গজল: প্রেমসংগীত নাকি প্রেমের কবিতা

বিরহকে উপজীব্য করে গড়ে উঠেছে গজলের আত্মা। জুতসই প্রায় অলঙ্ঘনীয় দৈহিক সৌষ্ঠব নিয়ে সুপ্রাচীন কাল থেকে চর্চিত হয়ে এসেছে গীতিকবিতার এই ধারা। আরবের মরুচারী ওরফে চারণ কবিদের হাত ধরে গজলের যাত্রা শুরু হলেও পারস্যের কবিদের কলমে গজল উৎকর্ষ লাভ করে। সানা’ই গজনভি, শেখ সাদী, মাওলানা রুমি, হাফিজ সিরাজী প্রমুখ ফারসির কবিগণ গজলকে একটি উচ্চ মোকামে নিয়ে যান। প্রায় বারোশ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় গজল-চর্চা অব্যাহত আছে। আরবি ফারসি উর্দু পশতু জার্মান স্প্যানিশ ইংরেজি, এমনকি বাংলাসহ প্রভৃতি ভাষায় আছে তার প্রতুল নমুনা।

গজল মূলত কবিতার ধরন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও সংগীতের একটি ধারা হিসেবেও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। একপাক্ষিক প্রেমের আখ্যান রচনাই গজলের বৈশিষ্ট্য। সুর সংযোজন করে অনায়াসেই গজল গীত হতে পারে। তবে শেরের মেজাজের উপর তা নির্ভরশীল। সাধারণত ভারী মেজাজের শের সুরের জন্য উপযোগী থাকে না। একটি গজলকে প্রথমত কবিতা হিসেবেই পাঠের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে কবিতা আমরা পড়ে থাকি সরবে। সুর করে গাওয়া যায় বলে গজল অন্যান্য কবিতার চেয়ে পরিবেশনের কালোয়াতির কারণে একটু বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তবে অনেকেই গজলকে লঘু সংগীত হিসেবে মনে করে। গজল বাণী প্রধান বলে সুরের অলংকারের আধিক্যের দাবি রাখতে বাধ্য নয়। 

বাংলা কবিতা যেমন শক্তিমান, ঋদ্ধতায় পরিপূর্ণ, বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তিতে আলোকিত, চিন্তা-দর্শন-ভাবুকতায় অপরাজেয় ঠিক তেমনি বাণীনির্ভর বাংলা গানও শিল্প বিপ্লবের ধাক্কায় বদলে যাওয়া মানুষের হাত থেকে পড়ে যাওয়া চিরায়ত প্রশ্ন, আবেগ, চিন্তা, অনুসন্ধান, অপ্রাপ্তি, অভাব বোধের আস্ফালনে ভরপুর।

শুনেছি সবকিছু একদিন শেষ হয়ে যায়
প্রিয়র বিচ্ছেদের যাতনা তবু থেকে যায়॥

 শুনেছি সবার হৃদয়ে আজ তোমার বাসনা
এভাবে পথে চলা কত রাত শোকে হেসে যায়॥ 

 তাকে যে ভালো না বেসে আর তো উপায় ছিল না
যখন কানায়ের সুরে তার বাঁশি বেজে যায়॥

 পথ সে কঠিন যতই হোক যদি থাকে প্রেম
তাহলে হৃদয়ে একটা কিছু পথ খুলে যায়॥ 

 আমার অক্ষমতাকে দেখে হতাশ হলাম
কেমন তোমার ঘরের কথা ঠোঁটে এসে যায়॥ 

 আমার সহানুভূতির খোঁজ হারিয়েছি কবে
কখনো নিজের খবর নিতে মন ভুলে যায়॥ 

 নিজের প্রাণটা যদি থাকত নিজের মুঠোয়
তাহলে তসলিম বলে জগতে কী এসে যায়॥

তোমার দেখাদেখি যেন আমিও ভুলে গেছি নিজেকে
হারানোর পথের দিকে কিছুটা নিয়ে গেছি নিজেকে॥ 

 তোমার হৃদয়ে আমি যে মুছে যাওয়া এক চিহ্ন
কোথায় না কোথায় প্রিয় কত যে খুঁজে গেছি নিজেকে॥

 হয়তো কোনো হৃদয়ের বাঁধন দিয়ে ধরা পড়েছি
কেন তবে অজানা ভয় সাহস দিয়ে গেছি নিজেকে॥

বেদনার চাবুক দিয়ে এমন খেলাঘর গড়েছ
দুখের মদিরা পানের পাত্র করে গেছি নিজেকে॥

 হাত যদি না রাখো ধরে আপন ইচ্ছায় তাহলে
বৃথা এই স্বপ্ন দেখা অল্পে বুঝে গেছি নিজেকে॥ 

এসো তসলিম এই তো এসেছে বসন্ত রজনী
প্রেমের আঙিনায় আজ বিরহী বলে গেছি নিজেকে॥ 

তোমার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে বিরহ
দুঃখ রাতের প্রদীপ হয়েছে বিরহ॥ 

 জীবন তো নয় মিষ্টি পানির নহর
পরতে পরতে নোনতা করেছে বিরহ॥ 

আমাদের আছে রক্তের সম্পর্ক
যে কূলেই থাকি হৃদয় কেড়েছে বিরহ॥ 

এই পৃথিবীর ক্লান্ত মানসে কখনো
অবিরাম প্রেমে ডুবতে দিয়েছে বিরহ॥ 

তোমাদের মতো ভেবেছি আমিও পেয়েছি
কালের গর্ভে তসলিম আছে বিরহ॥ 

তুমি আছ তাই প্রেমের কুঞ্জ হয়েছে এই জগৎ
ছিলে না যখন মরুর তৃষ্ণা সয়েছে এই জগৎ॥

মনে হবে যেন তোমার অভাবে দিবসে রজনী নামে
আঁধার তো ছল গোপন প্রণয় শিখেছে এই জগৎ॥

তোমার ভাবের একটি মুকুল ফুটবে ফুটবে ভাব
অলকে অলকে খোঁপার বৃন্তে ফুটেছে এই জগৎ॥

আরশ কুরসি বুকে নিয়ে ঘোরো কাকে দেবে রাজাসন
সমর্পণের চাবি হাতে কত ঘুরেছে এই জগৎ॥

তসলিম এক মাটির প্রদীপ জ্বলে থাকে অবিরত
অল্পে কাতর মানুষের হাত ধরেছে এই জগৎ॥

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //