সরকারের ‘ভালো বার্তা’ পেলে দেশে আসতে চান বেনজীর

দুর্নীতির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আগামী ৬ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে তলব করেছে। কিন্তু তার আগেই দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে চলে গিয়েছেন পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা। দুই-একদিনের মধ্যে তিনি দুবাই যেতে পারেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে তার দেশে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। 

তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, দুদকের তলবের বিষয়ে তার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছেন বেনজীর আহমেদ। সময় নেবেন নাকি আইনজীবীর মাধ্যমে দুদকের অনুসন্ধানের জবাব দেবেন তা নিয়ে আলোচনা করেছেন দেশে থাকা ঘনিষ্ঠ লোকজন ও স্বজনদের সঙ্গে। সরকারের ‘ভালো বার্তা’ পেলে তিনি দেশেও আসতে চান বলে ঘনিষ্ঠদের জানিয়েছেন।

এই প্রসঙ্গে বেনজীরের ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, মিডিয়ায় যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা সঠিক না। তিনি ন্যায়বিচার দাবি করেছেন। দুদকের তলবের জবাব দেবেন তিনি। তিনি সশরীরে আসতে না পারলে আইনজীবীর মাধ্যমে তা করবেন। এইক্ষেত্রে সময় চাইতে পারেন বেনজীর আহমেদ।

নাম প্রকাশ না করে বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠ এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, দুদকের তলব ও তালিকাভুক্ত হওয়ার আগেই তিনি সপরিবারে সিঙ্গাপুর গেছেন। সামনের দিনগুলোতে কী ঘটবে তিনি আগাম ওয়াকিবহালও আছেন। তিনি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খুবই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এমনও হতে পারে পরিস্থিতি ঠিক থাকলে তিনি দেশে এসে দুদকে আসবেন। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো খণ্ডন করবেন।

এদিকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানে তৎপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এবার দুর্নীতির পিছনে যারা সহায়তা করেছেন তাদের খুঁজছেন গোয়েন্দারা। জানা গেছে, এরই মধ্যে সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। ঐ তালিকা ধরে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে,  ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, র‌্যাব মহাপরিচালক ও পুলিশ প্রধান থাকাকালে বেনজীরকে সহায়তাকারীরা নানাভাবে সুবিধা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তার সংখ্যাই বেশি। তাছাড়া আছেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও কথিত বিভিন্ন পেশার লোকজন। 

যেসব পুলিশ কর্মকর্তার নাম আসছে তারা বর্তমানে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত আছেন। কেউ কেউ জেলার পুলিশ সুপার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আছেন পুলিশ সদর দফতরেও। ঢাকা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও গাজীপুরে জমি দখলের সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত বলে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বেনজীর আহমেদ যেভাবে দুর্নীতি করেছেন তাতে অনেকেরই সহায়তা আছে। একার পক্ষে তিনি এত বড় দুর্নীতি করতে পারবেন না। সহায়তাকারীদের মধ্যে পুলিশের লোকজনই বেশি।

তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ইন্সপেক্টর ও সাব-ইন্সপেক্টর পদের কর্মকর্তাও আছেন। তাদের মধ্যে ১৫, ১৭, ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৭, ২৭ ও ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তার সংখ্যাই বেশি। তারমধ্যে কয়েকজন আছেন চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ রেঞ্জের কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার।

ঐ কর্মকর্তা বলেন, ভাওয়াল রিসোর্টে বেনজীর আহমেদের পাশাপাশি কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার শেয়ার আছে বলে তাদের কাছে তথ্য আছে। তাদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম রেঞ্জের একটি জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন। কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও সাতক্ষীরায় জমি কিনতে বেনজীরকে সহায়তা করেছেন। যারা তাকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন প্রয়োজনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদকে যারা সহায়তা করেছেন তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। দুদক আমাদের বলেছে বেনজীর ইস্যুতে সব ধরনের সহায়তা করতে। পুলিশের পাশাপাশি কতিপয় রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন পেশার লোকজন তাকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। 

অন্যদিকে গতকাল শনিবার (০১ জুন) এক অনুষ্ঠানে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।  

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটা তার (বেনজীর আহমেদ) ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমাদের পুলিশ বাহিনী অনেক ভালো কাজ করছে, অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। জঙ্গি দমন, সন্ত্রাস দমন, কভিডকালে কাজ করেছে, যে কোনো চ্যালেঞ্জে তারা জীবন উৎসর্গ দিয়ে কাজ করেছে। কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধ করে থাকলে তার দায় প্রতিষ্ঠান নেয় না।

তিনি  বলেন, যদি কেউ অন্যায় করে থাকে, আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী বিচার হবে। সে কী দোষ করেছে, সেগুলো আমাদের কাছে এখনো তথ্য নেই। আমরা এগুলো তদন্ত করছি। তদন্ত করে জানা যাবে, সে কি দোষী, না নির্দোষ। অর্থ বানিয়েছেন, নাকি কর ফাঁকি দিয়েছেন, কিংবা সম্পদ বানিয়ে তথ্য দেননি আমাদের একটা ডিপার্টমেন্ট অনুসন্ধান করছে। 

বেনজীরের দেশের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়ে আসাদুজ্জামান খান বলেন, তাকে তো আমরা এখনো নিষেধাজ্ঞা দিইনি। সে যদি আগেই চলে গিয়ে থাকে, আমি কিন্তু সঠিক জানি না সে আছে কি না চলে গেছে। আমাকে জেনে কথা বলতে হবে।

উল্লেখ্য, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দিয়েছে আদালত। একই দিন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। তা ছাড়া জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা (৯১ একর) জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটও জব্দের আদেশ দেয় আদালত। বেনজীর পরিবারের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। সাভারে তাদের কিছু জমিও পড়েছে একই আদেশের মধ্যে। এরইমধ্যে সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //