বকরি ঈদ থেকে কোরবানির ঈদ

ইতিহাস বলছে, ঢাকায় যখন হিন্দু জমিদারদের আধিপত্য ছিল, সে সময় ছাগল কোরবানি করেই ঈদ উদযাপন করা হতো মুসলমানদের। কারণ সে সময় এই অঞ্চলে গো-হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। তখন থেকেই মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম ঈদুল আজহাকে বকরি ঈদ হিসেবে বলা হয় এখানে। তবে আজকাল সেই অবস্থার বদল হয়েছে। সারা দেশে মুসলমানরা তাদের পছন্দমতো আল্লাহর উদ্দেশে যে কোনো পশু কোরবানি দিয়ে ঈদুল আজহা পালন করেন।

তবে দিন দিন ঈদুল আজহা তার দেশীয় ঐতিহ্যের জায়গা হারিয়ে কর্পোরেট জগতে প্রবেশ করছে। এখন ঈদ মানে কর্পোরেট সংস্কৃতির জয়জয়কার; হোক তা ঈদের জামাত বা পশুর হাট। কর্পোরেট দাপটে মিইয়ে গেছে ঈদকে ঘিরে গড়ে ওঠা দেশীয় সংস্কৃতির অনন্য বাহার। 

দেশের পুঁজিপতি বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা প্রসারের জন্য বেছে নিয়েছেন ঈদ উৎসবকে। আর তাতে হারিয়ে যেতে বসেছে, ঈদের ঐতিহ্য। পুরান ঢাকায় কোরবানি ঈদ মানেই ছিল ভিন্ন এক উৎসব। এখানে সকাল বেলা কোরবানির রীতি ছিল। বিকেলে ভিন্ন এক ঢাকাকে দেখা যেত। পাড়া মহল্লায় বসত ঈদমেলা। ছেলে বুড়ো নারী সবাই মিলে মেলায় ঘুরতে যেত। সেসব মেলায় গ্রামীণ জিনিসপত্র আসত, শহরের মানুষের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠত। সম্পর্ক গড়ে উঠত সহজ সরল মাটির সঙ্গে শহুরে ইট-কাঠ পাথরের নগরীর। 

ঈদের সকালে অনেক এলাকায় শোভাযাত্রাও অনুষ্ঠিত হতো। এ ছাড়া সিনেমা আর যাত্রাপালা ছিল ঈদের মূল আকর্ষণ। পাড়ায় পাড়ায় নিজস্ব উদ্যোগে হতো নাটকের প্রদর্শনী। তাতে পুরো পাড়া যুক্ত হয়ে উৎসবে মেতে উঠত।

ঈদের সকালে তা কোরবানি ঈদ হোক বা রোজার, আশেপাশে প্রতিটি ঘরে পাঠানো হতো সেমাই ও অন্যান্য বাহারি নাশতা। এই আদান প্রদানের মাধ্যমে সমাজিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হতো। আর এখন...

সবই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তার জায়গায় এখন পাড়া মহল্লায় দখল করে নিয়েছে ডিজে পার্টি আর উন্মত্ত উৎসব। যেখানে তরুণরা অংশগ্রহণ করলেও বাদ পড়ে গেছে বাকিরা। বিশেষ করে নারীরা। তাদের ঈদ আনন্দ এখন বন্দি বোকা বাক্সে, মানে টেলিভিশনে। তারা সিরিয়াল আর বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এ বিষয়ে কথা হয় সত্তরোর্ধ্ব জব্বার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বসবাস করেন ঢাকার ধোলাইখালে। জানান, ঢাকায় ধোলাই খালে এক সময় কোরবানি ঈদে নৌকা বাইচ হতো। সে সময় সারা দেশ থেকে এখানে নৌকা আসত। সঙ্গে আসত বাহারি মনোহরি নৌকায় ভাসমান দোকানদাররা। বলা চলে মেলা লেগে যেত। নারিন্দা, আলুবাজার, সিদ্দিকবাজার, জিন্দাবাহার, কলতাবাজার, চকবাজারে বিরাট মেলা হতো বলেও জানান তিনি।

বলেন, কত কিছু দেখেছি তার আর কিছুই নেই। এখন ঈদ মানে পোলাপানরা বড় বড় স্পিকার বাজায়, হৈ-হুল্লোড় করে নাচে। কিন্তু সবাই মিলে তো আর আনন্দ করা হয় না। তিনি বলেন, আমরা হিন্দু মুসলমানরা একসঙ্গে পাশাপাশি বাড়িতে থেকে বসবাস করেছি। তারা গরু খায় না, ছোঁয় না। কিন্তু আগে কেউ বলতে পারবে না, কোরবানি ঈদে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে যে তারা অসম্মানিত হয়েছে। তাদের বাসায় আমরা সকালে সেমাই পাঠাতাম, তারাও তাদের উৎসবে আমাদের বাড়িতে মিষ্টি, নাড়ু ইত্যাদি পাঠাত, এতে করে আমাদের মধ্যে ভাইয়ের মতো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আজ আমরা আর এসব কেউ করি না। অনেক দূরে সরে গেছি। ঈদ মানে তো দূরে যাওয়া না, কাছে আসা। তাই না।

১৯০৩ সালে সর্বপ্রথম সরকারি ছুটির তালিকায় যুক্ত হয় ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার ছুটি। তাও মাত্র ১ দিন। আর আজ সরকারিভাবে তিন দিন ছুটি সঙ্গে আরও নানানভাবে ছুটি বাড়ে। তবে এই ছুটি আমাদের কর্মজীবন থেকে আলাদা করে আশপাশের মানুষের সঙ্গে যে উৎসব উদযাপন, নিজের ঐতিহ্যের সঙ্গে যে সম্পর্ক উন্নয়ন, তা কি করতে পারছে?

এখনকার ঈদ মানেই শপিংমল থেকে শুরু করে পশুর হাট, সর্বত্র কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের বাহার আর আলোকসজ্জা। এসব হয়তো বাহ্যিকভাবে ঈদ উদযাপনকে অনেক বর্ণিল করে তুলেছে। তবে তাতে কমে গেছে মানুষে মানুষে হৃদয়ের আলাপন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //