনুশাসনগুলোকে বাণীর মোড়কে আবদ্ধ করেছেন তত্ত্বকথার আবর্তে। 

বাংলার চিরায়ত লৌকিকধর্ম সহজিয়া ভাবধারার। তাই ধর্মীয় উন্মাদনা, শাস্ত্র-শাসন, সামাজিক বিধি-নিষেধ, ধনী-গরিব-বর্ণবৈষম্য গ্রামের মানুষের সরলতাকে হরণ করতে পারেনি। এরই ধারাবাহিকতায় সাধকরা সততা, সাম্য, উদারতা, মানবতায় সাংস্কৃতিক জগৎকে করেছেন সুষমাম-িত। মনের তাগিদে মা, মাটি, মানুষের গান গেয়েছেন কামাল। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বর্বর স্বেচ্ছাচার, অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি-অনিয়ম-জনজীবনে এবং জীবিকায় আর্থিক, নৈতিক, সামাজিক এমনকি সম্পদের নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক জীবনে এনেছে ভয়ংকর নৈরাজ্য। গানে গানে এসব থেকে মুক্তি চেয়েছেন কামাল। হাওর জনপদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নায় দুর্দিনের পরম বন্ধু ছিলেন সহজাত এই বাউল কবি। হাওরের গাছপালা নিয়েও রচনা করেছেন ‘গাছের গান’। 

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় তার গান, দর্শন মানবতাবাদের এক অনন্য নিদর্শন। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এবং জাতিভেদের বিভেদ অতিক্রম করে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে এসব গান পৌঁছে গেছে উচ্চতর স্থানে। গানের বাণীতে লোকায়ত সুরের অভূতপূর্ব সমন্বয়, মানবতার বার্তায় অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচনের মাধ্যমে সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। সাধারণ মানুষের জীবনের ক্রিয়াশীল নানা সংকট নিরসনে, মানুষে মানুষে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন সম্মুখে। সমাজে নানারকম অবিচার, নির্যাতন, অপসংস্কৃতি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মশাল হাতে রুখে দাঁড়িয়েছেন অগ্র সৈনিকের ভূমিকায়। জীবনযাত্রার প্রণালি, ভাষা, সংস্কৃতি, গঠন কাঠামো, স্রষ্টার আনুকূল্য লাভের প্রত্যাশায় ধর্ম-দর্শন ও মানবতাবাদী চেতনার প্রসার ঘটিয়েছেন সুরে সুরে। ইতিহাস বিমূর্ত হওয়া বাণীর মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষ, সমাজ এবং পৃথিবীকে দেখেছেন ভালোবাসার দৃষ্টিতে। আধ্যাত্মিক চেতনায় জাগ্রত কামাল বাংলার মানুষের প্রাণে বৈরাগ্যের সুর ঢেলে দিয়েছেন বাণীর কারুকার্যে। তার জীবন ছিল ঈশ্বর ভাবনায় উৎসর্গীকৃত।

স্রষ্টাপ্রেমের ঐশ্বর্যময় প্রাণশক্তি প্রবাহিত অন্তরে ‘প্রেমবাদ’ই তার সাধনার পথকে প্রসারিত করেছে, পাশাপাশি বৈষ্ণববাদের রাধা-কৃষ্ণকেও স্থান দিয়েছেন সুউচ্চে। লক্ষণীয় যে, বহুমাত্রিক চেতনায় গানের বিষয়-ভাবনা এক জায়গায় আবদ্ধ নয়। বিষয়-বৈচিত্র্য, ভাববাদী ভাবনা, মরমি মানসে, বক্তব্যের গভীরতায়, বাণী-সুরের লালিত্য গানকে করেছেন মাধুর্যম-িত। হৃদয় উৎসারিত ভক্তিমূলক গান, হামদ-নাত, গজলগুলো মানুষের প্রাণে ভাব-রসের উদ্রেক করে। নিঃসন্দেহে এসব বাণী-মনকাড়া সুর সুধী সমাজে প্রাণের তৃষ্ণা মিটিয়ে হয়েছে আদরণীয়, সমাদৃত, বাংলার লোকায়ত ধারার ক্ষণজন্মা, ব্যতিক্রমী এই লোককবি আমাদের জন্য রেখে গেছেন স্রষ্টাপ্রেম, মানবপ্রেম, মানব মুক্তি, প্রণয়, বিচ্ছেদ, বেদনাসহ ধর্মের মর্মবাণী। ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, কুপ্রথার বিরুদ্ধে মানুষে মানুষে ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করেছেন। অত্যন্ত রসিক, সজ্জন এই মহাজনকে সম্মানের সঙ্গে অনেকে ‘পিরসাব’ বলে সম্বোধন করতেন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন ধর্মসাধনা এবং বাউল গানের প্রতি নিবেদিত। কামেল পিতার শিক্ষায় সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন মানবতাবাদী, প্রতিবাদী এই কবি। শিক্ষিত হয়েও অন্যের চাকরি করতে চাননি। ব্যবসার প্রতিও কোনো আগ্রহ ছিল না। গানই ছিল তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান-প্রেম। চিন্তা-চেতনায় লোকজীবনের, মরমিলোকের গায়ক হলেও সমকালীন রাজনীতিকে সূক্ষ্মভাবে জায়গা দিয়েছেন গানে। প্রতিবাদের ভাষা জোরালো ছিল ভরাট কণ্ঠস্বরে। মেধা, শ্রম, অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাসের জোরে শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নিজেকে নির্লোভ রেখেছেন। তাত্ত্বিকতার গ-ি পেরিয়ে সমকালীন 

আর্থ-সামাজিক, সাধারণ জনজীবনসহ সমাজের ক্রিয়াশীল নানা সংকট নিরসনের রসদ রেখেছেন ধর্মসাধনায় রচিত বাণীতে। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র।

মননে-মেজাজে, শৈল্পিক বুননে, দার্শনিকতায়, প্রেমোন্মাদনায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ বাণী ও সুরের সমন্বয় তার গান জনচিত্তকে স্পর্শ করে অনায়াসে। নানা কারণেই এসব গান নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি এবং চিরকালের এই সম্পদ বাংলার লোকসাহিত্যে পাথেয় হয়ে থাকবে। ভাববাদী ভাবনায়, বক্তব্যের গভীরতায়, সুরের মাধুর্যতায় আকর হয়ে থাকবে এসব গান। উপলব্ধিজাত জীবনাভিজ্ঞতার নির্যাসে সমৃদ্ধ কামালগীতির মাধ্যমেই জ্ঞান-প্রজ্ঞা, চিন্তায়, বিদ্যায়, গুণে-মানে-মনে-মননে মনীষায় সাহিত্য, রাজনীতি ও সমাজ চেতনায় শিল্পাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলবে কামাল পাশা নামটি। মানুষের চিত্তহরণ করা কামালের হৃদয়ের হাহাকারগুলো সাদা কাগজে কালো অক্ষরে বাংলা গানের ইতিহাসে ভাস্বর।

লেখক: লোকসংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //