আমাদের পাশের জেলা জামালপুর নানা কারণে আমার ভালো লাগার একটি স্থান। এখানে জন্মেছেন আমার প্রিয় শিল্পী ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের শিল্পী রমেন সাহা (যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী), বীরেন সোম, অলকেশ ঘোষ, অলক রায় ও সুবীর চৌধুরী। এদেরও আগে ১৯৩৬ সালে এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমাদের উপমহাদেশের অন্যতম গুণী চিত্রকর গণেশ হালুই। দেশভাগের পর আরও অনেকের মতো তারাও পাড়ি জমিয়েছিলেন বাংলার ভারতীয় অংশে- পশ্চিমবঙ্গে।
তবে কিশোরকালে গণেশের রেখে যাওয়া ভালোবাসার জন্মভূমি তার মনে ঠাঁই নিয়েছিল চিরকালের জন্য। এই অমোঘ টানে তিনি বার কয়েক এসেছেন দেশে, জন্মভূমির মাটি স্পর্শ করেছেন পরম মমতায়!
জামালপুরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুবিদিত। চারুশিল্প ক্ষেত্রেও এই জেলার সুনাম দেশের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। শিল্পী অলোকেশ ঘোষের কাছ থেকে জানা গেলগণেশ হালুইয়ের আগে জামালপুরের সমর দে নামে এক শিল্পী কলকাতা আর্ট স্কুলের স্নাতক হয়েছিলেন। তিনি ওখানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের এক বছরের সিনিয়র ছিলেন, কলকাতায় বিজ্ঞাপন নকশার ফার্ম চালাতেন। তার ছোট দুটি ভাইও চিত্রশিল্পী ছিলেন। তাদের নাম অমর দে ও বীরেন দে। শেষোক্তজন চিত্রকলা চর্চার পাশাপাশি ভাস্কর্য চর্চা করেন। শুভ্রকেশ ফর্সা ছোটখাটো গুণী এই মানুষটির সঙ্গে আমার ন্যায় অনেকেরই প্রথম দেখা হয় শূন্য দশকের প্রথমার্ধে ঢাকার অদূরে সাভারে বংশী নদীতীরবর্তী বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজিত আর্টক্যাম্পে। ওপার বাংলার অনেক গুণী ও প্রথিতযশা শিল্পী ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা সেই ক্যাম্প দেখতে যেয়ে গণেশ দাকে চিনেছি।
আমার বেশ মনে পড়ছে- প্রয়াত শিল্পী আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, তাহেরা চৌধুরী, কালি ও কলম সম্পাদক প্রয়াত আবুল হাসনাত, কবি রুবী রহমান ও তার স্বামী প্রয়াত রাজনীতিক ও শ্রমিক নেতা নূরুল ইসলাম, অকাল প্রয়াত সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও শিল্পসমালোচক মিজারুল কায়েস সপরিবারে দিনব্যাপী ওই আয়োজনে শরিক হয়েছেন। শিল্পী শেখ আফজাল এবং আমিও ওই আয়োজনে সপরিবারে যুক্ত হয়েছিলাম! ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে ওখানে এসেছিলেন পরিতোষ সেন, সনৎ কর, বিজন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার, গণেশ হালুই, যোগেন চৌধুরী প্রমুখ। নদীর তীরে গাছগাছালির ছায়ায় বসে, দাঁড়িয়ে সবাই কাজ করছেন। আর আমরা ঘুরে ঘুরে তাদের কাজ দেখছি! এ এক অভাবিত ও বিরল দৃশ্য ছিল আমাদের জন্য!
শিল্পী গণেশ হালুই দাদার সঙ্গে সেবার শুধু নাম পরিচয় টুকুন। তিনি আঁকায় ব্যস্ত। কাগজে জলরঙে ফুটিয়ে তুলছেন আশ্চর্য সব জ্যামিতিক ফর্ম! সেই ফর্মের বুকে উঁকি দিচ্ছে গাছের ডাল, পাতার আভাস, আকাশের নীল!
শিল্পী সুবীর চৌধুরী গণেশ দার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন- দাদা, জাহিদ একজন শিল্পী, কবি ও শিল্পলেখক। আমার জন্মস্থান বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলে জেনে স্মিত একটা হাসি দিয়ে দাদা বললেন- যোগাযোগ রেখো।
বছর কয়েক পর- সেই যোগাযোগ হয় ঢাকার ধানমন্ডিতে বেঙ্গল শিল্পালয়ে দাদার একক চিত্র প্রদর্শনী চলাকালে। কলকাতার আকার প্রকার গ্যালারির সহযোগিতায় শিল্পী গণেশ হালুইয়ের এই একক প্রদর্শনী হয় ২০১৩ সালে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল- ‘বাস্তবের ছন্দ।’ উদ্বোধনী দিনেই ছিলাম, দাদার সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়েছে। পরে আরেক দিন যাই। সেদিন সামান্য কথা বলার সুযোগ হয়েছে অসাধারণ এই মানুষটির সঙ্গে। তখন জানলাম- শিল্পী তার জন্মস্থানের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণোদনামূলক কিছু করতে চান! জেনে আমার বড় ভালো লেগেছে। দৃশ্যশিল্পের যেসব ধরন দেখে দেখে আমাদের দর্শক চোখ অভ্যস্ত- দেখলাম গণেশ হালুইয়ের কাজ তেমন নয়! কঠিনকে তিনি কাঠিন্যের মোড়কে আবদ্ধ না করে তাকে অনেক সহজ-সাবলীলভাবে নিজের ছন্দে মেলে ধরেছেন। এ ক্ষেত্রে শিল্পী আশ্রয় নিয়েছেন অভিব্যক্তিবাদী বিমূর্ততার সঙ্গে জ্যামিতিক বিমূর্ততার। শিল্পে এরূপ বিমূর্ততার প্রয়োগ বেশ প্রচলিত হলেও হালুইয়ের উপস্থাপনা নতুন ও নিজস্ব! নিসর্গকে রূপান্তর করেই তিনি বিমূর্ততায় অবগাহন করেছেন। বিমূর্ততাকে দেশীয় সংবিৎ অর্থাৎ নিজের দেখা ও বুঝ থেকে জাগিয়ে তোলার কাজটি তিনি করেছেন। এখানেই তিনি অন্যদের থেকে আলাদা। স্বদেশ ও বিশ্বের রূপভাবনার এই সমন্বয়বাদী করণ কৌশলটি আধুনিকতার ঐতিহ্যদীপ্ত আত্মপরিচয় নির্মাণে তার অবদান গণেশ হালুইকে ভারতের আধুনিক চিত্রকলায় অনন্য এক আসন এনে দিয়েছে।
প্রকৃতির ছন্দ খুঁজতে খুঁজতে তার পরতে পরতে সৌন্দর্য সন্ধানে তার মনের ভেতরে বৌদ্ধ-দর্শনের সহজিয়া ভাবের ছায়াপাত ঘটেছে। দুঃখের ছায়াতপে খুঁজে নিয়েছেন আনন্দের নির্যাস! রবীন্দ্রনাথের গানের ভাব ও সংগীতময়তার অনুরণন যেন শুনতে পাই তার কতক চিত্রের অন্দরে। কবিতার প্রতিও তার ভালোবাসা আছে, নিজেও লেখেন।
ভারতবর্ষের আধুনিক শিল্পের এক বরেণ্য সদস্য গণেশ হালুইয়ের বয়স এখন ছিয়াশি। আমাদের অন্তরের চাওয়া- তিনি সৃজনের আনন্দে সুস্বাস্থ্যে সচল-সবল থাকুন। প্রাণভরে দীর্ঘকাল বাঁচুন বাংলা মায়ের অসামান্য গুণী এই কৃতী সন্তান। আর আমরা তার শিল্পের আলোয় আলোকিত হই।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : শিল্পী গণেশ হালুই
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh