স্মৃতিকথা

আমাদের যৌথ জীবন

তখন আমি মুন্সীগঞ্জে মেয়েদের স্কুলে ক্লাস ফাইভে বা সিক্সে পড়ি। আমাদের ক্লাসে সেসময় কেউ বইয়ের গল্প শোনাত অন্য সহপাঠীদের। মনে পড়ে, স্কুলের মাঠে গোল হয়ে বসা দশ-বারোজন একান্ত আগ্রহী শ্রোতার সামনে এক দুপুরে প্রবল উত্তেজনার সঙ্গে আমি আমার সদ্য পঠিত কিশোর রহস্যোপন্যাস ‘কুয়াশা’র গল্প বলেছিলাম। সবটা গল্প মনে পড়ে না আজ। তবে তাতে টান টান উত্তেজনা ছিল। ছিল মরফিন খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে কাউকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করার বিবরণ। একটা মজার ছড়া ছিল সেই বইতে, ইঁদুর বা ছুঁচো সম্পর্কে। বইটি আমার এত ভালো লেগেছিল সেই সময় যে, সহপাঠীদের গল্প শুনিয়েই ক্ষান্ত হইনি, আমার ছোট ভাইয়ের জন্মদিনে উপহার হিসেবে কিনেও দিয়েছিলাম। প্রথম পাতায় কাঁচা হাতে লেখা জন্মদিনের উপহারের সেই বাক্যটি লিখতে গিয়ে বাঁ থেকে ডান দিকে সরল রেখাটি ক্রমাগত উপরের দিকে উঠে গেছিল, স্পষ্ট মনে আছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমার সেই প্রিয় বইটি একাত্তরে আমাদের মুন্সীগঞ্জের বাড়ি লুট হয়ে যাওয়ার বা জিনিসপত্র পুড়িয়ে ফেলার কোনো এক পর্যায়ে খোয়া গেছে। 

সেই বইয়ের লেখক ‘জ্যোতিঃপ্রকাশ দত্ত’ আর কেউ নয়, আজকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। ১৯৫৮-তে ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে ছাপানো ‘কুয়াশা’-ই জ্যোতির প্রথম প্রকাশিত বই, যার কোনো কপি আজ আর আমাদের কাছে নেই, বাজারেও কোথাও পাওয়া যায় না। (এই প্রসঙ্গে আমার বিশেষ অনুরোধ, কারও কাছে যদি এই বইয়ের কোনো কপি থেকে থাকে, অথবা যদি একটি ফটোকপিও কোথাও থেকে জোগাড় করে দেওয়া সম্ভব হয়, আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব)। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর, বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগাতে এই বইটি লিখেছিল জ্যোতি। 

জ্যোতিঃপ্রকাশ দত্তকে তখন আমি জানতাম না। ফলে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৭- এই ৯ বছরে দেশের উত্তাল ও উত্তপ্ত রাজনীতিকালে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত যে কেবল কিশোরদের জন্য ‘কুয়াশা’ লিখেই ক্ষান্ত হননি, ‘কেষ্টযাত্রা’, ‘একজন পুরুষ চাই’, ‘গোলাপের নির্বাসন, ‘আরো কয়েকটি পুতুল’, ‘পরমাত্মীয়’র মতো সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে আশ্চর্য সব গল্প সৃষ্টি করেছিলেন, এবং তিনি ও তার সতীর্থরা যে তখন নতুন এক ধারার সাহিত্য নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, আর ‘সপ্তক’, ‘কালবেলা’র মতো মানসম্পন্ন লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছেন, এসবের কোনো কিছুরই খবর জানতাম না।

‘কুয়াশা’র পর জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সঙ্গে আবার আমার যোগাযোগ ১৯৬৭ সালে। এবার সশরীরে। ১৯৬৭ সালের ২০ আগস্ট, রবিবার, জ্যোতির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়, তাদের ঢাকার বাসায়, ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডে। আর ১৯৬৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, রবিবার, পরিচয়ের ঠিক ছয় সপ্তাহ পর, আমাদের বিয়ে হয়, মুন্সীগঞ্জে, আমাদের বাড়িতে। বিয়ের আগে সর্বমোট চারবার তার সঙ্গে দেখা হয় আমার, ২০ আগস্ট, ২৭ আগস্ট, ৩০ আগস্ট ও ৩ সেপ্টেম্বর। মাঝখানের এই ৩০ আগস্টে অবশ্য দেখা হয়েছিল মাত্র এক বা দু মিনিটের জন্য। সায়েন্স অ্যানেক্স থেকে স্ট্যাটিস্টিক্সের  ক্লাস করে জগন্নাথ হল আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মাঝখানের কোনাকুনি রাস্তাটি ধরে হেঁটে রোকেয়া হলে ফিরছিলাম আমি। আর জ্যোতি তখনই রিকশা থেকে নেমে তাদের বাসার সামনের গেট খুলে ভেতরে ঢুকছিল। পড়ন্ত বিকেলে আমাকে বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে থামে সে। হাত তুলে থামায় আমাকেও। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মিনিট দু-এক কথা বলি আমরা। ঘরে গিয়ে এক কাপ চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানায় জ্যোতি, যা কোনো এক অজুহাতে অনায়াসে পাশ কাটিয়ে যাই। অপরিচিত সে মোটেও নয়, এ বাড়িতে ইতোমধ্যে দুবার গেছি আমি, মধ্যাহ্ন ভোজনেও অংশগ্রহণ করেছি। তবু কেন জানি সেই বিকেলে বাড়ির ভেতরে যেতে দ্বিধা হয়। সঙ্গে দুলি নেই, ড. দেব ঘরে আছেন কিনা জানি না ইত্যাদি কারণ মনে কাজ করেছিল কিনা বলতে পারব না। জ্যোতি জানায় সেই সন্ধ্যায় ব্রিটিশ কাউন্সিলে একটা বিদেশি ছবি দেখতে যাওয়ার কথা ছিল তার, কিন্তু এখন ভাবছে আর যাবে না। 

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু।

রোকেয়া হলে আমার বিশেষ বন্ধু, দিনাজপুরের মেয়ে দুলি (জয়ন্তী সরকার; প্রাণিবিদ্যার ছাত্রী)। তার সঙ্গেই বাকি তিনবার, অর্থাৎ পর পর তিন রবিবার, গেছি ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডের বাড়িতে। দুলির লোকাল গার্জিয়ান ছিলেন দার্শনিক ড. গোবিন্দ দেব, যিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান। ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডের বাড়িটি, জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট হিসেবে ড. দেবের বাসস্থান। প্রফেসর দেব জ্যোতিকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। গত বেশ কয়েক বছর ধরে জ্যোতি এ বাড়িতেই থাকে। দুলি মাঝে মাঝেই আসত এ বাসায় তার দাদু অর্থাৎ লোকাল গার্জিয়ানের সঙ্গে দেখা করতে। জীবন্ত কিংবদন্তি, ঋষিতুল্য মানুষ ড. দেবের প্রতি কৌতূহল ছিল আমার নিজেরও। তার সঙ্গে একবার দেখা করার বাসনা নিয়েই প্রথম সে বাড়িতে যাই দুলির সঙ্গে, ২০ আগস্ট। বাড়ির সামনে লনের একপাশে বাঁধানো রাস্তাটির ওপর তখন ক্রমাগত পায়চারি করছিলেন ড. দেব। পরে জেনেছি, তার বহুমূত্র রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শরীরচর্চার অংশ হিসেবেই এই প্রাত্যহিক পায়চারি। এত শুনেছি যার কথা, তাকে প্রথম সামনাসামনি স্বচক্ষে দেখছি। দুলি আমাকে আলাপ করিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমাদের বাসার ভেতরে নিয়ে যান। জ্যোতির সঙ্গে তিনি যখন আমায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, প্রবল সর্দিতে আক্রান্ত জ্যোতি তখন টেবিলের ওপর বিশাল এক গামলায় ফুটন্ত জল রেখে তোয়ালে দিয়ে পুরো মাথা ঢেকে চেয়ারে বসে মুখ নিচু করে স্টিম নিচ্ছে। তার নাম ধরে ডাকলে, মাথা থেকে তোয়ালে সরিয়ে ফোলা ফোলা লালচে নাক-চোখসহ পুরো মুখম-লটা বের করে আমাদের দিকে তাকায় জ্যোতি। আর সেই জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সঙ্গে জীবনে প্রথম সাক্ষাৎ আমার। পরিচয়ের পর আমার প্রথম প্রশ্নটিই ছিল, কুয়াশার লেখক ‘জ্যাতিঃপ্রকাশ দত্ত’ই তিনি কিনা। হেসে সম্মতি জানায় জ্যোতি, সেই সঙ্গে খানিকটা সংকোচও হয় বুঝি তার। উত্তীর্ণ কৈশোরের সেই অপরিণত রচনার জন্যই কি? অথবা বিসর্গযুক্ত নামের জন্য?

জ্যোতির নামে বিসর্গ ব্যবহারের পেছনের কাহিনি শুনেছি আরও পরে। ওর ছোট মামা ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার সময় ‘জ্যোতি’ ও ‘প্রকাশ’কে শুধু যে আলাদা করে লিখেছিলেন তা নয়, ‘জ্যোতি’র পরে একটা বিসর্গও বসিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে উঠতি লেখক জ্যোতিঃ প্রকাশ যখন তার প্রথম ও মধ্যম নামকে জোড়া দিয়ে এক করে ফেলল, তখনো অনেক দিন মাঝখানে বিসর্গটা টেনে বেড়িয়েছিল। ‘কুয়াশা’ ও ‘পরমাত্মীয়’র মাঝে কোনো এক সময় বিসর্গ ঝরে পড়েছে।

গল্পগুজব ও খাওয়া-দাওয়ার পর শেষ অপরাহ্ণে যখন দুলি ও আমি হলে ফিরে যাচ্ছি, তখন জ্যোতি আমাদের পরের রবিবার দুপুরে তার নিজের হাতের রান্না খিচুড়ি খেতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাল, যেটা সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলাম আমরা। এভাবে পর পর দুই রবিবার দেখা হওয়ার পরই জ্যোতি-আমি উভয়েই টের পাই, এটা নেহায়েত সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়। এর ঠিক পরেই, বুধবার বিকেলে- ৩০ আগস্টে, এক-দু মিনিটের জন্য গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সেই বাক্যালাপ। তারপরে সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে, অর্থাৎ আমাদের সাক্ষাতের চতুর্থ দিনে, জ্যোতি আমাকে ও দুলিকে দুটি ছোট ছোট ফরাসি পারফিউম উপহার দেয়, ‘মাই সিন’ ও ‘মা গ্রিফ’ যাদের নাম। সেই সঙ্গে জানায়, পড়াশোনা করার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে সে, আর মাত্র কয়েকটা দিন পরেই, ৩০ সেপ্টেম্বরে। কিন্তু যাওয়ার আগে সে নিশ্চয়তা পেতে চায় যে সে ফিরে আসা না পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব, এবং আমার পরিবার অন্যত্র আমার বিয়ের ব্যবস্থা করবে না। অর্থাৎ আমার অভিভাবকদের কাছ থেকে একটা পাকা কথা চায় তারা। ড. দেব ও জ্যোতির ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হায়াৎ মামুদেরও একই মত। 

বোঝা গেল, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ১৮ বছরের একটি মেয়ের নিজস্ব ইচ্ছার শক্তি বা সামর্থ্য সম্পর্কে তাদের সকলেরই মনে সন্দেহ রয়েছে। এই মুহূর্তে অভিভাবকদের যুক্ত করার ব্যাপারে আমার ভয়ানক আপত্তি ছিল, অন্য অনেক কিছুর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে কারণ, সেটা হলো, আমার তিন বছরের বড় বোন আরতি, ইকোনমিক্সে ফার্স্ট ইয়ার এমএর ছাত্রী, রোকেয়া হলে আমারই রুমমেট, তখনো আবিবাহিতা। কিন্তু জ্যোতি ও আমার ভাবী শ্বশুরের দুশ্চিন্তা মোচন করতে এবং তাদের বিশেষ অনুরোধে আমি সেই ছোড়দি অর্থাৎ আরতির মাধ্যমেই বাড়িতে কথাটা জানালাম। আমিও দিদির সঙ্গে গেলাম মুন্সীগঞ্জে।

ঘটনাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মহা হুলুস্থূল বেধে গেল চারদিকে। মনে হচ্ছিল সমস্ত বসুবাড়ি জুড়ে যেন প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে। সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। কেননা আমি বাড়ির সবচেয়ে ভালো ছাত্রী, কিছুদিন আগেই ফার্মেসিতে অনার্স শুরু করেছি। আমার অত্যন্ত আকর্ষণীয়া বড় বোন সবে এমএতে ভর্তি হয়েছে, যার একাধিক বিয়ের সম্বন্ধ বাবা সম্প্রতি নাকচ করে দিয়েছেন, পড়াশোনায় তার ব্যাঘাত ঘটবে বলে। এখনি আমার বিয়ের প্রসঙ্গে কথাবার্তার জন্য কেউ তাই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন বাবা নিজে, আমার পড়াশোনা নিয়ে যার অনেক আশা-আকাক্সক্ষা। এছাড়া সে সময়ে জ্যোতির জীবনযাপন সম্পর্কেও কিছু তথ্য হাজির করেছিলেন আমার মেজো জামাইবাবু, যা জগন্নাথ হলের কোনো ছাত্রকে জিজ্ঞেস করে তিনি জেনেছিলেন। জ্যোতি মদ, সিগারেট, গরুর মাংস খায়, শুধু সেটাই নয়, শোনা যায়, সে বিগত বছরগুলোতে একাধিক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে আবার ভেঙেও দিয়েছে। সব বিবেচনা করে এবং আমার মনোভাব জেনে জামাইবাবু ও অন্য অভিভাবকদের মত হলো, সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনো কথা বা শর্তের মাঝে না গিয়ে ছেলে বিদেশে চলে যায় এবং সেখানে গিয়ে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসে। তারপর বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবে। আর যদি পাকা কথা দিতেই হয়, বাগদান নয়, একেবারে বিয়ে হয়ে যাওয়াই শ্রেয়, কেননা, পাকা কথার পরে কে জানে সে যদি বিদেশে গিয়ে বিদেশি মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করতে শুরু করে! আর এখানে কিনা আমাদের মেয়ে তখন পথ চেয়ে বসে থাকবে! জামাইবাবু বা অন্যরা যেটা বোঝাতে পারছিলেন না, তা হলো, পাকা কথা নিয়ে চলে গিয়ে যা হতে পারে, বিয়ে করে গেলেও সেটা ঘটতে পারে এবং বিয়ের পরে সেটা ঘটলে, ওটা হবে আরও বিপজ্জনক। 

তবে যা-ই হোক, পরবর্তীকালে দেখা গেছে, দৃষ্টির একাগ্রতা হারিয়ে কারও নজর যদি কখনোসখনো এদিক-ওদিকে কিছুটা হেলে পড়ে থাকে বা অন্যত্র বিচ্ছুরিত হয়ে থাকে, সেটা ঘটেছে আমার বেলাতেই, জ্যোতির জন্য তা কখনোই প্রযোজ্য হয়নি। বিয়ের আগে যতগুলো প্রেমই করে থাকুক না কেন, ৫৬ বছরের বিবাহিত জীবনে, আমি যতদূর জানি, একবারের জন্যও জ্যোতি অন্য নারীতে মনোসংযোগ করেনি। বরং প্রকৃত বন্ধুর মতো স¯েœহে আমার হাত ধরে সে তার কাছে টেনে নিয়ে গেছে, আর একফোঁটা কটু কথা না বলে পরম মমতায় স্বস্থানে ফিরিয়ে এনেছে আমায়, যখন নিজের অজান্তে এবং অল্প সময়ের জন্য একাধিকবার আমি বাইরের দিকে নজর দিয়েছিলাম, অলক্ষ্যে বন্ধুত্বের সীমানা অতিক্রম করতে বসেছিলাম। জ্যোতির মতো সংবেদনশীল, উদার, সহনশীল ও প্রকৃত আধুনিক একজন মানুষ চারপাশে কমই দেখি। এ কথাটা কখনো কানে কানে ফিস ফিস করেও বলিনি তাকে, কিন্তু সেই অতি সত্য মন্তব্যটা আজ জনসম্মুখে প্রকাশ করতে আমার এতটুকু দ্বিধা বা সংকোচ নেই।

কোনোরকম মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া এমন তড়িঘড়ি করে বিয়ের আয়োজনে আমি ভীষণ মুষড়ে পড়ি। বড় বোনের আগে এভাবে হঠাৎ ও অতি দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করায় বারবার কেবল মনে হতে থাকে আমার, এটা যেন প্রচণ্ড এক অপরাধের জন্য নির্মম ও গুরু শাস্তি। ফলে শ্বশুরের প্রতিও আমার এক ধরনের গভীর ক্ষোভ ও অভিমান জমা হতে থাকে। এদিকে বিয়ের কথাবার্তা চলাকালে আবার হলে ফিরে এলেও মূলত বাবার অনুরোধে এবং কিছুটা অভিমানবশত আমি জ্যোতির সঙ্গে আর দেখা করিনি। সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখের পর ওর সঙ্গে আমার দেখা হয় একেবারে বিয়ের অনুষ্ঠানে। এই সময়ে বিয়ের ব্যাপারে আমার যে এতটা আপত্তি ছিল, জ্যোতির সেটা একেবারেই জানা ছিল না। সব শুনে বিয়ের রাতে জ্যোতি বলে, এটা যদি একবার তাকে জানাতাম আমি, তাহলে সেসময়ে বিয়ে কখনো সে হতে দিত না।

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসুর দুই সন্তান জয়ীষা ও দীপন।

আমাদের বিয়েতে ঢাকা থেকে অনেক বরযাত্রী গিয়েছিল মুন্সীগঞ্জে এবং তারা সকলেই প্রচুর আনন্দ করেছিল পুরো এক রাত, এক দিন। তখন এক রাস্তার না-শহর-না-গ্রাম মুন্সীগঞ্জের ঠিক মাঝখান দিয়ে বয়ে যেত বিশাল লম্বা এক খাল। সদ্য বর্ষা শেষে শরৎ এলেও ধলেশ্বরী তখনো প্রমত্তা, দুই কূল তার যথেষ্ট পরিমাণে প্লাবিত। যার জন্য লঞ্চ স্টেশনে নেমে আবার সামান্য পথ নৌকায় গিয়ে তবেই পাকা রাস্তায় উঠে রিকশা নিতে হতো। ঢাকাবাসী শহুরে বরযাত্রীরা শিহরিত হয়েছিল ভরা ধলেশ্বরীর সৌন্দর্যে, সংক্ষিপ্ত নৌকা যাত্রায়, খাবার-জলের জন্য সংরক্ষিত থানা-সংলগ্ন টলটলে পুষ্করিণীর অভিনবত্ব দেখে, আর দেখে আমার বড় বোন একুশ বছরের আরতির রূপ। কোনো কোনো বরযাত্রী নাকি প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছিল, “জ্যোতি আগে দেখেনি ওকে?” বরযাত্রীদের চা-নাশতা খাইয়ে এসে বিয়ের আসরে বসা আমাকে চুপি চুপি কথাটা বলেছিল দুলি। শুনে নিজের রূপ-স্বল্পতায় ব্যথিত হওয়ার আগে বরযাত্রীদের অসংবেদনশীলতায় পীড়িত হয়েছিলাম। 

আমাদের বিয়েতে আরও অনেকের মধ্যে গিয়েছিলেন হায়াৎ মামুদ ও দ্বিজেন শর্মা, সপরিবারে। তাছাড়া গিয়েছিলেন- আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, এখ্লাসউদ্দিন আহমদ, ড. মঞ্জুর আহমেদ, হুমায়ুন চৌধুরী, সালেহ আহমেদ, করুণাময় গোস্বামীসহ আরও অনেকে। আমার সঙ্গে রোকেয়া হল থেকে গিয়েছিল দুই বন্ধু, দুলি আর রুমি (ইংরেজি বিভাগের মরিয়ম বেগম; পরে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল; বিএনপির আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার স্ত্রী)। সারারাত ধরে বরযাত্রীরা হইচই, গল্পগুজব করেছে, আর জোরে জোরে লং প্লেতে তখনকার দিনের সব জনপ্রিয় গান বাজিয়েছে। আমার কানে এখনো বাজে, সেই রাতে পুনঃপুন শোনা শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে, ‘দ্বীপের নাম টিয়া রং’-এর সেই অনবদ্য সংগীতটি, ‘আমি চান্দেরি সাম্পান যুদি পাই’। পরদিন সকালে দেখা গেল সঙ্গে নিয়ে আসা এখলাস ভাইয়ের (শিশুসাহিত্যিক এখ্লাসউদ্দিন আহমদ) লং প্লে রেকর্ডগুলোর একটাও আর অক্ষত নেই। বহু স্থানে কেটে গেছে, প্রায় প্রতিটি রেকর্ডই। রেকর্ড প্লেয়ারটার অবস্থাও বেশ সঙ্গিন।

সদ্য বিবাহিতা আমি পরদিন স্বামী, শ্বশুর আর বরযাত্রীসহ ঢাকায়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সেই পরিচিত ৫ সেক্রেটারিয়েট রোডে, আমার নতুন ঠিকানায় উঠে আসি। বধূবরণের জন্য সে বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করছিল না তখন। যারা অপেক্ষা করতে পারতেন, আর কিছু না হোক এক তোড়া ফুল নিয়ে বরণ করে নিতে পারতেন আমাকে, যেমন আমার শ্বশুর বা অন্যান্য ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, তারা সকলেই ছিলেন আমার সঙ্গে বরযাত্রী হয়ে। কড়া নাড়ার শব্দে, বাড়ির পুরনো কাজের লোক মদন ঘুম থেকে জেগে চোখ কচলাতে কচলাতে এসে দরজা খুলে দেয়। আর আমি চতুর্থবারের মতো আবার সেই লাল রঙের ইটের বাড়িটির চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকি। তবে এবার আর অতিথি হয়ে নয়, বাড়ির বধূ হিসেবে। ঢুকি সেই ঘরে, যেখানে সেদিন থেকে মাত্র সাড়ে তিন বছর পরে পাকবাহিনীর অস্ত্রে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিহত হবেন সহিংসতাবিমুখ শান্তির দূত, দেবতুল্য, আমার ও জ্যোতির পিতৃপ্রতিম ড. গোবিন্দ দেব। আর সেই ভয়াবহ ঘটনার মাত্র এক বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৭০ সালে, আমি আমেরিকা চলে যাব পড়াশোনা করতে।

পড়াশোনা করতে জ্যোতি আমেরিকা চলে যায় সেই নির্ধারিত ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৭-তেই, আমাদের বিয়ের ঠিক ছয় দিনের মাথায়। আর আমি তখন গত সাত সপ্তাহে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে কত কী ঘটে গেল আমার জীবনে, তা বোঝার চেষ্টা করতে করতে দিশেহারা হয়ে পড়ছি। ১৯৬৭-তে জ্যোতি চলে গেলেও এবং আমেরিকায় গিয়ে টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তির ব্যবস্থা করলেও, শ্বশুরকে একা ফেলে আমি তখন বিদেশে যেতে রাজি না হওয়ায়, পড়াশোনায় সাময়িক বিরতি দিয়ে দেশে ফিরে আসে জ্যোতি আট মাস পরেই। ১৫ মাস ঢাকায় থেকে ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবার আমেরিকা ফিরে যায়। আমি তখন অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

বিয়ের পর প্রথম প্রথম জ্যোতি খুব চাইত আমি সুন্দর করে সাজি, ম্যাচ করে শাড়ি-ব্লাউজ পরি, চুলের যতœ নেই, প্রসাধন সামগ্রী- বিশেষ করে ভালো সুগন্ধি ব্যবহার করি। এ ব্যাপারে অত্যন্ত রুচিসম্পন্ন সাজগোজে অভ্যস্ত সুদর্শনা দেবী বৌদি (দ্বিজেনদার স্ত্রী) ছিল তার আদর্শ। কিন্তু কিছুকাল গেলেই ও বুঝতে পারল, মুন্সীগঞ্জের গাঁইয়া ভূতকে দিয়ে আর যা-ই হোক, সুন্দর করে সাজা বা ফিটফাট থাকা সম্ভব হবে না। মনে পড়ে, বিয়ের মাত্র কয়েক দিন পরেই ডায়াবেটিক হাসপাতালের ডা. ইব্রাহিম এসেছিলেন আমাদের ৫, সেক্রেটারিয়েটের বাসায়, খুব সম্ভবত তার কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে। দুপুরে খাবার নেমন্তন্ন ছিল তাদের। আমি তখন আমাদের পাচক মধুর সঙ্গে রান্না ঘরে গিয়ে রান্না করতে ব্যস্ত। শ্বশুর আর জ্যোতির ডাকে বাইরের ঘরে এসে দেখি, অতিথিরা সশরীরে এসে উপস্থিত। আমার শাড়িতে তখনো ছোপ ছোপ হলুদের দাগ, চুল এলোমেলো, মুখ ঘর্মাক্ত। শ্বশুরের আমন্ত্রণে মূলত আমাকে দেখতেই এসেছিলেন তারা, সেই সঙ্গে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হবে, এই যা। 

ডা. ইব্রাহিম সেই দুপুরে আমাকে কাছে ডেকে খুব আন্তরিকভাবে একটা কথা বলেছিলেন, যা আজও ভুলতে পারিনি। তিনি বলেন, কেউ যখন এভাবে অন্য কারও বাড়িতে আসে, তারা শুধু ভালো খেতে আসে না, আরও কিছুও আশা করে সেই সঙ্গে। অতিথিরা যে এখানে প্রত্যাশিত ও স্বাগত, সেটা বোঝানোর জন্য বাড়ির বাসিন্দাদের তাই অতিথি অভ্যর্থনা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। জামা-কাপড় পাল্টানো ও হাত-মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে বাইরের ঘরে অপেক্ষা করা তারই অংশ কেবল। কথাটা শুনে আমি, নববধূ, মাড়হীন কুঁচকানো মলিন শাড়িতে আরও যেন মলিন ও লজ্জিত হয়ে উঠি জ্যোতি ও শ্বশুরের সামনে, যারা আমাকে বরাবর আমার মতো করেই চলতে দিয়েছেন। 

কিন্তু সেই সময়ে আরও একটা কথাও মনে হয় আমার। মনে হয়, আমার মফস্বলের মা-বাবা মৌলিক মানবিক গুণাবলির মূল্য ও আবশ্যকীয়তা যেমন করে আমাদের মাথায় ঢুকিয়েছিলেন, আদব-কায়দা, কথাবার্তা, সাজগোজ, পোশাক-আশাকের মতো বাহ্যিক ব্যাপারগুলোর গুরুত্ব তেমন করে আমাদের শেখাননি। বলা বাহুল্য, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসে, বহু দেশ ভ্রমণ করে, বহুরকম মানুষের সঙ্গে মিশেও, সেই ব্যাপারগুলোতে আজও যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গেছে আমার। এবং আশ্চর্য এজন্য আমার খুব যে মনোকষ্ট, তা নয়। মনে পড়ে, আমাদের বিয়ের দু’দিন পর রাজশাহী থেকে এসেছিলেন জ্যোতির অগ্রজপ্রতিম বন্ধু প্রফেসর আলী আনোয়ার। আমার সঙ্গে পরিচয়ের পর পরই আনোয়ার ভাই আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘প্রতিভা গোপন করাই নারীর ধর্ম। এই সম্পর্কে আপনার কী মত মিসেস দত্ত?’ প্রথমত আমাকে তখন পর্যন্ত কেউ মিসেস দত্ত বলে সম্বোধন করেনি। জ্যোতির বন্ধুরা সকলে আমাকে নাম ধরেই ডাকে এবং তুমি বা তুই বলেই কথা বলে। তারপর, এরকম ভারী ভারী কথা ও প্রশ্ন। আমি কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকি। আর আড়চোখে কেবল আনোয়ার ভাইকে দেখি। আনোয়ার ভাইও আর আমাকে চাপাচাপি না করে চা খেয়ে চলে যান। তিনি চলে গেলে আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে জ্যোতির কাছে নালিশ করি, ‘কীরকম বইয়ের ভাষায় কথা বলে তোমার বন্ধু, নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হচ্ছে আমার।’ জ্যোতি হেসে বলে, ‘আরে, তুমি আনোয়ার ভাইকে একেবারেই চেনোনি। সে কি আর তোমার উত্তরের আশা করে এ প্রশ্ন করেছে? বরং তুমি যদি সিরিয়াস হয়ে এর উত্তর দেবার চেষ্টা করতে, তা হলেই আনোয়ার ভাই এক ধরনের মজা পেত।’ আমি জানি না, কোনটা সত্য। আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই জ্যোতি ওরকম কথা বলেছিল কিনা সেদিন। তবে আনোয়ার ভাই ও ভাবির সঙ্গে আজ, বহু বছর থেকেই, আমারও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক। নিত্য কতরকম বিষয়ে কথাবার্তা-আলোচনা হয় তাদের সঙ্গে। তবে ওরকম বইয়ের ভাষায় আনোয়ার ভাই আর কিন্তু সত্যি সত্যি কখনো কথা বলেননি।

দুই সন্তানের সঙ্গে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু।

১৯৭০ থেকে ১৯৯১ এই দুই দশক প্রায় একটানা বিদেশে ছিলাম আমরা। মাঝে মাঝে যত ঘন ঘন সম্ভব, দেশে বেড়াতে এসেছি। পড়াশোনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফেরার জন্য অনবরত চেষ্টা করেছি আমরা। তারই অংশ হিসেবে ১৯৮৭-৮৮ সালে একবার দেশে ফিরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ নিয়ে থেকে যাবার চেষ্টা করেছিলাম, সফল হইনি। জ্যোতি বাংলাদেশে প্রথম জার্নালিজমে পিএইচডি। আমেরিকায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। তা সত্ত্বেও সে ঢাকাতে একাধিকবার তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটা উপযুক্ত কাজ পেতে পেতেও শেষ পর্যন্ত পায়নি। এর ভেতর আমাদের দুজনেরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায়, আমার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ও আইসিডিডিআরবিতে গবেষক পদে এবং জ্যোতির প্রেস ইনস্টিটিউটে পরিচালক পদে সম্ভাব্য নিয়োগের আশায় নিউইয়র্ক থেকে ঢাকা পর্যন্ত কয়েকবার যাতায়াত করেছি আমরা। নিজ খরচে ইন্টারভিউ পর্যন্ত দিয়েছি দুজনেই। কিন্তু হতে হতে অজানা কারণে শেষ পর্যন্ত আমাদের দুজনের একজনেরও বাঞ্ছিত সেই চাকরি কখনো হয়নি। 

তবে এক প্রাইভেট ওষুধের কোম্পানি ও এনজিওর বদান্যতায় অবশেষে আমরা নব্বইয়ের দশকে দেশে ফিরে যাবার সুযোগ পেয়েছিলাম এবং নব্বই দশকের একটা সিংহভাগ সময় ঢাকাতেই কাটিয়েছি। দেশের বৃহত্তম দুটি এনজিওর মাধ্যমে পরিতৃপ্তির সঙ্গে কিছু ফলপ্রসূ কাজ করার সুযোগও পেয়েছি সেই সময়। তখন আমরা উভয়েই প্রচুর পরিমাণে লিখেছিও। নব্বইয়ের দশকে যখন আমরা দেশে ছিলাম, তখনই আমাদের সবচেয়ে বেশি লেখা কাগজে প্রকাশ হয়েছে, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গ্রন্থও বেরিয়েছে। আর সেই সময়েই আমরা খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি, অনুভবে যতই কাছাকাছি থাকি না কেন, হৃদয়ে যতই বাংলাদেশ ধারণ করি না কেন, শারীরিকভাবে দেশ ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা ও দীর্ঘ প্রবাস জীবন, আমাদের, বিশেষ করে জ্যোতির, সৃষ্টিশীলতার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। 

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলতে চাই, দীর্ঘ বিরতির পর জ্যোতি আবার যে লিখতে শুরু করেছিল ১৯৮৭তে, তার পেছনে প্রধানত তিনটি বড় উদ্দীপনা কাজ করেছিল- ১. নিউইয়র্ক থেকে সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহর সম্পাদনায় প্রগতিশীল বাংলা কাগজ ‘প্রবাসী’র প্রকাশনা শুরু ও সেই কাগজের উপদেষ্টা হিসেবে জ্যোতির সম্পৃক্ততা; ২. জার্মানি থেকে বাহামা হয়ে নিউইয়র্কে কবি/গল্পকার ইকবাল হাসানের আগমন ও ‘প্রবাসী’কে উপলক্ষ করে জ্যোতিকে আবার গল্প লেখায় ফিরিয়ে আনার জন্য তার ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ; ৩. ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দেওয়ার জন্য বাড়ি-গাড়ি বিক্রি করে সপরিবারে আমাদের ঢাকায় ফেরা।

জ্যোতির লেখাকে সাধারণত দুই পর্বে ভাগ করা হয়, ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৯ এই ১২ বছর প্রথম পর্ব, যখন ‘কুয়াশা’ বাদ দিলে তার তিনখানা গল্পগ্রন্থ বেরোয়। ১৯৮৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত, এই ২২ বছর, তার লেখক জীবনের দ্বিতীয় পর্ব। এই সময়, ‘নির্বাচিত’, ‘শ্রেষ্ঠ’ বা ‘সমগ্র’ গ্রন্থগুলো বাদ দিলেও মৌলিক লেখা নিয়ে গ্রন্থিত জ্যোতির বইয়ের মোট সংখ্যা ১২। এর ভেতর ছয়টিই গল্পগ্রন্থ, অর্ধেক গল্প অর্ধেক ব্যক্তিগত রচনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত একটি গ্রন্থ (মুক্তিযোদ্ধারা), মূল বাংলা গল্পের ইংরেজি অনুবাদের গ্রন্থ একটি, বাকি চারখানা প্রবন্ধ সংকলন। মাঝখানে ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত, এই দীর্ঘ ১৮ বছরে জ্যোতি কোনো সৃৃজনশীল রচনায় হাত দেয়নি। ‘আঠারো বছরের এই বিশাল বালুচর’ নিয়ে পাঠকদের মধ্যে অনেক কৌতূহল, অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আমারও বহুবার মনে হয়েছে, আমার তরফ থেকে জ্যোতির এই অনুর্বর বন্ধ্যা সময়টার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার, কিন্তু আমি কখনো এ বিষয়ে কিছু বলিনি বা লিখিনি। আজ চেষ্টা করব কিছু সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করতে, তবে সেটা নেহায়তই আমার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। এই বিশ্লেষণের সঙ্গে জ্যোতি একমত নাও হতে পারে।

এই আঠারো বছর আমাদের যৌথ জীবনের একটি ভয়ানক ক্রান্তিকাল ছিল সন্দেহ নেই। এই সময়ে একসঙ্গে ঘনিয়ে এসেছিল অনেকগুলো পারিবারিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক টানাপড়েন, মুক্তিযুদ্ধ, সর্বোচ্চ ডিগ্রির জন্য উভয়ের প্রাণপণে পড়াশোনা/গবেষণা, পরিবারের বিস্তৃতি ইত্যাদি। সন হিসেবে এই বিশেষ ঘটনাগুলোকে শুধু উল্লেখ করলে দেখা যাবে এরকম- এক. মুক্ত, বেপরোয়া, ঘটনাবহুল একক জীবন থেকে হঠাৎ জ্যোতির যৌথ জীবনে, ঘর-সংসার-চাল-নুন-তেলের প্রাত্যহিকতার একঘেয়েমিতে প্রবেশ (১৯৭০)। দুই. আমার আমেরিকায় আসার কয়েক মাসের মধ্যে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে অকস্মাৎ আমার বাবার মৃত্যু (১৯৭০)। তিন. বিদেশে ছাত্র অবস্থাতেই আমার চারটি নাবালক ভাইবোন ও মা, ঠাকুমাসহ গোটা পরিবারের জীবনযাত্রার দায়িত্ব গ্রহণ (১৯৭০-১৯৮০)। চার. পাকবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিজগৃহে শ্বশুরের মৃত্যু (১৯৭১)। পাঁচ. মুক্তিযুদ্ধ, মানসিক ধকল ও প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে নানান কর্মকাণ্ডে যোগদান, মিটিং মিছিল, সমাবেশে বিভিন্ন শহরে ছোটাছুটি (১৯৭১)। ছয়. জ্যোতির ও আমার দুজনেরই একসঙ্গে আমেরিকার গ্র্যাজুয়েট স্কুলে পড়াশোনার চাপ; একই সঙ্গে কাজ করে এবং পড়াশোনা চালিয়ে দুজনের মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন (১৯৭০-১৯৮০)। সাত. আমাদের দ্ইু সন্তান জয়ীষা ও দীপনের জন্ম (১৯৭৭ ও ১৯৮৪) ও তাদের প্রতিপালন। আট. দেশে ফিরে যাবার জন্য হন্য হয়ে অনবরত চেষ্টা। কিন্তু অনেক প্রত্যাশা ও ভরসা পাওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত কোনো উপযুক্ত কাজ না পাওয়া (১৯৮০-১৯৮৬)। নয়. চারপাশে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে কথা বলা বা মত বিনিময়ের জন্য লেখক-কবি-সাহিত্যিক বা শিল্প-সাহিত্যে উৎসাহী লোকের অভাব (তখন আমেরিকায় মোট বাঙালির সংখ্যাই খুব সীমিত ছিল (১৯৭০-১৯৮৬)। দশ. আমেরিকায় তখন কোনো বাংলা বইয়ের দোকান, বাংলা খবরের কাগজ বা টেলিভিশন ছিল না (১৯৭০-১৯৮৬)। এগারো. যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত না থাকায় ই-মেইলে বা টেলিফোনে আজকের মতো এমন ঘন ঘন লেখার তাগিদ আসত না দেশ থেকে (১৯৭০-৮৭)। বারো. ইন্টারনেটে তাৎক্ষণিকভাবে দেশের সকল কাগজ ও সাহিত্য পত্র পড়ার সুযোগ ছিল না (১৯৭০-১৯৮৭)। তেরো. আজকের মতো দেশ থেকে প্রায় প্রতিমাসে পরিচিত কোনো লেখক, প্রকাশক বা শিল্পী তখন নিউইয়র্কে আসতেন না (১৯৭০-১৯৮৭)। চৌদ্দ. নিজেকে ব্যস্ত ও প্রাণবন্ত রাখার জন্য এদেশীয় নতুন নতুন হবির সৃষ্টি করা এবং অন্যান্য স্থানীয় কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, যেমন আমেরিকান ফুটবল, বাস্কেটবল, বেসবল দেখা; নাটক ও সিনেমা দেখা; কনসার্টে যাওয়া; তাস (ব্রিজ) ও দাবা খেলা; আমেরিকান সমাজের সঙ্গে মেশা, বেশ কিছু বিদেশি পারিবারিক বন্ধু অর্জন (১৯৭২-১৯৮৩)। পনেরো. অগতানুগতিক বিষয়বস্তুর দুজন পিএইচডির পক্ষে একই শহরে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সময়ে একাডেমিক নিয়োগ পাওয়া দুরূহ বলে আমদের দুজনকে বেশ কিছু বছর দুই শহরে বা দুই অঙ্গরাজ্যে থেকে কাজ করতে হয়েছে। হয়তো সপ্তাহান্তে বা মাসে দুবার দেখা হয়েছে আমাদের। শিশু সন্তানসহ স্ত্রীকে এত দূরে রেখে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন ও প্রাত্যহিক পেশাগত ধকল জ্যোতির মধ্যে যথেষ্ট মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছিল (১৯৭৭-১৯৮৩)। ষোলো. একাকিত্ব ও হতাশায় ভুগতে ভুগতে গভীর ডিপ্রেশনে যাবার পর নানারকম শারীরিক উপসর্গ তখন দেখা দিয়েছিল জ্যোতির, যার জন্য চিকিৎসারও প্রয়োজন হয়েছিল তার (১৯৭৭-১৯৭৯)। সতেরো. দেশের রাজনৈতিক অরাজকতা ও অস্থিরতার বলি- আমার বাবার বাড়ির পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদের মুন্সীগঞ্জের বাড়ি ছেড়ে রাতারাতি ভারতে চলে যেতে বাধ্য হওয়া (১৯৭৬)। আঠারো. ধানমন্ডিতে শ্বশুরের ষোলো কাঠা জমিসহ বাড়িটি, যে বাড়ি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করে বানিয়েছিল জ্যোতি, হাক্কানী খানকা শরীফ দ্বারা দখল (১৯৭৪)। উনিশ. সর্বোপরি, দেশে ফিরে যাবার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা এবং লিখতে না পারার বেদনা ও গ্লানি (১৯৬৯-১৯৮৭)।

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু।

লেখার কথা যখন উঠলই, একটা কথা বলতে দ্বিধা নেই। নিজের লেখালেখির ব্যাপারে জ্যোতির একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে, যেটা সহজে দৃশ্যমান নয়। তার লেখার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে বা আলোচনায় যেতে তার বড়ই কার্পণ্য। এই একটি বিষয়ে অত্যন্ত বেশি প্রাইভেসি রক্ষা করে সে। ওকে যদি লেখার জন্য আমি আবদার করি বা তাগাদা দিই, সে খুবই মনোক্ষুণœ হয়। পাঠক আর প্রকাশকের এখতিয়ারেই এটা পুরোপুরি রেখে দিতে চায় সে। নিজের লেখা (বিশেষ করে যে লেখা পরিকল্পনা বা নির্মাণের পর্যায়ে রয়েছে) নিয়ে আমার সঙ্গে তেমন আলাপ করে না, বা আমার লেখা নিয়েও বিশেষ কোনো কথা বলে না। নিয়মিত লেখালেখি করার অভ্যাস তার নেই, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কমই লেখে জ্যোতি। তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে হয়। কাগজ বা ম্যাগাজিন থেকে পুনঃপুন তাগাদা আসতে আসতে, যখন আর না দিলেই নয়, তখন একেবারে শেষ মুহূর্তে, এক রাতে লিখতে বসে সে। সাধারণত একটি লেখা একবারে বসেই শেষ করে, যদিও চিন্তা করতে থাকে কয়েক দিন আগে থেকেই। লেখা শেষ হলে পাঠাবার আগে কোনো লেখা বা তার অংশবিশেষ কখনো আর দ্বিতীয় বার কপি করে না বা পরিবর্তন করে না। কাটাকুটি অপেক্ষাকৃত কমই হয়। হাতের লেখাও সুন্দর ও স্পষ্ট। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে গভীর রাতে একা টেবিলের সামনে গিয়ে বসে সাদা রুল টানা কাগজ টেনে লিখতে শুরু করে জ্যোতি। বিশেষ এক ধরনের রুল টানা কাগজ তার পছন্দ যার সমান্তরাল রেখাগুলো খুব কাছাকাছি নয়, আবার বেশি দূরেও নয় এবং সেই কাগজের প্যাডে কোনো মার্জিন বা মার্জিনে কোনো ফুটো থাকা চলবে না। হাতে লেখা রচনাই কাগজে পাঠাত বরাবর। সম্প্রতি আমি বাংলা টাইপ করতে শুরু করায় জ্যোতির লেখাগুলো টাইপ করেই পাঠাই।

আমার গল্প নিয়ে সমালোচনা বা মন্তব্য অথবা কোনো ধরনের পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে তার অনাগ্রহ বরাবর। বলে, সরাসরি পাঠকের কাছে ছেড়ে দাও। শুধু বানান দেখে দেয় সে, প্রয়োজনে সংশোধন করে। তবে বিয়ের পর আমার প্রথম যে গল্প আহসান হাবীব সম্পাদিত দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছিল (একান্ত দর্পণ, ১৯৬৮), জ্যোতি সেই গল্পটি পছন্দ করেছিল এবং তখন আমাকে আমার মতো করে এভাবে সহজ করে গল্প লেখার জন্য উৎসাহিত করেছিল। এছাড়া পুনঃপুন অনুরোধে আমার আর মাত্র দু-একটি গল্পের ব্যাপারে মন্তব্য করেছে জ্যোতি, যা খুবই গঠনমূলক বলে আমি মনে করেছি। তবে আমার অনেক গল্পের নামই জ্যোতির দেওয়া। গল্পের শিরোনাম বাছাই বা স্থির করতে আমার বড়ই অসুবিধা হয় মাঝে মাঝে। আমার বেশ কয়েকটি গল্পের শিরোনাম দিয়েছেন লেখক আলম খোরশেদ, প্রাবন্ধিক শফি আহমেদ ও গল্পকার সাদ কামালী। 

জ্যোতি ও আমি দুজনেই যদিও মূলত ছোটগল্পই লিখি, যারা আমাদের লেখার সঙ্গে পরিচিত তারা সকলেই জানেন, আমাদের লেখার ধরন একেবারেই দুই রকম। জ্যোতির লেখার শৈলী, ভাষা, চরিত্র-নির্মাণ, দৃশ্য বা ঘটনার উপস্থাপনা ও বর্ণনা এত আলাদা, বিমূর্ত, জটিল, আর আমার লেখা এত সাদামাটা, গতানুগতিক যে আমার ধারণা, যা জ্যোতি তীব্রভাবে অস্বীকার করে, আমার সৃষ্টিশীল লেখার ব্যাপারে ওর একটা প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য রয়েছে। যদিও আমাকে লিখতে সবসময়েই সে উৎসাহ দেয়, বই প্রকাশ করার ব্যাপারেও সাহায্য করে, তাগাদা দেয়। তবে স্পষ্ট করে না বললেও আমি বুঝি, আমার নারী সংক্রান্ত নিবন্ধ বা বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার ব্যাপারে জ্যোতির যে আগ্রহ বা উৎসাহ-উদ্দীপনা, আমার গল্পের ব্যাপারে সেটা নেই। আমি তার জন্য তাকে দোষ দিই না। জ্যোতির মতো একজন বিশিষ্ট গল্পকার যে নিজেই ছোটগল্পের জন্য একটা নিজস্ব ভাষা নির্মাণ করেছে, একেবারে নতুন আঙ্গিকে গল্প লেখা শুরু করেছে আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী আগে থেকে, তার পক্ষে একশ বছরের পুরনো স্টাইলে লেখা গতানুগতিক এসব গল্প পড়তে বিরক্তি লাগতেই পারে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ও প্রবলভাবে বিশ্বাস করি- অতি সাধারণভাবে, বিনা আড়ালে, সাদামাটা উপস্থাপনায়, একেবারে সহজ ও সুবোধ্য ভাষায়ও উন্নত মানের গল্প লেখা সম্ভব, আমি নিজে তা লিখতে অসমর্থ হলেও।

জ্যোতি মুখে কখনো কিছু বলে না, কিন্তু বুঝি ওর মনের খুব গভীরে একটা প্রচণ্ড অভিমান, একটা ভয়ানক কষ্ট আছে, এত দিনেও তার লেখার যথেষ্ট মূল্যায়ন হলো না বলে। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি, অগতানুগতিক ও জটিল মনস্তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক গল্পের পাঠকের সংখ্যা সবসময়েই সীমিত থাকে। তবে যারা তার গল্পের প্রকৃত অনুরাগী, তারা প্রায় সকলেই বিদগ্ধ পাঠক ও একনিষ্ঠ ভক্ত। আরও বলি, জনপ্রিয় হতে চাইলে এই ধরনের ভাষা, শৈলী বা আঙ্গিক সে বেছে নিত না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এটাও মনে করি, কোনো পাঠকই নিজেকে গৌণ ভাবতে চায় না। কোনো লেখকের লেখা পড়ে যদি পাঠক ধরতে না পারে, বুঝতে না পারে, গোলক ধাঁধায় পড়ে যায়, লেখা পড়তে যতই ভালো লাগুক এবং পড়ে যতই নিশ্চিত হোক এটা এক ধরনের উঁচু মাপের লেখা, কিন্তু আধুনিক অনেক কবিতার মতো শেষ পর্যন্ত যদি ঠিক বুঝতে না পারে লেখক কী বলছেন, পাঠশেষে তখন কিন্তু সেই লেখককে অনিবার্যভাবেই প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ পাঠক। কেননা লেখকের মতো প্রতিটি পাঠকেরও নিজস্ব একটা অহংকার আছে এবং সে অহংকার বা গর্ব থেকে সে নিজেকে কখনোই বোকা, কম-বোদ্ধা বা গৌণ ভাবতে রাজি নয়।

আমাদের দেশে যারা বড় বড় লেখক, তাদের অনেককেই দেখি নারী লেখকদের লেখার ব্যাপারে এক রকম উন্নাসিকতা প্রকাশ করতে। এ মন্তব্যটা জ্যোতির বেলায় তেমন সরাসরি প্রযোজ্য নয়, কেননা সে অন্য অনেকের মতো ততটা পুরুষতান্ত্রিক নয়। তবে একেবারে অপ্রাসঙ্গিকও বলা যাবে না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত পুরুষ লেখকই সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে নারী লেখকদের লেখাকে একটা আলাদা ঘরানায় ফেলে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করতে পছন্দ করেন। এরই মধ্যে দু-একজন নারী লেখককে তারা বেছে বেছে তুলে নিয়ে আসেন নিজেদের মাঝে, যারা তাদের বিবেচনায় ‘নারী হওয়া সত্ত্বেও’ ভালো লেখক। এসব পুরুষ লেখকের উদ্দেশে আমার একটিই সতর্কবাণী, ‘সতরঞ্চ কি খিলাড়ি’র মতো তাদের এই একমুখী চিন্তা বা কর্মের মগ্নতায় কখন একদিন তারা আবিষ্কার করে না বসেন যে সাম্রাজ্যের শাসনভারে হাত বদল হয়ে গেছে।

গত কিছুকাল ধরে পৃথিবীর যাবতীয় সেরা সাহিত্য পুরস্কার ও বেস্ট সেলারের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, প্রায় সর্বত্রই নারী লেখকদের জয়যাত্রা। সাহিত্যে পৌরুষতন্ত্রের আবির্ভাব ও উপস্থিতি জরুরি কিনা সেটা বিবেচনারও বোধহয় সময় এসেছে আজ। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মানবিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে যেমন দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে, তাতে কে বলতে পারে, আজ ‘মেয়েলি’ বলে নিন্দা করার বদলে হয়তো কোনো পুরুষ লেখকের এ ধরনের লেখার প্রশংসা করতে গিয়ে কেউ বলে বসবে, ‘পড়ে মনেই হয় না, কোনো পুরুষের (পরুষালি) লেখা, এতটাই মানবিক, এতটাই মানসম্পন্ন।’ সর্বদা নিরপেক্ষ, নির্বিকার, নির্মোহ, নিরাসক্ত, যৌক্তিক ও নির্ভুল হবার জন্য রোবট তো রয়েই গেছে, থাকবেও বহুকাল। মনুষ্য প্রজাতির অর্ধেক সার্বক্ষণিকভাবে সেদিকে যদি না ঝোঁকে, তাহলে বরং তা মানবকল্যাণই বয়ে আনবে।

নিজে যতই আবছা, ধোঁয়া ধোঁয়া, দৃশ্যের আড়ালে দৃশ্যের অবতারণায় অ্যাবস্ট্রাক্ট গল্প লিখুক না কেন, জ্যোতির সবচেয়ে প্রিয় শখ ও নেশা, বেশি রাতে ঘরে বসে বসে টেলিভিশনের ক্ল্যাসিক ছায়াছবির চ্যানেলগুলোতে অথবা ডিভিডিতে পুরনো দিনের সহজ-সরল হাসির বা প্রেমের বিভিন্ন ক্ল্যাসিক ছবি দেখা। সেটা দেখে সে রাতের পর রাত, বছরের পর বছর। কখনো একই ছবি ঘুরে ফিরে বারবার। তাই বলে সিনেমা হলে গিয়ে মাঝে মাঝে আজকালকার হাইটেকে নির্মিত জটিল মনস্তাত্ত্বিক সব ছবি দেখাও বন্ধ হয়নি। মুভি দেখা ছাড়া আর যেটা প্রচণ্ডভাবে উপভোগ করে জ্যোতি, তা হলো বেড়ানো- দেশে-বিদেশে, বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে নতুন নতুন জায়গায়। বেড়াতে বেরিয়ে পড়তে সে সদা-প্রস্তুত। এছাড়া সে পছন্দ করে জম্পেশ আড্ডা দিতে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে। কেবল আড্ডার লোভে ২০০৮-০৯ সালে এক বছরে অন্তত পাঁচবার শুধু কানাডাতেই গেছে। প্রতিবার আসা-যাওয়া মিলে কমপক্ষ মোট ১২০০ মাইল ড্রাইভ করে। সাদ কামালী ছাড়াও টরন্টোতে রয়েছে ইকবাল হাসান, সালমা বাণী, সৈয়দ ইকবাল, শিবলী সাদিকসহ আরও অনেকে। বয়স নিয়ে মাথাব্যথা নেই জ্যোতির- নিজেকে বুড়ো ভেবে বা ঘোষণা দিয়ে গুটিয়ে নেওয়ার পাত্র সে নয়। ১৬ থেকে ৯০- যে কারও সঙ্গে সমানভাবে মিশতে পারে জ্যোতি।

বাচ্চাদের সঙ্গেও খুব জমে তার, শিশুরা তাকে খুব পছন্দ করে। কেননা সে তাদের সঙ্গে তাদের ভাষায় আবোলতাবোল কথা বলতে পারে অনায়াসে। ওর রসিকতা ও কৌতুকবোধ এবং বিশেষ ধরনের শব্দ নিয়ে খেলা ও বাক্য ওলট-পালট করে বলা অনেকেই, বিশেষ করে ছোটরা, খুবই পছন্দ করে। সম্পর্ক নির্মাণ বা সম্পর্কের গভীরতাবোধে আত্মীয়-অনাত্মীয়ের বা পরিবার-বন্ধুর মধ্যে পার্থক্য সে করে না। প্রতিটি সম্পর্কই আলাদা এবং নিজ নিজ গুণে স্ব স্ব স্থানে প্রতিভাত বা প্রতিষ্ঠিত। সম্পর্কের গভীরতা ও ব্যাপ্তির কথা বিবেচনা করলে অনাত্মীয় একাধিক ব্যক্তি রক্ত বা বিবাহসূত্রে আত্মীয়ের চাইতে অনেক বেশি আপন। বন্ধুদের প্রতি জ্যোতির গভীর আনুগত্য ও ভালোবাসার মস্ত প্রমাণ, সীমিত সংখ্যক অতি ঘনিষ্ঠ সুহৃদ, যেমন হায়াৎ মামুদ, বজলুর রহমান, দ্বিজেন শর্মা, আলী আনোয়ার, হুমায়ুন চৌধুরী, আবুল হাসনাত, হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে দীর্ঘ ৪৫ বা ৫০ বছর ধরে একই লয়ের ঘনিষ্ঠতা।

বিয়ের ছবি: নিচে বাঁ থেকে তৃতীয় পূরবী বসু, উপরে ডান থেকে দ্বিতীয় জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। 

সাহিত্য পাঠ, সাহিত্য সৃষ্টি আর আড্ডা ছাড়া অবসর সময় কাটে জ্যোতির সিনেমা, নাটক ও কনসার্ট দেখে, গান শুনে, কখনোসখনো স্টেডিয়ামে গিয়ে ফুটবল তবে মূলত টেলিভিশনে ফুটবল (সকার ও আমেরিকান ফুটবল উভয়ই), বাস্কেটবল, বেসবল, ক্রিকেট, টেনিস খেলা উপভোগ করে, অথবা স্রেফ টেলিফোনে আমেরিকার নানা অঙ্গরাজ্যে, দেশে বা কানাডায় প্রিয় বন্ধু বা ভক্তদের সঙ্গে আলাপ করে। গানের ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত শুদ্ধাচারের বিরোধী জ্যোতি। রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করলেও, নজরুলগীতির বিশেষ ভক্ত সে। এছাড়াও ধ্রুপদী সংগীত থেকে শুরু করে পুরনো দিনের গান, গজল, টপ্পাসহ আধুনিক গান, ব্যান্ড মিউজিক সবই শোনে জ্যোতি এবং প্রতিটি শাখার উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের গাওয়া গানের সঙ্গেই সে পরিচিত। একইভাবে পাশ্চাত্য ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার ফোক, জ্যাজ, রক, পপ, সৌল, হিপহপ সব কিছুই জ্যোতি মনোযোগ দিয়ে শোনে।

জ্যোতি সংসারী, আবার একই সঙ্গে অসংসারীও। বাইরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া সে যতই পছন্দ করুক না কেন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যাকে ফেলে রেখে বা তাদের অবহেলা করে সেটা কখনো করে না। প্রাত্যহিক ঘরকন্নার প্রচুর কাজ করত জ্যোতি। যদিও রান্না প্রধানত আমিই করি, জ্যোতিও তা করে মাঝে মাঝে এবং যখন করে খুব মনোযোগ দিয়েই করে। আর তার রান্না, যদিও পদের সংখ্যা কম, গুণগত মানে আমার রান্নার চাইতে ভালো। রান্না ছাড়াও তরকারি কাটা, বাজার করা, ঘর ভ্যাকিউম করা, ময়লা ফেলা, লন্ড্রি করা, কাপড়, কাগজ ও বিছানা গুছিয়ে রাখা, বাচ্চাদের দেখাশোনা করা সব ব্যাপারেই জ্যোতি বরাবর অংশগ্রহণ করে আসছে। তবে রান্নাঘর ও বাথরুম পরিষ্কার সে কখনো করে না, ওটা আমার দায়িত্ব। আমার বা সন্তানদের অসুখে-বিসুখে, মন খারাপের সময় দেখাশোনা করা, মনে জোর দেওয়া, সেবা করা, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, এ সবই খুব আগ্রহ ও নিষ্ঠার সঙ্গে করে সে। সময়মতো খেয়াল করে ওষুধ ও পথ্য খাওয়াতে, এমনকি বিছানা বা কাপড় বদলে দিতেও সাহায্য করে।

যদিও কুসংস্কার বা অপ্রাকৃতিক কোনো কিছুতে বিশ্বাস নেই জ্যোতির, তবু আমাদের সন্তানরা যখন ছোট ছিল তখন তাদের ব্যাপারে কখনো কখনো অযৌক্তিক হয়ে পড়ত সে। বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও যাওয়ার আগে ব্যাগভর্তি ওদের জন্য রাজ্যের নানা জাতীয় সব ওষুধ নিয়ে নিত। খুব অল্প সময়ের জন্য কোথাও গেলেও সেটা করত। ওর ধারণা, ওষুধ সঙ্গে থাকলে বাচ্চাদের কোনো অসুখ হবে না, না নিলে হবে। সন্তানদের ব্যাপারে আমরা দুজনই খুব সহজিয়া, নিয়ম-শৃঙ্খলা শেখানোর ব্যাপারে কখনো খুব কড়াকড়ি করিনি। যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে দিয়েছি। অভাব ও বঞ্চনার ভেতর দিয়ে নিজেরা বেড়ে ওঠায়, নাকি নানান ব্যস্ততার কারণে ওদের খুব বেশি সময় দিতে না পারার অপরাধবোধের কারণে, যতখানি সম্ভব ছেলেমেয়েদের ইচ্ছা, শখ ও আবদার সবসময় পূরণ করার চেষ্টা করেছি। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধর্ম ওদের দিইনি; যেহেতু আমরা নিজেরাই তাতে বিশ্বাস করি না- কোনো ধর্মের চর্চা করি না। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো কোনো হিতাকাক্সক্ষী সাবধানবাণী করেছিলেন, ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া আমাদের সন্তানরা এদেশে একদিন মারাত্মক ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এ ভুগবে। আমরা বলেছি, যদি তাই হয় অথবা এমনিতেই কোনো অভাব বোধ করে কখনো, তাহলে তখন তারা নিজেদের ইচ্ছামতো একটা ধর্ম বেছে নেবে। আমাদের মেয়ের বয়স এখন ৪৬ ও ছেলের বয়স ৩৯ বছর। এখন পর্যন্ত ওদের এ ব্যাপারে কোনো ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এর লক্ষণ দেখছি না।

বেহিসেবী সে নয় কোনোমতেই, কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে দু হাতে খরচ করতে মোটেও পিছপা হয় না। যেমন গাড়িতে দূর-দূরান্তে বেড়ানো, প্লেন ভাড়া, হোটেলে থাকা, ওভারসিজ টেলিফোন করা, ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ড্রাই ক্লিনিং, লন্ড্রিতে কাপড় ধোয়া ইত্যাদি। অন্ধকার বা স্যাঁতসেঁতে ঘরবাড়ি একেবারে সইতে পারে না জ্যোতি। সে চায় বাড়িতে আলো-বাতাস সবসময় খেলা করবে। রাতেও ঘরবাড়ি আলোয় উজ্জ্বল করে রাখতে চায় সে। যে ঘরে কেউ নেই সেখানেও পারলে সবসময় আলো জ্বালিয়ে রাখে। প্রতিটি বাতি আমি একবার নেভাই, সে জ্বালায়। সুন্দর করে গুছিয়ে থাকতে ভালোবাসে জ্যোতি। বিশেষ করে বাইরের ঘর, শোবার ঘর ও পড়ার ঘর সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম থাকবে- তার বিশেষ ইচ্ছা। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে বড়ই অগোছালো। দিনের পর দিন মেঝেতে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা কাগজ বা কাপড় আমার কাছে মোটেও অসহনীয় মনে হয় না, গায়ে জ্বালা ধরায় না। এটা জ্যোতির একটা বড় মনোবেদনার কারণ। তবে রান্নাঘর ও বাথরুম যদি নোংরা থাকে, আমি কিন্তু অস্থির হয়ে উঠি, জ্যোতির আবার তাতে তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না। টিপটপ সুন্দর করে থাকতে অভ্যস্ত জ্যোতি কেবল একরাতের জন্য কোনো হোটেলে উঠলেও সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রুমটিকে নিজের পছন্দমতো করে তোলে।

আমাকে দেওয়ার জন্য উপহার নির্বাচনের বেলায় নিজের পছন্দ, সমাজে প্রচলিত ধারা, শোভনতাবোধ অথবা গতানুগতিক প্রত্যাশাকেই বেশি প্রাধান্য দেয় সে- আমি আসলে কী চাই তার বদলে। যার জন্য জন্মদিনে, বিবাহবার্ষিকীতে, মাদার্স ডেতে ফুল, গয়না, শাড়ি, পারফিউম, চকোলেট বা কার্ড আনতে ভোলে না জ্যোতি। আমি বহুবার বহুভাবে বলেছি, এসব অতি-প্রত্যাশিত উপহার আমাকে উদ্বেলিত করে না। তার চেয়ে বরং ঘর সাজানোর কোনো ছোটখাটো উপকরণ, একটা তরতাজা গাছ, চানাচুর বা বাদাম বেড়ে দেওয়ার জন্য কোনো সুন্দর পাত্র, প্রিয় গানের কোনো সিডি কিংবা পছন্দের ছায়াছবির একটি ডিভিডি যদি নিয়ে আসত, তাহলে আমি বেশি খুশি হতাম। সুতি শাড়ি, বিশেষত তাঁতের শাড়ি পরতে খুব ভালো লাগে আমার। কিন্তু জ্যোতির পছন্দ সিল্কের শাড়ি এবং বরাবর তার পছন্দমতো ভালো ভালো সিল্কের শাড়িই কিনে এনে দেয় আমাকে। ফলের মধ্যে আমার বিশেষ প্রিয় তাল-শাঁস, কালো জাম, কামরাঙ্গা; কিন্তু এর কোনোটাই প্রকৃত ফলের আওতাতেই পড়ে না জ্যোতির বিচারে। তাই গরমকালে আম, লিচু, পেঁপে ঘরে আসবে, কিন্তু আমার ওইসব অদ্ভুত ভালোলাগার জিনিসগুলো তার হাতে উঠবে না কখনো। সাদা ও কালো রঙের শাড়ি আমার বিশেষ পছন্দের। কিন্তু পোশাকের জন্য এ দুটি রং জ্যোতি অপছন্দ করে এবং কখনো আমার জন্য সাদা বা কালো শাড়ি কেনে না সে। আমার বিয়েতে জ্যোতি যে বেনারসি দিয়েছিল তার রং লাল বা খয়েরি ছিল না, ছিল রুপালি-ছাই। ৫৬ বছর আগে বিয়েতে এরকম রঙের বেনারসি আর কেউ তার স্ত্রীকে দিয়েছে কিনা জানি না। তবে সেটি আমার খুবই পছন্দ হয়েছিল, সন্দেহ নেই এবং সেটা আজও রয়েছে সযত্নে।

শিশুকালে মাতৃবিয়োগ, পিতার কর্মহীনতা, কঠিন দারিদ্র্য, অবহেলিত বাল্যকাল, ভগ্নগৃহ, দেশভাগ, ক্রমাগত জীবনযুদ্ধ- তার অতীত জীবনের এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে রোমান্টিকতা বা সহানুভূতি উদ্রেকের কোনো সুযোগ দেয় না জ্যোতি, কোনোভাবে মহিমান্বিতও করে না নিজেকে। প্রাত্যহিক কথাবার্তায় কখনো এসব প্রসঙ্গ উঠে আসে না, ছেলেমেয়েদেরও এ ব্যাপারে অযথা উপদেশ বা সাবধানবাণী দিয়ে বেড়ায় না। কিন্তু এ সম্পর্কে আবার কোনো হীনমন্যতাও নেই তার, নেই কারও প্রতি ক্রোধ, অভিযোগ অথবা ঘৃণা। বাল্যকালের এসব অভিজ্ঞতার কথা যেমন বলে বেড়ায় না সে, কোনোরকম রাখঢাকের চেষ্টাও করে না। রাজহাঁসের মতো পাঁকে থেকেও মাথা আর কণ্ঠ উঁচু করে রাখতে জানে সে, কাঁদা তাকে স্পর্শ করতে পারে না, সব ঝেড়ে ফেলে কালিমামুক্ত হতে শিখেছে। জ্যোতি ছাড়া এই উপমাটা আমি আরেকজন সম্পর্কেই কেবল দিয়েছিলাম একবার। নির্মলেন্দু গুণের সম্পর্কে তসলিমা নাসরিনকে একদিন বলেছিলাম কথাটা, যা তসলিমা তার বইতে গুণ সম্পর্কে নিজেই উদ্ধৃত করে দিয়েছে। 

ভাবতে বড় অবাক লাগে, জ্যোতি যেভাবে বড় হয়েছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ যখন পেল সে, তখন অর্থ রোজগারের বাসনা নিয়ে অন্য কোনো বিষয় না পড়ে বাংলা সাহিত্যে অনার্স কেমন করে পড়তে এলো, কেমন করেই বা এমন কঠিন সুবাতাসহীন শিশুকাল, কৈশোর আর প্রথম যৌবন কাটানোর পরও সাহিত্য, শিল্প, সংগীতের প্রতি এমন দুর্বার আগ্রহ ও আকর্ষণ বজায় রাখল, সৃষ্টিশীলতা অটুট রইল, নান্দনিক অভিব্যক্তি একটুও হারাল না, হাসি-খুশি ও কৌতুকবোধ অক্ষুণ্ণ থাকল! এতরকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও জ্যোতি মানবিক গুণাবলিও কিছু হারায়নি, যা হারানো খুব স্বাভাবিক ছিল তার পক্ষে। মনস্তত্ত্ববিদরা কী বলবেন জানি না, তবে আপাতদৃষ্টিতে তার চরিত্রে স্থায়ী কোনো ক্ষতের বা ঘাটতির সন্ধান পাওয়া যায় না, এ বড় বিস্ময়ের ব্যাপার। বরং ক্রমাগত আগুনে পুড়ে পুড়ে আরও যেন শুদ্ধ ও খাঁটি হয়েছে সে। আমার জানা ও দেখা অন্য অনেকের চাইতে উন্নততর মানুষ সে। তার সত্যবাদিতা, সততা, বিনয়, ভণিতাহীনতা ও সহমর্মিতা ঈর্ষণীয়। এসব গুণ বিকশিত হতে আমার ধারণা তার প্রাক-যৌবনে বাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগেরও একটা মুখ্য ভূমিকা রয়েছে।

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু।

বাংলায় এমএ পাস করলেও পরবর্তীকালে ম্যাস কমিউনিকেশনসে মাস্টার্স ও জার্নালিজমে পিএইচডি করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর জার্নালিজম ও ইংরেজি পড়িয়েছে জ্যোতি। ম্যানহাটানে পৃথিবীজোড়া নামকরা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছে। এসব দুঃসাধ্য অর্জনের কথা যখন ভাবি, মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। মনেপ্রাণে প্রকৃত আধুনিক, বন্ধুবৎসল, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিমুখ জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের দেশের প্রতি গভীর টান, অসাম্প্রদায়িকতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি- আমার আগ্রহ ও মমত্বকে দিনের পর দিন আরও পরিণত, আরও সুগঠিত করেছে।

৫৬ বছর তো কম কথা নয়! জীবনের অনেকটা চড়াই-উতরাই পথই আমরা হেঁটে এসেছি একসঙ্গে। সেই কোন ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিল! বলতে গেলে জ্যোতির সঙ্গেই বেড়ে উঠেছি আমি। আমাদের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন আশেপাশের আর দশটা জীবনের মতোই ভালোমন্দে, হাসি-কান্নায়, দ্বন্দ্বে-ছন্দে মেশানো। রূপকাহিনির একটানা সুখের বা সাফল্যের গাথা এটা নয়, হয়তো কারোর বেলাতেই সেটা ঘটে না। আজ অতীতের দিকে তাকালে অনেক নির্মল আনন্দ, ভালোলাগা ও সমঝোতার কথা যেমন মনে পড়ে, তেমনি মনে পড়ে অনেক সমস্যা-বিপদ-সঙ্কট-ঝড়-বন্যা-যুদ্ধ-রোগ-শোক-মৃত্যুকে যৌথভাবে মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতার কথা। এতকিছু এত দীর্ঘকাল যাবৎ আমরা একত্রে পার করেছি যে জ্যোতি আর আমি আজ পরস্পরের কাছে যেন আমাদের নিজস্ব হাত, পা, নাক, কান বা শরীরের অন্য কোনো বাহ্যিক অঙ্গের মতোই পুরোপুরি পরিচিত ও মুখস্থ হয়ে গেছি। নিখুঁত নয় কোনোমতেই: কিন্তু চেনা, আপন এবং নিঃসন্দেহে আরামদায়ক ও নিঃশর্ত, নিরাপদ এক আশ্রয়। এসব সত্ত্বেও প্রাত্যহিক জীবনে প্রচুর ঝগড়া, তর্ক করেছি আমরা, এখনো করি। আমি বিশ্বাস করি, দু জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যাদের স্বাধীনভাবে ও মৌলিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে, যদি পাশাপাশি একত্রে বসবাস করে, তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিতণ্ডা হবেই এবং সেটাই স্বাভাবিক। এর অনুপস্থিতি অসম দুজন মানুষের একত্রে বসবাসের ইঙ্গিত দেয় অথবা একজনের অবদমন কিংবা উভয়ের অসংবেদনশীলতার কথাই স্মরণ করায়।

আমার প্রতি জ্যোতির সবচেয়ে বড় অভিযোগ- আমার মেজাজের প্রতিনিয়ত ওঠানামা। হঠাৎ করে এবং অতি সহজে ভীষণভাবে রেগে যাবার অভ্যাস আমার, যা আবার অতি দ্রুত ঠান্ডাও হয়ে যায়। কিন্তু জ্যোতিকে তা দারুণভাবে পীড়িত করে। একই লয়ে সর্বদা শান্ত, নম্র, ভদ্র, মিষ্টভাষী জ্যোতির পক্ষে এটা মেনে নেওয়া আজও কষ্টকর। আমার এই সীমাবদ্ধতা যে সবটাই আমার আয়ত্তে নেই, এটার অনেকটাই যে জেনেটিক- অর্থাৎ জৈবিকভাবে পূর্বনির্ধারিত, জ্যোতি তা ভুলে যায়। আর জ্যোতির বিরুদ্ধে আমার সবচেয়ে বড় অভিযোগ, ছোট-বড় যে কোনো ব্যাপারে তার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা এবং সময় মেনে চলার ব্যাপারে তার গাফিলতি। এছাড়া জ্যোতি তার লেখালেখির ব্যাপারে আমার তাগাদা কিংবা তার গাড়ি চালানোর ব্যাপারে আমার কোনো সমালোচনা একেবারে বরদাশত করতে পারে না। জ্যোতি কারও কাছ থেকে কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করবার পর একেবারে শেষ মুহূর্তে সেই কাজটা করতে শুরু করে (সময় ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে আমাদের অবস্থান উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুতে)। সময়মতো কাজটা সে শেষ করতে পারবে কিনা এই দুর্ভাবনায় আমি বিচলিত হয়ে পড়ি; কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু বলাকে সে তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ মনে করে। 

অফিসিয়াল কোনো কাজ ছাড়া যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রায় সবসময়ই দেরি করে যাওয়ার অভ্যাস জ্যোতির আর আমার ঠিক উলটো। সেটাও হয়তো বাড়াবাড়ি। তবে সব ব্যাপারেই পারলে কাঁটায় কাঁটায় সময় মেনে চলি আমি। যেহেতু বিবাহিত দম্পতি হিসেবে প্রায় সব জায়গাতেই একসঙ্গে যেতে হয় আমাদের, সময়মতো যাওয়ার এই ব্যাপারটি প্রতিবারই বিষফোঁড়ার মতো যন্ত্রণা দেয় আমাকে-জ্যোতিকে। আমাদের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে সবচেয়ে বেশি ঝগড়া হয়েছে সময়মতো কোথাও যাওয়া বা সময়মতো বিশেষ কোনো কাজ না করার জন্য। আর রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে পথ নির্বাচন কিংবা গাড়ি চলার গতি মেনে না চলার জন্য। অন্য সব ব্যাপারে অত্যন্ত নিয়ম মেনে চলা সৎ ও নিষ্ঠাবান জ্যোতি কোনো রহস্যজনক কারণে সুযোগ পেলেই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঊর্ধ্ব-সীমা ছাড়িয়ে আরও জোরে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। 

এছাড়া জ্যোতির আরও একটা ব্যাপার আমি খুব পছন্দ করি না। ঝগড়া, মনোমালিন্য, তর্ক বা অপ্রীতিকর বাক্যালাপ এড়াতে সর্বদা-সচেষ্ট জ্যোতি অধিকাংশ সময়েই একটা সমঝোতার পথ বেছে নিতে তৎপর হয়। নির্বিবাদী, শান্তিপ্রিয়, শহুরে, ভদ্রলোক জ্যোতি কখনো কারও সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যেতে চায় না। এমনকি তার জন্য যদি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় পাশ কাটিয়ে যেতে হয়, তবুও নয়। নরম, মধুর, বিনীত ও মার্জিত ব্যবহার, উচ্চস্বরে কথা না বলা, কারও প্রতি বিরোধ বা বিরাগ পুষে না রাখা, প্রতিশোধে বিশ্বাস না করা, সহনশীলতা ও ধৈর্য বজায় রাখা এবং মান-অপমানবোধ বা রাগ-অভিমানের ব্যাপারে অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা পরিহার করে চলা জ্যোতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কেউ আমাকে বা জ্যোতিকে যদি অপমান করে বা অসম্মান করে কথা বলে, সে ব্যক্তির প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার করা বা প্রতিশোধ নেওয়া তো দূরে থাক, পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে সামাজিক পর্যায়ে কোথাও দেখা হলে, জ্যোতির কথাবার্তায়, আচরণে পূর্বের সেই অভিজ্ঞতার কোনো ইঙ্গিতও থাকে না। সেই ব্যক্তির সঙ্গে ব্যবহারেও কোনোরকম তারতম্য হয় না তার। 

আমি অনুযোগ করি যখন এবং বলি, আত্মসম্মানবোধে আঘাত কি লাগে না তার। সে বলে, এসব ছোট ছোট প্রাণী ভাবে আমাকে অপমান করে ধরাশায়ী করে দেবে। ওরা জানে না আমার কনিষ্ঠ অঙ্গুলিও হেলে না ওদের কটু বাক্যে বা ব্যবহারে। প্রকারান্তরে তারা তাদের এ আচরণ দিয়ে নিজেরাই নিজেদের অপমান করে, আরও ক্ষুদ্র বলে প্রমাণ করে নিজেদের।

দাম্পত্য ঝগড়া শেষে এক পক্ষের বা উভয়েরই রাগ করে ভাত না খাওয়ার ঘটনা খুবই প্রচলিত আমাদের সমাজে। কিন্তু এ ঘটনাটিও কখনো ঘটেনি জ্যোতির সঙ্গে আমার যৌথ জীবনে। প্রচণ্ড ঝগড়ার পরও নিশ্চুপে পাশাপাশি বসে আহার গ্রহণ করি আমরা। কিন্তু তার মানে এই নয়, সন্ধি স্থাপিত হয়ে গেছে তখনই। আমাদের তর্ক বা ঝগড়ার যে প্রকৃতি, তাতে খাদ্য গ্রহণ না করে বেশি কিছু অর্জনের আশা কমই।

বিয়ের প্রথম দিকে আরেকটা মন কষাকষির বিষয় ছিল, বাবার বাড়ির লোকজনের প্রতি আমার বাড়তি মমতা ও টান, যাকে মাঝে মাঝে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি মনে হতো জ্যোতির। আমার সেই আকাশ-বিদীর্ণ করা মায়া আর মনোভাবকে তার প্রতি আগ্রহের ঘাটতি বলে বিবেচনা করত সে। সময় যাবার সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝতে পেরেছে (আমিও তত দিনে নাড়ির টান থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেছি), যতক্ষণ সেই বাড়িতে আমার সাহায্য করার দরকার ছিল, ততক্ষণই আমি তা করেছি, প্রয়োজন না থাকলে সেখানে বাড়তি সময় বা সামর্থ্য নিয়োগের প্রশ্ন আসে না। তাছাড়া ইতোমধ্যে জ্যোতি আমার মধ্যস্থতা ছাড়াই, আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে নিজস্ব একটা সম্পর্ক ও নৈকট্য গড়ে তুলেছে। ফলে তাদের সুখে-দুঃখে, ভালোয়-মন্দয় আজ সে নিজেই অগ্রণী হয়ে পাশে দাঁড়ায়। আমার সহোদর আর সহোদরারা প্রত্যেকে তার অতি কাছের মানুষ; তাকে অভিভাবক মেনে আজও সংসারের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার পরামর্শ ও মতামত গ্রহণ করে। ফলে বাড়ির জামাই নয়, জ্যেষ্ঠ পুত্রের মতোই তার অবস্থান সেখানে।

বলাবাহুল্য, দ্বিজেনদা (দ্বিজেন শর্মা) ও মণিদার (হায়াৎ মামুদ) আগ্রহে জ্যোতিই আমার ছোড়দির বিয়ের ঘটকালি করে দ্বিজেনদার ছাত্র ও একলব্য শিষ্য বোটানির অধ্যাপক সুধীর কুমার দত্তের সঙ্গে। ১৯৬৯ সালের আগস্টের শেষে, আমাদের বিয়ের দু বছর পর ছোড়দির বিয়ে হয়ে যায় সুধীর জামাইবাবুর সঙ্গে।

বিয়ের পর আমি অবাক হয়ে দেখতাম, সামান্য কোনো কারণে রাগ হলে জ্যোতি একটার পর একটা কাচের প্লেট বা কাচের পাত্র ভাঙতে শুরু করে এবং যতক্ষণ না তার মনমতো কাজটি হচ্ছে বা তার মতে রাজি হচ্ছে কেউ, ভাঙতেই থাকে সে। জ্যোতির মতো যৌক্তিক একজন মানুষের কাছে এমন অযৌক্তিক, কা-জ্ঞানহীন আচরণ কল্পনা করা যায় না। এটা অন্যায়ভাবে কাউকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করা। একবার এমন করায়, আমি তাকে অনেকগুলো পাত্র ভাঙতে দিয়েছিলাম, আমাদেরই বিয়েতে উপহার হিসেবে পাওয়া নতুন চায়নার সেট থেকে। একবারও থামতে বলিনি। জানি না তার পর থেকেই কিনা, নাকি নিজ থেকে এমনি এমনিই চৈতন্য হয়েছিল। কিন্তু রাগ দেখানোর কৌশল হিসেবে সেই ভয়ঙ্কর পদ্ধতিটি সে আর কখনো প্রয়োগ করেনি। পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছে।

যে পাঁচ-ছয়টি উপকরণ সাধারণত বিবাহিত জীবন ভেঙে পড়ার জন্য বিশেষভাবে দায়ী থাকে, যেমন দীর্ঘ বিরহ, তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব, শ্বশুরবাড়ির সমস্যার অনুপ্রবেশ, সন্তান লালন-পালনের সময়টাতে স্বামী-স্ত্রীর দুজনেরই নিজস্ব কেরিয়ার গঠনের তৎপরতা, দীর্ঘ প্রবাস জীবন, আর্থিক টানাটানি- এ সবই কিন্তু ছিল আমাদের জীবনে কোনো না কোনো সময়। কিন্তু আমার মনে হয়, এই বিপরীত বা বিরুদ্ধ শক্তিগুলো নেতিবাচক নয়, প্রকারান্তরে এবং এক অদ্ভুত-আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের বিবাহিত জীবনকে আরও মজবুত করতেই সাহায্য করেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //