বিশ্বজয়ে বাংলার বৈশাখ

ব্যক্তি বা গোষ্ঠীমাত্রই আপন সংস্কৃতিতে অনুরক্ত হয়ে ওঠে। সংস্কৃতিপ্রিয় ও আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতিও এই সূত্রের অধীন। স্বদেশে তো বটেই, বিশ্বের যত জায়গায় বাঙালির বসবাস রয়েছে, তত জায়গায়ই বাঙালি সংস্কৃতির প্রকাশ বিদ্যমান। খাওয়া-পরা, আচার-আচরণ, ধর্ম-কর্ম সব কিছুতেই বাঙালিরা আপন সংস্কৃতির লালন করে থাকে। আর, কোনো পর্ব বা উৎসব হলে বাঙালির মনোজাগতিক চেতনা বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত উথাল-পাতাল অবস্থা ধারণ করে। বিশ্বের অসংখ্য দেশে বাঙালিরা আজ উৎসবমুখী জাতি হিসেবে সকলের সমীহ অর্জনে সমর্থ হয়েছে।

শুধু তাই নয়, বাঙালির উৎসবে নেচে-গেয়ে আজ নেটিভরাও আনন্দ উপভোগ করছে। অবশ্য বাংলা গানের যে শৈল্পিক গুণাবলী রয়েছে তা সংস্কৃতিমনস্ক যেকোনো ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। তেমনই একটি বাঙালি উৎসব নববর্ষ, আর তেমনই একটি বাঙালি গান ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’, যা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টি। এ গানটি ছাড়া যেন বাংলা নববর্ষ উদযাপন হতেই পারে না।

বাংলা পঞ্জিকা বা সনের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, মহারাজা বিক্রমাদিত্য (রাজত্বকাল ১০৫-১৫ খ্রি.পূ.) সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে পঞ্জিকার প্রবর্তন করেন, যার নাম ছিল ‘বিক্রম সাম্বাত’। এটি ছিল মূলত তিথি, নক্ষত্র, ঋতু প্রভৃতি সময় নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত একটি দিকনির্দেশনার সমাহার বিশেষ। রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল ৫৯০-৬২৬ খ্রি.) ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে একে দেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ; অর্থাৎ এই সময় হতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা সন গণনা শুরু হয়।

তবে বাংলা পঞ্জিকা বা সনকে আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত করার কৃতিত্ব মুগল সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫)। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় সকল কাজে হিজরি সন অনুসরণ করা হত। হিজরি সন হল চন্দ্রভিত্তিক, আর ভারতীয় পঞ্জিকা হল সৌরভিত্তিক। চান্দ্রমাস প্রধানত ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির সময় নির্ধারক আর সৌরমাস প্রধানত ঋতুর সময় নিরূপক। চান্দ্রমাসের বছর সৌরমাসের বছরের চেয়ে ১০-১২ দিন কম। ফলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও খাজনাভিত্তিক প্রশাসনযন্ত্রে দেখা দেয় বিরাট এক অসামঞ্জস্য। কৃষকরা ফসল ঘরে তোলার পর সে ফসল বিক্রি করে সরকারের খাজনা পরিশোধ করত। পঞ্জিকার তারিখের ব্যবধান থেকে কৃষক ও সরকার উভয়কে বিপাকে পড়তে হত। সম্রাট আকবর তার অর্থমন্ত্রী যিনি রাজস্ব ও ভূমি ব্যবস্থায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন, সেই টোডরমল্লকে একটি যথাযথ উপায় বের করার জন্য ডেকে পাঠান। উভয়ের পরামর্শ অনুযায়ী দরবারের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে ভারতীয় ও হিজরি সনের একটি বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত সংস্করণ তৈরি করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সিরাজী সাহেবের অক্লান্ত ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার প্রেক্ষিতে ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট নতুন পঞ্জিকার প্রবর্তন করেন।

বাংলা নববর্ষকে উৎসবের রূপ প্রদানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রয়েছে এক সুবিশাল অবদান। তার জন্মদিন ২৫শে বৈশাখ শান্তিনিকেতনে গ্রীষ্মের ছুটি। তিনি ঠিক করেন পয়লা বৈশাখেই তা সেরে ফেলার। তখন থেকেই শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। বাঙালি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশে নববর্ষ উৎসবের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। ১৯৬৫ সনে  সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট কর্তৃক রমনার বটমূলে আয়োজিত নববর্ষের অনুষ্ঠান সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সে থেকে বাঙালির প্রাণের উৎসব এই নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ উদযাপন।

বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালির উৎসব, সার্বজনীন উৎসব। শুধু বাংলায় বসবাসকারী নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ গোত্র নয়, এ উপলক্ষ্যে ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি সব একাকার হয়ে যায়। অনেক বছর ধরেই বিশ্বের বহু দেশের বহু শহরে/ এলাকায় পুরোপুরি বাঙালি রীতিতে নববর্ষ উদযাপন করা হয়। যেসব দেশে বাঙালিরা সংখ্যায় বেশি, সেসব দেশে জাঁকজমকও অনেক বেশি হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, আইভরি কোস্ট, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, সুইডেনসহ ইউরোপের নানা দেশে নববর্ষ অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হয়। এসব দেশের বহু শহরে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়, যাতে বিচিত্র ধরনের পণ্যসামগ্রী ও খাবার-দাবারের উপস্থিতি সকলের দৃষ্টি কাড়ে। বাহারী আল্পনা ও ফেস্টুনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানস্থল সাজানো হয়। গান-বাজনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালি ও স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। এসব অনুষ্ঠানে কেউ কেউ বাঙালি সঙ্গীতশিল্পীদের সমাবেশ ঘটিয়ে থাকেন। কোনো কোনো স্থানে দেশীয় খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। এক কথায় পহেলা বৈশাখ হচ্ছে বাঙালির একমাত্র উৎসব যেখানে সকল ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে মিলিত হয় সবাই। সকলেই কণ্ঠ মিলিয়ে থাকেন অভিন্ন গানে-

এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো

তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে 

বৎসরের আবর্জনা, দূর হয়ে যাক যাক যাক।

এভাবেই আমাদের প্রিয় উৎসব পহেলা বৈশাখ বিশ্ববিজয়ের পথে এগিয়ে চলেছে। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সারা বিশ্বে আরো সুসংহত হোক। বাংলা ও বাঙালির জয় হোক- পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ উপলক্ষ্যে এটিই একান্ত প্রত্যাশা।


লেখক: মানবাধিকারকর্মী 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //