মানসিক রোগের চিকিৎসা অপ্রতুল

প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ

দেশে ভয়াবহ হারে বাড়ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক কলহ থেকে অবসাদ, বেকারত্ব, পরিবার ও কর্মস্থলে অবহেলা, সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তা, যৌথ পরিবার ভেঙে সম্পর্কের বন্ধন আলগা হওয়া, মাদকের আগ্রাসন, জীবনযাপনে প্রযুক্তির অতিনির্ভরতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারকে মানসিক রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। 

তারা বলছেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১ লাখে ছয় জন আত্মহত্যা করছেন মানসিক সমস্যার কারণে। মানসিক রোগের কারণে এখন সন্তানের হাতে বাবা-মা আর বাবা-মায়ের হাতে সন্তান খুনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। অবসাদে ভোগা এসব রোগী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো অবসাদগ্রস্ত এসব তরুণকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে সহজে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ফেলছে; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত যে রোগটি তার নাম ‘মানসিক রোগ’। মানসিক সমস্যাকে অনেকেই কোনো রোগই মনে করে না। অনেকেই এটাকে ভান, মানুষকে দেখানো ইত্যাদি বলে চালিয়ে দেন, রোগটি সম্বন্ধে ধারণা না থাকায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে দেশে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়েছে, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে। আগের অবস্থান থেকে মানুষ খারাপ অবস্থানে চলে গেছে, এসবই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। একটা হচ্ছে লস ইভেন্ট, আরেকটা থ্রেট ইভেন্ট। কারও চাকরি চলে গেছে, ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, কোনো ব্যক্তিকে ভালো বাসা ছেড়ে দিয়ে নিম্নমানের বাসায় উঠতে হয়েছে, এসবের সঙ্গে বিষণ্ণতা জড়িত। আর থ্রেট ইভেন্টের সঙ্গে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জড়িত। আমরা হিংস্রতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা দেখছি। করোনার কারণে বহু লোক স্বজন হারিয়েছেন। এসব কারণে মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ পরিণত বয়সের নারী-পুরুষ মানসিক রোগে ভুগছেন। এ হিসেবে দুই কোটি ৫৬ লাখ মানুষ মানসিক রোগী। এরা মস্তিষ্ক অকার্যকারিতাজনিত সমস্যায় (নিউরো সাইকিয়াট্রিক ডিজঅর্ডার) ভুগছেন। এই সমস্যায় মানসিক রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেশি থাকে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে গড়ে দৈনিক ২৮ জন আত্মহত্যা করে। অধিকাংশ ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী। এ ছাড়া বাংলাদেশে ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে আছে। বিশ্বব্যাপী প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে আড়াই কোটির বেশি মানসিক সমস্যা আক্রান্ত রোগী থাকলেও, এ বিষয়ে সরকারের মাথাপিছু বরাদ্দ এক টাকারও কম। এ বরাদ্দের মধ্যেই চিকিৎসা ও অন্যান্য কিছুর ব্যবস্থা করতে হয়। ফলে বেশি রোগীকে সেবা দেওয়া যায় না।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ব্যাপক; কিন্তু ব্যক্তিগত, পারিবারিক অথবা সরকারিভাবে এ সমস্যাটিকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। চিকিৎসকরা বলছেন, ৫০ থেকে ৫৯ বছরের বিধবা মহিলাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা বেশি দেখা দেয়। এটা হয়ে থাকে পারিবারিক ও সামাজিক কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট মানসিক রোগীর ১৬ দশমিক ১ শতাংশ বয়স্ক এবং ১৮ দশমিক ০৪ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বয়স্কদের মানসিক সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও, শিশুদের সমস্যাটা নানা ধরনের অবহেলায় চিহ্নিত হয় না। খুবই সাধারণ কিছু ধারণা প্রচলিত রয়েছে সমাজে। যেমন- এ বয়সের শিশুদের এমন কিছু হয়নি, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে; কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় হলে ঠিক না হয়ে, বড় সমস্যায় আক্রান্ত হয় শিশুরা। 

মানসিক রোগীর চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে ঢাকা ও পাবনার দুটি হাসপাতালে মাত্র ৭৯০টি বেড রয়েছে। পাবনার মানসিক হাসপাতালে ৪০০ এবং ঢাকার জাতীয় মানসিক হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে বেড রয়েছে ৩৯০টি। অন্যদিকে মাদকাসক্তি চিকিৎসা করা হয় এমন বেসরকারি মানসিক ক্লিনিক রয়েছে ৪০০-এর কাছাকাছি। তবে এসব ক্লিনিকের চিকিৎসা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা ৩০০’র বেশি নয়। এর মধ্যে ৮৫ জন কাজ করছেন ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে। সামাজিকভাবে চিকিৎসা, পরামর্শ দেওয়ার জন্য ঢাকা মানসিক হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট গত দুই যুগে চার হাজার সাধারণ চিকিৎসককে প্রশিক্ষিত করেছে। এর বাইরে দেশব্যাপী ৫০ জন সিভিল সার্জন, পাঁচ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী, ২০০ ইমামকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতনে, দাম্পত্য কলহে, সম্পর্কের জটিলতার কারণে। উত্ত্যক্তকরণ ও প্ররোচিত করার কারণেও আত্মহত্যা হয়ে থাকে বাংলাদেশে। এ ছাড়া অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ এবং লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। এর বাইরে- প্রেমে ব্যর্থতা ও পরীক্ষায় অকৃতকার্য, অর্থনৈতিক সংকটসহ আরও অনেক কারণ আছে। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যাকে বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেউ আত্মহত্যা করতে চায়, এমন প্রমাণ করতে পারলে দণ্ডবিধির ৩০৯ নম্বর ধারায় এক বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। আইনটি সম্বন্ধে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে এরা তো নয়ই, যারা আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটি করেন এদের অনেকেই জানেন না। 

করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসকদের ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ বিষণ্ণতায় ভুগছেন। অপরদিকে সাধারণ করোনা আক্রান্তদের ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ ভুগছেন নানা ধরনের উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিডিসির পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। শুধু বিষণ্ণতায় নয় করোনা আক্রান্ত চিকিৎসকদের ৩১ শতাংশ চিকিৎসক নানা ধরনের দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। অপরদিকে করোনা আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভুগছে দুশ্চিন্তায় এবং এই ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থীদের ৪৬ শতাংশ ভুগছেন বিষণ্ণতায়। 

এসিটিএ সায়েন্টিফিক নিউরোলজি নামক রিসার্চ আর্টিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাউফুন নাহার, বিএসএমএমইউর অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব এবং ডা. নুরুল ইসলাম হাসিবের করা গবেষণায় বিভিন্ন বয়সের ৩৫৮ চিকিৎসকের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে। 

এতে দেখা গেছে, এই ৩৮৫ চিকিৎসকের ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশ মানসিক রোগের ঝুঁকির মধ্যে আছেন। দেখা গেছে, পুরুষ চিকিৎসকের চেয়ে নারী চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। অপরদিকে বিএমজের একটি গবেষণায় ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সের ৬৭২ জন সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন করা হয়। এরা সবাই করোনা আক্রান্ত। প্রশ্নের উত্তরগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করে চিকিৎসকরা। এই বিশ্লেষণে ৭১ শতাংশ করোনা আক্রান্তকে পেয়েছেন বিষণ্ণতা রোগী হিসেবে। এরা একই সঙ্গে মানসিক চাপ, একাকিত্ব ও নিদ্রাহীনতায় ভুগছেন। এদের মধ্যে ৩২ শতাংশ মৃদু, ২৯ শতাংশ মাঝারি এবং ১০ শতাংশ তীব্র মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। গবেষণাগুলো ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পৃথক পৃথকভাবে করা হয়েছে। 

মানসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা আক্রান্তরা করোনা থেকে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও, করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার ছয় মাস পরই মানসিক সমস্যা ছাড়াও নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। কারও উচ্চ রক্তচাপ বেড়েছে। কারও নতুন করে নিউরোলজিক্যাল সমস্যা হয়েছে। মাথা ঘোরানোর সমস্যায় ভুগছেন অনেকেই, যা আগে কখনো ছিল না, কেউ কেউ মোটা হয়ে গেছেন, বেড়ে গেছে ওজন। খাবার পরিমাণ আগের চেয়ে কমিয়েও শারীরিক স্ফীতি থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মানুষ চিকিৎসা নেয় না অজ্ঞতার জন্য। শারীরিক রোগের জন্য মানুষ যেভাবে এগিয়ে যায়, সেভাবে মানসিক রোগের জন্যও এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে মানসিক রোগ বিভাগ আছে, বড় বড় করপোরেট হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। হালকা সমস্যার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ আছে, সেখানেও মানুষ যেতে পারে। সমস্যা আছে, সমাধানও আছে। যেটা বাধা, সেটা হচ্ছে মানুষের অজ্ঞতা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //